জীবনযাপন
মাঝে মাঝে জীবনের প্রতি প্রচন্ড আক্রোশ জন্মে, কারণ খুঁজতে গিয়ে যেন কিছুই খুঁজে পাই না। আলো ছায়ার মত দুম করে মনে আসে তো আবার হারিয়ে যায়। নিঃসঙ্গ দুপুরে মনের উপর পীড়াটা আরো বাড়ে। খানিক পর পর চোখ বন্ধ করে নিজেকে হাতড়ে ফিরি, স্মৃতিরা আনাগোনা বাড়িয়ে দেয়, হৃৎ যন্ত্রে কম্পন বাড়ে কিন্তু খুঁজে পাই না কিছু। সন্ধ্যার আঁধার মেখে চলতে গিয়ে মনে হয় পৃথিবী কত গতিময়, কেবল একাকী সন্ধ্যাগুলো স্থবির হয়ে আছে। খুব করে আগের মত ইচ্ছে হয় না চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে, অলস বিকেলে আকাশ দেখতে কিংবা র্জীণ প্রেমের পুরোনো ছবি আঁকতে। অথচ চোখের সামনেই বেড়ে উঠছে ধান ক্ষেতগুলো, কচি লাউ ডগাটা, বড় হয়ে যাচ্ছে আমার লাগানো আম গাছটা। প্রভাতের হিম হিম হাওয়া, স্নিগ্ধ মায়ার পৃথিবী এসব পর্যন্ত এখন আর টানে না। বয়স বেড়ে যাচ্ছে মনের, প্রেম ফুরিয়ে যাচ্ছে, বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও ডুবে যাচ্ছে চোখের জলে। আজকের পরে কালকের কথা ভাবতে ধাঁধা লাগে, হৃদয়ে হাহাকার জাগে। চোখের সামনে প্রিয় অপ্রিয়দের কাঁচা চুলে পাক ধরছে, চামড়া ঝুলে পড়ছে, মহাযাত্রার আয়োজন হচ্ছে। অথচ নির্বিকার চিত্তে দেখে যাওয়া ছাড়া আমার কোন কিছুই করার নেই।
শরতের বৃষ্টি ভেজা সকালের নেশায় মন উতলা হয়, ডুবে যেতে ইচ্ছে জাগে প্রাণপণে। স্যাঁতস্যাঁতে মনে শীতল হাওয়ায় যেন স্বপ্নগুলো জমাট বেঁধে একাকার। ভাঙা চালার ফাঁকে দু–চার ফোঁটা জলের ধারা ছুয়ে যায় দেহ, মন। টিনের চালার অবিরাম মৃদু সংগীত জাগিয়ে তোলে প্রাণ। রাস্তার পাশে ভিজে চুপসে যাওয়া অচেনা বুনো ফুল, ক্লান্ত আকাশের গর্জন কিংবা সিক্ত দেহে ছুটে চলা বাহারি বাহন - সব যেন এক অন্য রূপের পসরা সাজিয়ে। শহর থেকে দূরে জলাশয় দাপিয়ে বেড়ানো অবাধ্য গ্রাম্য বালিকার মত আমারো ঢেউ তুলতে ইচ্ছে হয় জীবনের জলাভূমিতে। মন শ্রীহীন মোড়কের আড়াল ছেড়ে ছুটতে চায় রঙিন দেশে, ভাঙা স্বরের বেসুরা গান বড় টানে, প্রাণ ভিজতে চায়।
ষোড়শীর কপালের গোল টিপের মত রূপালি চাঁদটা ক্ষয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন, বদলে যাবে শরতের আকাশ, কেবল আমি ঝিম মেরে আছি র্জীণ অতীতে। রাঙা ঊষায় হিম বাতাস ভিড় বাড়াচ্ছে দুয়ারে, আমায় আলিঙ্গন করবে বলে, আর আমি এড়িয়ে যাই প্রাতঃভ্রমণে ইচ্ছে নেই বলে। অবিরত সৌম্য ধারায় বয়ে চলা জলের মত প্রাণে বেজে চলছে জীবন স্রোতের বাণী। এক সময় বড় সাধ ছিল নীল জলে সূর্য ডুবা দেখার, জ্যোৎস্না জোয়ারে খোলা চুলে তোমায় দেখার, পাহাড়ের গা ছুইয়ে পড়া জলে স্নান করার; আজ আর ইচ্ছা করে না। ডাহুকের ডাক শুনি না বহুদিন, শিয়ালও ডাকে না, কুকুরগুলো কেমন বিষণ্ণ সুরে কেঁদে যায়। জমাট বাঁধা আধাঁরের বুকে আলো জ্বালানো জোনাকির মত আশাগুলো ছুটে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে, সীমার বাইরে। জীবনের শীতল আহ্বানে ভয় হয়, উষ্ণ ছোঁয়া পেতে ইচ্ছা জাগে। বহু পিছনের আবছা আমি কেবল বিস্ময় চোখে দেখি, হাসি আর অবাক হই। এখানে সবই মরে যাচ্ছে দিন দিন, কেবল আমিই বেঁচে আছি, মরার মত।
উদ্ভট সম্ভোগে মেতেছে সবাই, অকারণে ছুটে চলছে অজানায়, বিনয় করে আমায় ছুড়ে ফেলে জঞ্জালের খাদে। হৃদয়ের মূল্য এখানে শূন্য, ব্যস্ত পৃথিবী চোখ বুজে রাখে অদম্য অবহেলায়। চোখের জলের ধারা আর হৃদয়কে র্স্পশ করে না, ভেজায় না। আধাঁরের দেয়াল ঘেঁষে আমিও এখন দাড়াই না উঠোনের কোণে, যেখানে কাল সন্ধ্যাতেই বৃষ্টি পড়েছে বেল পাতা ছুয়ে ছুয়ে। আজ বাদে কাল, বদলে যাচ্ছে সব! ধূসর স্মৃতির পুঞ্জ ভারী করে চলেছে মনের পর্দা। আজ সন্ধ্যা জুড়ে যে আবেদনের মাত্রা মূল্যহীন, একদিন আমার কাছে এর বড় মূল্য ছিল। সেই সব সন্ধ্যা আজো লেপ্টে আছে চোখের পাতায়, উড়ে চলা বাদুড়ের পথ ধরে জেগে আছে মায়া মৃত্তিকার ভুবনে। সাধ জাগে, যদি সেই সব স্মৃতির শহরে ঘুরতে যেতে পারতাম, ধূলোর পরতে জমা জীবনের রূপ, রঙ আবারো মাখতে পারতাম! তবু আমি বেঁচে আছি, মরার মত, এতটুকু আশা নিয়ে; যদি একদিন বাঁচতে শিখে যাই।
--------------------
জীবনযাপন/জাকির
০৫ আশ্বিন, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ।
হায়রে জীবন ! ধুকে ধুকে কেবল মরার পথে.!!
মন্তব্য করুন