জীবিকা অথবা জীবন- ৯
খুব ভোরবেলা ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে রহমান সাহেব মনু মিয়ার রুমে উঁকি দিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে কিছুটা অবাক হয়ে গেলেন। তারপর কিছু একটা ভাবতে ভাবতে গেট খুলে বাইরে বেরোবার আগে আজগরকে ডেকে তুলে বললেন, আমি আইতাছি। ঘুমাইয়া পরিস না জানি!
আজগর বিছানায় উঠে বসে চোখ ডলতে ডলতে হাই তুলে বললো, আইচ্ছা যান!
আজগর তার ঘরের জানালা দিয়ে একবার বাইরে উঁকি দিয়ে ফের বিছানায় গিয়ে বসে। জানালা পথে দেখতে পায় মনু মিয়া মোরগ-মুরগিগুলোকে খোঁয়াড় থেকে বের করে তারের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তখনই সে আবার উঠে জানালায় মুখ বাড়িয়ে শব্দ করে থুতু ফেলে।
শব্দ শুনে মনু মিয়া একবার ফিরে তাকালেও কিছু বললো না। বাসিমুখে কেউ কথা বললে তার মনে হয় যে, সেই মুখ থেকে ভকভক করে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।
আজগর নিমের দাঁতন হাতে ঘর থেকে বের হয়ে পকেট গেট খুলে বাইরে যায়। তারপরই শোনা যায় কারো সঙ্গে কিছু বলতে। মনু মিয়া সবটা বুঝতে না পারলেও কাউকে সময় মত চলে আসার কথাটা পরিষ্কার শুনতে পেলো।
মোরগ-মুরগির খাবার দিয়ে মনু মিয়া গোয়ালঘরের কাছে গিয়ে খড়ের গাদার নিচে উঁকি দিয়ে কিছুক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে কোনো শব্দ শুনতে চেষ্টা করে হয়তো। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ না হওয়াতে তার মুখের ভাবে কোনো রকম পরিবর্তন হয় না। আর তাই হয়তো বিরস মুখে উঠে গিয়ে গোয়ালঘরের দরজা খুলে গাইটাকে বের করে এনে খোলা জায়গায় খুঁটির সঙ্গে বেঁধে কিছু খড় টেনে দেয়।
ঠিক তখনি রহমান সাহেবের কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া যায়। মনু মিয়া কই গেলি?
মনু মিয়া রহমান সাহেবের ডাক শুনতে পেয়ে ছুটে যায়। নানা ভাই!
রহমান সাহেব আর সালমা বেগমের হাতে তাজা ক’টি ফুল। মনু মিয়া সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, তুই করস কি? যাবি না?
মনু মিয়া বুঝতে না পেরে বললো, কই?
আরে আমাগো লগে! জলদি তৈয়ার হইয়া আয়!
মনু মিয়ার তৈরি হওয়া বা না হওয়া একই কথা। গামছাটা কোমর থেকে খুলে নিয়ে হাত-মুখ মুছে নিয়ে বললো, আমি তৈয়ার!
তাইলে তর হাতে ফুল কই?
সালমা বেগমের কথা শুনে মনু মিয়া নির্বোধের মত তাকিয়ে থাকলে সালমা বেগম বললেন, তর লাইগা দুইটা আছে। যা নিয়া আয়!
মনু মিয়া তার এত যত্নের গাছগুলোতে কেবল দুটো ফুল দেখতে পেয়ে কেঁদে ফেলার অবস্থা হলো। ফুল-ফল গাছে দেখতেই সুন্দর! কিন্তু যারা এই গাছগুলোর প্রকৃত মালিক তারাই ফুলগুলো ছিঁড়ে নিয়েছেন। যে কারণে তার কিছু করার বা বলার নেই। এখন হুকুম হয়েছে বাকি দুটো ফুলও ছিঁড়ে নিয়ে বাগানটাকে নগ্ন করে দিতে। হিন্দুরা না হয় পূজা করে বলে তাদের ফুলের প্রয়োজন আছে। মুসলমান হয়ে তারা ফুল নিয়ে যাবেন কোথায় ব্যাপারটা বোধগম্য হয় না মনু মিয়ার। মনে কষ্ট হলেও সে ফুল নিয়ে ফিরে আসে।
চল যাই! বলে, রহমান সাহেব গেটের দিকে এগোতে এগোতে আজগরের উদ্দেশ্যে বললেন, আজগর আলি, ভালা কাম তো তরে দিয়া হইবো না, আমাগো লগে যাইতে রাজি হইলি না, তয় বাড়ি খালি পাইয়া ইয়ার দোস্ত নিয়া বাজার বসাইস না!
কতক্ষণে ফিরা আইবেন? গেট খুলে দিতে দিতে জানতে চায় আজগর।
শহিদ মিনারে ফুল দিতে যতক্ষণ লাগে আর কতক্ষণ ঘুরতে ফিরতে যতক্ষণ লাগে! তা ধর, ফিরতে ফিরতে বেলা খাড়া হইয়া যাইবো!
ঠিক আছে, চিন্তা কইরেন না!
রহমান সাহেব আর সালমা বেগমের পেছন পেছন গেটের বাইরে বের হয়ে এলে বাড়ির সামনের রাস্তায় একটি এক ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে দেখতে পায় মনু মিয়া। প্রথম ঢাকা শহরে এসে ঘোড়ার গাড়ি দেখতে পেয়ে তার শখ হয়েছিলো এতে চড়ে দেখবে। কিন্তু এ পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়িতে চড়ার সুযোগ বা উপলক্ষ কোনোটারই সাক্ষাৎ পায় নি সে।
রহমান সাহেব মনু মিয়ার দিকে একবার ফিরে ঘোড়ার গাড়িটি দেখিয়ে বললেন, এইটা চিনস?
ঘোড়ার গাড়ি! বলে, সে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
যা উইঠা বয়! এইটার নাম টমটম। এক ঘোড়ায় টানে।
মনু মিয়া যুগপৎ বিস্ময় আর অবাক হওয়ার ঘূর্ণিপাকে পড়ে কী করবে বুঝতে পারে না। তখনই সালমা বেগম মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, কি কয় বুঝস না?
মনু মিয়া মহানন্দে লাফিয়ে উঠলো গাড়িতে। তারপর কোচোয়ানের পাশে গিয়ে বসলো।
রহমান সাহেব আর সালমা বেগম আস্তে-ধীরে উঠে সিটে বসলে, মনু মিয়া পেছন ফিরে আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে জানালো, এহানতেনে হগল কিছু দেখতাইরাম!
সালমা বেগম বললেন, আরে গাধা আমাগো সামনে আইসা বয়!
মনু মিয়া দৃষ্টিতে পরম বিস্ময় নিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বললো, এহেনোই ভালা! কত কিছু দেহা যায়!
আইচ্ছা, তুই কত কিছু দেখতে থাক, বলদ! বলে, সালমা বেগম হাসতে হাসতে প্রায় গড়িয়ে পড়েন সিটের ওপর।
রহমান সাহেব কোচোয়ানের উদ্দেশ্যে বললেন, মেডিক্যালের সামনের রাস্তা দিয়া যাইস! তারপরই তিনি সালমা বেগমকে বললেন, আহা, জাগাটা দেখলে আমার খুশিও লাগে আবার খারাপও লাগে! আমরা মিছিলে যামু ঠিক করছিলাম, কিন্তু তার আগেই গুলি শুরু হইলো! আহা!
শহিদ মিনার যাওনের সময় প্রত্যেক বছরই এই কথা কও! সারা বছরে একবারও তো কইতে শুনি না! বলে, ঘাড় ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকান।
রহমান সাহেব স্ত্রীর কথার জবাব দিতে কোনো আগ্রহ বোধ করেন কিনা বোঝা যায় না। হয়তো এমনও হতে পারে তিনি সে কথা শুনতে পাননি। একমনে রাস্তায় চলাচল করা লোকজন, গাড়ি-ঘোড়া দেখতে থাকেন।
(চলবে)
এতো দিন পরে দিলেন, আর একটু বড় হতে পারতো।
ফ্লাশব্যাক আসবে কি?
===============================
লেখা যথারীতি ভালো লেগেছে। তবে তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেছে। আরেকটু বড় করে পর্ব দেন।
ও হো, আপনার লেখা হাইজ্যাকড হয়ে যাচ্ছে
বড় করার সেই সময়গুলা যে আমার নাই তা কারুরে বুঝাইতে পারি না, এইটাই আমার দুঃখ। শুরু করলাম কিন্তু যেনতেনভাবে শেষ করতে চাচ্ছি না।
এ পর্যায়ে তা আসতে পারে নিশ্চিন্তে। কিন্তু আমি এড়িয়ে যাচ্ছি!,
চুপচাপ পড়ে গেলাম।
আমিও আড়াল থেকে দেখলাম।
সিরিজ চলতে থাকুক
দেরি হয়ে যাচ্ছে যে!
মন্তব্য করুন