জীবিকা অথবা জীবন- ১০
ঘোড়ার গাড়ি চলতে আরম্ভ করলে কালো রাস্তার ওপর দিয়ে হালকা ছন্দে ছুটন্ত ঘোড়ার ক্ষুরের ঠকাঠক শব্দ কান পেতে শোনে মনু মিয়া। বড্ড অদ্ভুত সে ধ্বণি! কেমন যেন নেশা ধরে যায়। ঘোড়ার ক্ষুরধ্বণি শুনতে শুনতে হঠাৎ তার মনে হয় যে, ঘোড়ার গাড়ি চালানোর কাজটা খুব একটা মন্দ না হলেও মানুষের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকাটা খুব বেশি সুবিধার বলে মনে হয় না। প্রতিদিন কাজ খোঁজার মতই, যা না পেলে পুরো দিনই মাটি বলতে গেলে। আর এভাবেই শ্রমজীবী মানুষেরা সুবিধাবাদী মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে বাঁধা পড়ে যায় ধীরে ধীরে।
চলতি রিকশায়ও অনেক যাত্রীর হাতে ফুল দেখা যায়। কারো হাতে অনেক ফুল দিয়ে বানানো তোড়া। কেউ বা কোলে দাঁড়া করিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চাকার মত গোলাকার কিছু। নানা বর্ণের পাতার চাকতির মাঝে লাল-হলুদ ফুলের আরেকটি চাকতি।
মেডিক্যাল কলেজের সামনে আসতেই দেখা যায় খালি পায়ে কালো রাস্তার ওপর দিয়ে লঘু ছন্দে হেঁটে যাচ্ছে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ। তাদের প্রত্যেকের হাতেই কোনো না কোনো ধরনের ফুল দেখতে পায় মনু মিয়া। বাবা কিংবা মামা-চাচার কোলে একটি ছোট্ট পরীর মত দেখতে মেয়ের হাতে ধরা আছে একটি সাদা ফুল। মেয়েটি খুব যত্ন করেই ফুলটি ধরে রেখেছে বোঝা যায়। কারণ, ফুল ধরা হাতটিকে একটু উঁচিয়ে রেখেছে সে। তার চেহারায়ও ফুটে উঠেছে বেশ গর্বিত একটি অভিব্যক্তি। তার যেন খুব ভালো করেই জানা আছে, কেন এই ফুলেল যাত্রা, কিসের নিমিত্ত এই ফুল! তখনই মনু মিয়ার খানিকটা বোধোদয় হয় যে, এভাবে ফুল নিয়ে খালি পায়ে এগিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিছক কোথাও ফুলগুলোকে ছুঁড়ে ফেলতে নয়, এর পেছনে নিশ্চয় মহৎ কোনো ব্যাপার জড়িয়ে রয়েছে।
টমটমের চালক একবার অস্ফুটে বললো, সামনে তো আর যাওন যাইবো না লাগে!
তখনই মনু মিয়া প্রায় ফিসফিসে স্বরে চালকের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, মানুষজন ফুল নিয়া যায় কই?
কথা শুনে যেন ক্ষেপে গেল লোকটি। চিবিয়ে বলার মত করে বললো, জঙ্গল থাইকা আইছ নিকি? ব্যাবাকতে শহিদ মিনার যাইতাছে! উনিশশ বায়ান্ন সালে আমাগো বাংলা ভাষারে বাঁচাইতে কয়জন ছাত্র জান দিছিলো, তাগোর সম্মান জানাইতে এই ফুল। হেদিন ওই পোলাপানগুলা যদি বাংলায় কথা কওনের দাবি লইয়া রাস্তায় না নামতো, আইজগা তুমি আমি উর্দুতে কথা কওন লাগতো! বুঝলা কিছু?
তারপরই মনু মিয়ার ওপর ঝাড়তে না পারা রাগটা যেন সে ঢাললো হাতে ধরা ঘোড়াটির রশির ওপর।
আচমকা টান খেয়ে ঘোড়াটির মুখ একপাশে বেঁকে গেল। তার সাথে সাথেই গতি মন্থর হয়ে থেমে গেল ঘোড়াটি। গাড়িটিও। মনু মিয়ার দিকে তাকিয়ে লোকটি ফের বলে উঠলো, নাইমা পড় মিয়া! গাড়ি আর সামনে যাইবো না। মানুষজনের ভীড় বাইড়া গেছে!
মনু মিয়া নামার আগেই রহমান সাহেব আর সালমা বেগম নেমে রাস্তায় দাঁড়ালেন। সালমা বেগম বললেন, গাড়ি কি থাকবো?
রহমান সাহেব বললেন, থাকুক না! ফিরা যাইতে যদি কিছু না পাই?
মনু মিয়া বেশ কসরৎ করে নেমে রহমান সাহেবের পেছনে এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, চল! আমাগো কাছাকাছিই থাকিস! নয়তো হারায় যাইবার পারস!
টমটম চালক জানালো, আমি এইখানেই থাকলাম!
থাক! বলে, রহমান সাহেব সালমা বেগমের একটি হাত ধরলেন।
খানিকটা এগোতেই লোকজনের ভীড় আরো বেড়ে যাচ্ছিলো। আর এভাবে আশপাশে তাকাতে তাকাতে বিস্ময়ের পর বিস্ময় হজম করতে করতে কখন যে মনু মিয়া দলছুট হয়ে পড়েছে বলতে পারবে না। মেয়ে আর পুরুষের লাইন দুটো। পুরুষদের লাইনে এগোতে এগোতে সে দেখতে পেলো খানিকটা দূরে পাকা তিনটি থামের মত যাতে জানালার শিকের মত লোহা লাগানো আছে। যার রহস্য তার কাছে দূরবর্তী গ্রামের সীমানায় যেখানে আকাশটা মাটিতে নেমে গেছে তার পেছনকার অজানা সব রহস্যের মতই দূর্বোধ্য মনে হয় যেন।
সে এদিক ওদিক সামনে পেছনে তাকিয়ে রহমান সাহেব আর সালমা বেগমের খোঁজ করে। কিন্তু দুজনের কারো উপস্থিতি চোখে পড়ে না। ঠিক তখনই পেছনের লোকটির ধাক্কা খেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শুনতে পায় খুব মিষ্টি শব্দে কোনো বাচ্চা মেয়ে কথা বলছে। সে মনযোগ দিয়ে শুনতে চেষ্টা করে- তাহলে ওটা বড় কেন?
মনু মিয়া খেয়াল করে দেখতে পায় সিমেন্ট আর লোহার তৈরী জানালার মত তিনটি স্তম্ভের ব্যাপারেই শিশুটির কৌতুহল।
তাকে কোলে নিয়ে রাখা মানুষটি বলছে, ওটি মা, তাই বড়!
তাহলে পাশের দুটি কি বাচ্চা?
হ্যাঁ আম্মু! মায়ের দু পাশে দু বাচ্চা!
এই আম্মুটা কে? কাদের আম্মু?
এই আম্মুটা আমাদের দেশ আর ছোট দুটি হচ্ছি আমরা সব মানুষ!
মনু মিয়ার খুব কষ্ট হয় এই ভেবে যে, এতটুকুন একটি শিশু যা ভাবতে পারে তা তার মত ধাড়ী পুরুষের বোধে আসে না কেন? মূর্খ বলেই কি? আর তখনই যেন তার কাছে শহিদ মিনার, অগণিত নর-নারী-শিশুর ফুল নিয়ে এখানে ছুটে আসার রহস্য দিনের আলোর মতই পরিষ্কার হয়ে যায়।
শহিদ মিনারের সামনে আসতেই তার কেমন শিহরণ লাগে। নিচু হয়ে ভাষা শহিদদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত অগ্রবর্তী জনতার ফুলের স্তুপে নিজের হাতের ফুল দুটি রাখতেই পুরো দেহ কেমন কেঁপে ওঠে থরথর করে। মনে হয় ভাষার জন্যে নিজেদের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন যাঁরা, তাদের গর্বিত আত্মার খুশি, মানুষের মনে এখনো যাঁদের জন্যে অফুরন্ত ভালোবাসা বিদ্যমান সেই আনব্দ যেন ছুঁয়ে গেল তাকেও। শহিদ মিনার ছাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় চোখ দুটো বারবার ভিজে উঠতে লাগলো। আর সে অবস্থাতেই সে রহমান সাহেব ও সালমা বেগমকে খুঁজতে খুঁজতে পাশের রাস্তা দিয়ে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকেই এগিয়ে যেতে থাকে। চলতে চলতে তার মনে হয় ঠিক পথে যদি সে এগিয়ে যেতে পারে তাহলে যেখানে ঘোড়ার গাড়িটা ছেড়ে এসেছে, সেখানে পৌঁছে যেতে পারবে সহজেই।
(চলবে)
অনেকদিন পর মিয়াভাইয়ের লেখা পড়লাম। জুলিয়ানভাই একটা জিনিসে কিরাম জানি প্যাচ লাগি গেলো। মনুমিয়া ঘোড়ারগাড়ি চালকের কাছে জানতে চান সবাই ফুল নিয়ে কোথায় যাচ্ছে......পরে আবার মনুমিয়ার নিজের হাতে ফুল(...জনতার ফুলের স্তুপে নিজের হাতের ফুল দুটি .......) দেবার ব্যাপারটা, (মানে কিছু যেন মিসিং)..ঠিক পরিষ্কার হলো না আমার কাছে। আমার বুঝবার ব্যর্থতা হয়ত। '.....আইজকা তুমি আমি উর্দুতে কথা কওন লাগতো' এই জায়গাটা একটু দেখবেন ভাইটি? পরের পর্ব দিতে বেশি সময় দিয়েন না গো। ভালো থাকবেন।
জুলিয়ান ভাই, অনেক ভাল পাঠক আপনার লেখা পড়ছে। আমি একা নই।
চলুক, পড়ছি। এই পর্বে গতি একটু কমে গেছে মনে হয়।
চলুক। এত দেরী হলে চলবে না।
পড়ছি দাদা জানিয়ে গেলাম।
মন্তব্য করুন