জীবিকা অথবা জীবন- ১১, ১২, ১৩
১১
সেদিন শহিদ মিনার থেকে ফিরে আসার পর মনু মিয়ার জীবনটা যেন আরো জটিলতার ঘেরাটোপে আটকে গেল। সবার আগে ঘোড়াগাড়ি থেকে নেমে গেটে ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে কেমন হুটোপুটির শব্দ ভেসে আসে। সে যেন মৃদু কথাবার্তাও শুনতে পেলো বলে মনে হলো। তাই সে আরো জোরালো আর দ্রুত শব্দ তোলে গেটের ধাতব পাতে। সেই সঙ্গে খানিকটা চিৎকার করে ডেকে ওঠে, আজগর বাই! ওই আজগর বাই! হুনছেন
খানিক পর আজগর গেট খুলে সবাইকে একই সঙ্গে দেখতে পেয়ে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তরা আইতে না আরো দেরি হওনের কথা আছিলো? কথা বলার সময় জিভের আগায় শব্দগুলো যেন জড়িয়ে যায় আজগরের।
পেছন থেকে সালমা বেগম ধমকে উঠে আজগরকে বললেন, এতক্ষণ কি করতাছিলি?
আজগরকে অকস্মাৎ দিশেহারা মনে হয়। কেমন এক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে
সালমা বেগম তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে রুমে উঁকি দিয়ে বেশ অবাক হয়ে গেলেন। দরজার একটি কপাটের আড়ালে নিচের দিকে নেইল পলিশ রাঙানো দুটো পায়ের আঙুল দেখতে পেয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ওই ছেরি বাইর হ!
সালমা বেগমের কথার সঙ্গে সঙ্গে রহমান সাহেব ছুটে এলেন, কি অইছে?
মেয়েটি মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসতেই তাকে দেখতে পেয়ে রহমান সাহেব বলে উঠলেন, তুই বেকারির চকিদারের মাইয়া না? এহানে কি করতাছস?
কিছু হুনবার কাম নাই! এক্ষনি দুইটারে বাইর কর! সালমা বেগমের মুখটা যেন আগুনের তাপে লালচে হয়ে উঠেছে এমন দেখাচ্ছিলো।
রহমান সাহেব আজগরের দিকে ফিরে বললেন, কিরে আজগইরা, হুনছস? তর কিছু কওনের থাকলে কইতে পারস!
আজগর একবার মাথা তুলে সালমা বেগমের দিকে তাকায়। তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে, মুস্কান, বাহার আ যা!
মেয়েটি গেটের বাইরে গুটিগুটি পায়ে চলে গেলে সালমা বেগম রহমান সাহেবকে বললেন, এখনই বাজারে যাও। গেইটের লাইগা নতুন তালা-চাবি নিয়া আহ গা! মনু মিয়ারে কও বদমাইশটার যা যা আছে সব বাইরে ফালাইতে! আমি গেলাম!
সালমা বেগম হনহন করে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন। সেই অবসরে রহমান সাহেব বললেন, আজগর, দেখ তর কিকি আছে।
আজগর রুমটিতে ঢুকে তার কাপড়-চোপড় যা আছে তার সবই একটি পুটলি মতন বানিয়ে বেরিয়ে আসে। হাতের মুঠো থেকে একগোছা চাবি ঝনাৎ করে ছুঁড়ে ফেলে মনু মিয়ার পায়ের সামনে। তারপর যেতে যেতে বলে, আবার দেহা অইবো!
মনু মিয়া ঘটনার আকস্মিকতায় বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে, রহমান সাহেব বললেন, তুই ভিতরে যা। গেইট বন্ধ কইরা দে! আমি বাজারে যাইতাছি!
বাড়ির ভেতর থেকে গেট বন্ধ করে দিলে শুধু শুধু একজন পাহারাদার সেখানে বসে থাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না মনু মিয়ার। বাড়ির ভেতরকার মোটামুটি অনেক কাজই সে করে। তা ছাড়া তাদের এখানে লোকজন বলতে গেলে কেউ আসে না। মাঝে মধ্যে শৈলেশ বর্মন আসেন রহমান সাহেব বা সালমা বেগম কেউ অসুস্থ থাকলে।
গেট বন্ধ করে দিয়ে মনু মিয়া আজগরের থাকার ঘরটিতে প্রবেশ করলে একটি বিশ্রী গন্ধ টের পায়। তারপর দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে ঘরটির চারদিকে তাকায়। চকির নিচে উবু হয়ে দেখে। প্রায় দেওয়ালের পাশ ঘেঁষে বেশ কটি বোতল দাঁড় করিয়ে রাখা। সে চকির ওপর হামাগুড়ি দিয়ে উঠে চকির প্রান্ত আর দেওয়ালের ফাঁকা অংশে হাত গলিয়ে দিয়ে একটি বোতল তুলে আনে। কিসের বোতল বুঝতে না পেরে বোতলের মুখটা নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোঁকে। ঠিক এমন আরো কড়া একটি গন্ধ ভাসছে রুমটির ভেতর। সে চকি থেকে নেমে গন্ধের উৎস সন্ধানে ফের ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আরেকটি খোলা দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারে সেখান থেকেই গন্ধটা ছড়াচ্ছে। পাহারাদারের জন্য তৈরি টয়লেট বাথরুম। দরজার আড়ালে উঁকি দিতেই একই রকম আরেকটি বোতল দেখতে পায় সে। বোতলটিতে বেশ খানিকটা তরল পদার্থ আছে। কিন্তু বোতলটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারে না জিনিসটা কি!
আজগরের পরিত্যক্ত সমূদয় জিনিসপত্র একখানে জড় করে বিছানা থেকে চাদরটা মেঝেতে বিছানোর সময় তার চোখে পড়ে একটি কালো ক্লিপ পড়ে আছে। ক্লিপটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে সে। ঠিক তখনই তার মনে পড়ে একদিন দোকান বন্ধ দেখে একে ওকে জিজ্ঞেস করে খুঁজতে খুঁজতে বালতি কারখানার পেছনে ইসুব মিয়ার ঘরে উপস্থিত হয়েছিলো সে। দরজার পাশে আগে পিছে বসে শাড়ি পরা দুটো মেয়ে। পেছনের মেয়েটি সামনে বসা মেয়েটির চুল বেঁধে দিচ্ছিলো।
তাকে দেখতে পেয়ে পেছনে বসা মেয়েটি বলে উঠলো, কারে চাও?
মনু মিয়া মেয়েটির পরিপাটি করে বাঁধা চুলে লাগানো কালো চকচকে ক্লিপগুলোর দিকে তাকিয়ে বলেছিলো, ইসুব কাহার ঘর কোনডা? দোহান বন্ধ কিয়ারে?
মেয়েটি বলেছিলো, আব্বায় তো মোগো গ্যারামের বাড়িত গেছে?
তুমি কোমনে থাইক্যা আইছো? আব্বার কী কাম?
মনু মিয়া হাতে ধরা ডিমের পুটলিটা দেখিয়ে বলেছিলো, ডিমা লইয়া আইছি। কয়দিন পরে পরেই আমি দোহানো আইয়া ডিমা দিয়া যাই। আউজ্জা দেহি বন্ধ!
মেয়েটি বললো, মোর দারে দিয়া যাও। আব্বায় আইলে কইমুয়ানে!
মনু মিয়া হাতের পুটলি এগিয়ে দিতে দিতে বলেছিলো, কুড়িডা আছে!
ডিমগুলো নিয়ে ঘরের ভেতর যেতে গিয়েও কী মনে করে হটাত মেয়েটি থেমে পেছন ফিরে তাকিয়েছিলো। খানিকটা লজ্জা মেশানো কণ্ঠে বলে উঠেছিলো, তোমার নাম কি মনু মিয়া?
মেয়েটির মুখে নিজের নাম শুনতে পেয়ে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো মনু মিয়া। আর তখনই তার মনে হয়েছিলো মেয়েটির রঙ ময়লা হলেও দেখতে খুব সুন্দর!
মনু মিয়ার চোখে মেয়েটির চোখ পড়লে সে হেসে উঠে বলেছিলো, আব্বায় চাইর দিন পরে আইবে!
চারদিন পেরিয়ে গেছে আরো দুদিন আগে। ইসুব মিয়ার দোকানে আর যাওয়া হয়নি মনু মিয়ার। সে ক্লিপটি আজগরের পরিত্যক্ত জিনিসপত্রের সঙ্গে চাদরের ওপর রাখে। খুঁজে খুঁজে আরো কাগজ, ছেঁড়া ন্যাকড়া, চকিতে বিছানো নানা জায়গা থেকে বেরিয়ে আসা তুলোর ঝালর সমৃদ্ধ ছেঁড়া-ফাটা তোশকটা গুটিয়ে তুলে নিয়ে চাদরটার চার কোণা গুটিয়ে একটির সঙ্গে আরেকটি গিঁট দিয়ে বেশ বড়সড় একটি গাঁটরি বাঁধে। তারপর সেটাকে তুলে বাইরে এনে ফেলে রাখে। ভাবে, রহমান সাহেব এলে এটাকে বাইরে ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলে দিয়ে আসবে। আর তখনই ফিরে আসার পথে ইসুব মিয়ার সঙ্গে দেখা করবে। তার আগে পুরোটা ঘর ধুয়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। এখন থেকে হয়তো এটাই হবে তার থাকার জায়গা।
১২
বেশ কিছুদিন হয় রহমান সাহেব হাঁটুর ব্যথায় তেমন একটা চলাফেরা করতে পারেন না। তাই প্রতিদিন সকালের কাজগুলো সেরে তাকে বাজারের দিকে ছুটতে হয়। বাজারে যাওয়ার পথে একটি চায়ের দোকানে বসে থাকতে দেখা যায় আজগরকে। মাঝে মধ্যে দু চারদিন তাকে দেখা যায় না। তখন কোথায় যায় আজগর? তা ছাড়া বাড়ির পাহারাদারের চাকরি হারানোর পর আজকাল কেমন করে কাটছে তার দিনকাল তা খুব জানতে ইচ্ছে হয়। পাউরুটি কারখানার চকিদারের মেয়ে মুস্কানকে সে বিয়ে করতে পেরেছে কি না বা মুস্কানের ঘটনা জানার পর থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তার বাবা কোথায় গেছে তাও খুব জানার ইচ্ছে তার। মামা যাদু মিয়াও অনেকদিন হলো এদিকে আসছে না। বাজার থেকে ফেরার পথে একবার পাউরুটি কারখানা হয়ে আসতে মনস্থ করে সে।
বাজারের মুখেই বেশ একটি জটলা দেখা যাচ্ছে। অনেক লোকজন কোনো কিছুকে কেন্দ্র করে গোল হয়ে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। এসব ভিড়-ভাট্টা থেকে দূরে থাকতে বলেছেন রহমান সাহেব। কিছু কিছু পকেটমার তাদের সুবিধা মত জায়গায় এ জাতীয় আয়োজন করে থাকতে পারে। আর এ ধরনের প্রতিটি জমায়েত থেকেই লোকজন টাকা-পয়সা খোয়ানোর কাহিনী প্রায় একই রকম।
ভিড়টাকে পাশ কাটিয়ে বাজারের ভেতর ঢুকে পড়ে প্রথমেই শাক-সবজি-আনাজ-পাতির হাটে একটি চক্কর দেয় মনু মিয়া। কী কী তরি-তরকারি এসেছে তা দেখে যায় মাছ বাজারের দিকে। সেখানে ঘুরে-ফিরে মনে মনে মাছ পছন্দ করে ফের চলে আসে সবজি বাজারে। কম পরিমাণে কয়েক পদের আনাজ কিনে নিয়ে সে এগিয়ে যায় মাছ বাজারে। প্রায় তার বুক সমান দীর্ঘ একটি চিতল মাছ লম্বালম্বি ফেলে রাখা হয়েছে দুটি বড় বড় ডালা পাশাপাশি রেখে। মাছটা দেখে তার চোখ যেন চকচক করে ওঠে।
অনেক কাল আগে সে যখন ছোট তখন রায় বাড়ির দীঘিতে এর চাইতেও খানিকটা বড় আকৃতির চিতল মাছ ধরা পড়েছিলো। সেই তখন থেকেই তার মনে একটি বাসনা জেগে উঠেছিলো যে, কখনো সুযোগ পেলে এমন বড় মাছের ছোট্ট একটি টুকরো হলেও খেয়ে দেখবে। তারপর আর সুযোগ হয়নি। একবার শীতলক্ষ্যার পাড়ে একটি ভাতের হোটেলে চিতল মাছের পেটি দিয়ে ভাত খেয়েছিলো। আকৃতিতে ভাতের থালার সমান ছিলো। মাছের বড় টুকরো দেখে খুশি হলেও রান্না ভালো ছিলো না বলে তার মনের আক্ষেপ দূর হয়নি। এখন সে নিজেই খুব ভালো রান্না জানে। টাকায় কুলোলে সে আজই তার মনের অতৃপ্তি দূর করতে পারবে। কিন্তু তার মনের ভেতর প্রায় আবছা মতই আরেকটি ভাবনা দুলে ওঠে। মনে পড়ে মায়ের কথা। বোনটির কথা। তবে তেমন একটা খারাপ লাগে না তার। সংসারের বড় অভাবটা দূর হয়ে গেছে। খাওয়া-পরায় তাদের সমস্যা থাকার কথা না। একবার যদি গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারতো তাহলে তার মনের এই ছটফটে ভাবটা আর থাকতো না। কিন্তু বুড়ো-বুড়ির দিকে তাকালে সে কথা উত্থাপন করার সাহস হয় না তার।
আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ডালার পাশে গিয়ে মাছটির দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকলে মাছ বিক্রেতাটি বলে উঠলো, নিবা? আরো কয়েক জন ভাগীদার আছে!
আজকের মাছের জন্য নির্ধারণ করা আছে তিন টাকা। খুব বেশি হলে পাঁচ টাকা। মাছের পেছনে এর বেশি যেন কিছুতেই খরচ না হয়, সালমা বেগম বেশ কড়া কণ্ঠে বলে দিয়েছেন। বলতে গেলে সে আর রহমান সাহেবই মাছ খায়। কোনো কোনো দিন দুজনের কেউই মাছে হাত লাগান না। তখন তাকেই খেয়ে শেষ করতে হয়। সে গ্রামের ছেলে বলে মাছ আনাজ-পাতির তরকারি ততটা ভালো লাগে না। তার ভালো লাগে মুরগি আর গরুর গোস্ত। কিন্তু অনেকদিন হয় তারা মাংস খান না। তবে সে ইচ্ছে করলে যে কোনো আকৃতির একটি মুরগি কেটে রান্না করে খেতে পারে। কেউ মানা করবে না। একা একা ভালো কিছু খেয়ে আনন্দ নেই বলে তেমনটি করে না সে।
প্রয়োজনীয় তরকারি কেনার পর তার কাছে এখন আট টাকা চার আনা আছে। সে মনে মনে ঠিক করলো যে, এ টাকায় মাছের ভাগ যদি পায় নিয়ে যাবে। নিজের মনোমতো কাজ করার শাস্তি হিসেবে খানিকটা ধমক ধামক শুনতে হতে পারে। যাবতীয় ভাবা ভাবি আর হিসেব নিকেশ শেষ করে এক সময় সাহস করে সে বলে ফেললো, ভাগ কত ট্যাহা কইরা পড়তারে?
মাছ বিক্রেতাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা আরো কয়েক জনের দিকে আঙুল তুলে লোকটি বললো, মাছের দাম আশি ট্যাকা। তুমি নিলে দশজনের আট ট্যাকা কইরা পড়বো!
ভাগীদার দশজন। তাইলে পেডির ভাগ দশটা অইবো? এমন একটি ভাবনা আসতেই মনু মিয়া মনে মনে দৃষ্টির পোঁচে মাছের পেটির অংশটা দশটি টুকরো করে। আর এতে মোটামুটি সন্তুষ্ট হলে সানন্দেই সে বলে উঠলো, তাইলে নিতাইরাম!
মনু মিয়ার কথা শুনে অন্যান্য ভাগীদারদের মুখগুলোও কেমন যেন চকচকে হয়ে ওঠে। লোকগুলোর ঘরেও কি খাওয়ার মানুষ কম? ইচ্ছে করলে চারজনেই নিয়ে নিতে পারতো পুরো মাছটি। যৌথ পরিবার হলে হয়তো এ মাছটি দিয়েই দু তিন বেলা হয়ে যেতে পারতো। তা ছাড়া মানুষ বড় মাছ খায় শখে। আর শখের খাবার পরিমাণে বেশিই লাগে। এদের সবাই হয়তো একক আর ছোট পরিবারের মানুষ। কিন্তু পোশাক-আশাক দেখে তো তেমন অভাবী বলে মনে হয় না। তাহলে কি খাওয়ার মত লোকজন না থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
লোকটি দু হাতে পাঁজা কোলে তোলার মত করে মাছটি তুলে ধারালো বটির উপর ফেলতেই ঘ্যাঁচ করে একটি শব্দ হয়ে মাছটি আটকে গেল। তখন গোল মতো একটি কাঠের মুগুর দিয়ে মাছটির গায়ে আঘাত করতেই সেটি দু টুকরো হয়ে ডালার ওপর দুদিকে পড়ে গেল। তারপর আনুমানিক একটি সমান মাপে বটির ওপর ফেলে মুগুরের আঘাতে টুকরো টুকরো করে ফেললো মাছটিকে। তারপর ডালার ওপর দশটি ভাগ সাজিয়ে লোকটি বললো, দেখেন সমান হইছে নাহি? নাইলে পাল্লি-বাটখারা দিয়া মাইপ্যা দেওন যাইবো!
তিনজন একই ভাগের দিকে আঙুল তাক করলে লোকটি হেসে উঠে বললো, এই ভাগাটারে আবার তিন ভাগ করতে কন?
মাছ বিক্রেতার কথায় যেন তিনজনেরই হুঁশ ফিরে আসে। তখন তারা মনু মিয়াকে দেখিয়ে দিলে প্রথম ভাগাটি থেকে দুহাতে মাছের টুকরোগুলো তুলে মনু মিয়ার মেলে ধরা থলের মুখে ঢেলে দিতে থাকে মাছ বিক্রেতা।
পাশ থেকে একজন বলে উঠলো, এক ভাগায় কতটুকু ওজন হতে পারে?
মনু মিয়াকে মাছ দিয়ে টাকা নিতে নিতে লোকটি জানালো, দুই সেরের বেশি ছটাক খানেক হইবো। এর কম না!
মনু মিয়া মাছের দাম পরিশোধ করে ফেরের তাগিদে দ্রুত বাজার থেকে বের হয়ে আসে। দূর থেকেই চায়ের দোকানটিতে বসা আজগরকে দেখতে পায় সে। তার দৃষ্টি এড়াতেই সে আরো খানিকটা দূর দিয়ে কোনো দিকে মনোযোগ নেই এমন ভান করে দ্রুত পদক্ষেপে হাঁটতে থাকে। কিন্তু আজগরের দৃষ্টি থেকে নিজকে আড়াল করতে পারে না। অন্যান্য দিনগুলোর মতই তাকে দেখতে পেয়ে আজগর চেঁচিয়ে উঠলো, অই কুমিল্লার ইতর! হুইনা যা!
রাগে মনু মিয়ার চোয়াল শক্ত হয়ে এলেও সে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে পথ চলতে থাকে। এখন উলটো ফিরে গিয়ে আজগরের সঙ্গে বিতর্কে জড়ানো ঠিক হবে না। সে হয়তো মনে-প্রাণেই চাচ্ছে যে, মনু মিয়া ক্ষেপে গিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া করুক। কিন্তু তাকে এখন এমন সুযোগ দেওয়াটা চরম হঠকারী হয়ে যাবে।
কাটার পর খুব অল্প সময়ের ভেতরই মাছ পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই মনু মিয়া মনে মনে ঠিক করে ফেলে যে, এখন কোনো অবস্থাতেই তাকে থামা চলবে না।
১৩
বড় মাছে চর্বির মত তেল থাকে। যা অনেক সময় বয়স্ক মানুষের হজম শক্তিকে এলোমেলো করে দিতে পারে। তাই যাতে পেটের জন্যে কোনো সমস্যা না হয় তার জন্য সে অল্প মশলা মাখিয়ে খানিকটা সিরকাও মিশিয়ে দেয়। এই সিরকার ব্যাপারটা সে শিখেছে সালমা বেগমের কাছ থেকেই। কেবল মাংস রান্নার সময়ই তিনি সিরকা ব্যবহার করেন। পরীক্ষামূলক ভাবে মাছের সঙ্গেও সে ব্যবহার করেছে। রহমান সাহেব বা সালমা বেগম কিছুই বুঝতে পারেননি। তবে রান্নার সু-স্বাদুতার কথা বলতে কার্পণ্য করেন নি। সেই থেকে মাঝে মাঝে সে মাছের তরকারিতেও সিরকা ব্যবহার করে।
বাজার থেকে ফিরেই সে মাছ রান্না করতে লেগে যায়। কিন্তু দুপুর বলতে দেড়টা দুটোর সময় খেতে গেলে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভালো লাগবে না। তাই বাজার থেকে ফিরেই সে মাছের তরকারি হলে রান্নাটা অর্ধেক রেঁধে রেখে দেয়। খাওয়ার সময় হতে থাকলে চুলোয় ভাত চড়িয়ে দিয়ে অর্ধেক রান্না করা তরকারিটাও চুলোয় চড়িয়ে দেয়। আজ খাওয়ার সময় দুজনেই চমকে যাবেন বড় মাছ দেখে। পেট খারাপের ভয়ে খেতে চাইবেন না হয়তো। তবু রান্নাটা ভালো হলে অনেকেই পেটের সমস্যার কথা ভাবেন না। প্রতিদিন সু-স্বাদু রান্না খুব কমই জোটে মানুষের জীবনে।
মশলা দিয়ে কষানোর পর মাছের টুকরো থেকে বেরুনো পানিটা শুকিয়ে যেতেই সামান্য পানি ঢেলে দিয়ে হাঁড়িটা ঢেকে দেয় মনু মিয়া। তারপর গামছায় হাত মুছে চুলোর আগুনের আঁচ কমিয়ে দিতে স্টোভের কেরোসিনের ট্যাঙ্কটার হাওয়া কিছুটা ছেড়ে দিতেই আগুনের তেজ কমে এলো। ঠিক তখনই সালমা বেগম রান্না ঘরের দরজায় এসে বললেন, বাজার থাইকা ফিরলি কখন?
সালমা বেগমের দিকে ফিরে মনু মিয়া বললো, অনেক ক্ষণ!
তো ফেরত আওয়া ট্যাকা-পয়সা দিলি না?
সব খর্চা অইয়া গেছেগা!
কস কি?
আউজ্জা খরচ বেশি অইছে।
বেশি হইলো কেন?
বড় মাছ আনছি!
তার লাইগ্যা এত সকাল সকাল রান্ধা চড়াইছস? গেটটা খোল যাইয়া। ডাক্তার আইতাছে।
মনু মিয়া ভেবে পায় না যে, প্রত্যেকবার রহমান সাহেব নয়তো সালমা বেগম তাকে বলেন ডাক্তার আসবে। কিন্তু খবরটা পায় কীভাবে?
মনু মিয়া বেরিয়ে গেলে সালমা বেগম চুলায় চড়ানো হাঁড়িটার ঢাকনা খুলে দেখলেন। চশমা চোখে না থাকায় বুঝতে পারলেন না যে, কী মাছটা রান্না হচ্ছে। তবে, রান্নাটা যে বেশ ভালো হচ্ছে তা ঘ্রাণেই বুঝতে পারলেন।
সালমা বেগম রান্না ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন, শৈলেশ বর্মণ কাঁধে একটি শান্তিনিকেতনী ব্যাগ বইছেন। মনু মিয়ার সঙ্গে হেসে হেসে কী নিয়ে কথা বলছেন যেন। হাতের কালো চামড়ার ব্যাগ ছাড়া এমন ব্যাগ কাঁধে তাকে কখনো দেখা যায়নি। তাই ভদ্রলোককে কেমন যেন লেখক লেখক দেখাচ্ছে আজ। আর এ কথা মনে হতেই স্মৃতিতে ভেসে উঠলো সহপাঠী আরিফের কথা। আরিফও এমন ব্যাগ কাঁধে ক্লাসে আসতো। অন্য সময় যখনই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে কাঁধে ব্যাগ ছাড়া দেখেছেন বলে মনে পড়ে না। আরিফ কবিতা লিখতো। কিন্তু কবিতা কোথাও ছাপা হচ্ছিলো না বলে, ঝাঁপ দিয়েছিলো ট্রেনের নিচে। সুইসাইড নোটে নাকি লিখে গিয়েছিলো, কবি হতে না পারার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়! আজকাল মাঝে মধ্যে আরিফের কথা মনে হলে তার মৃত্যুটাকে প্রাণের অপচয় ছাড়া ভিন্ন কিছু ভাবতে পারেন না।
শৈলেশ বর্মণ সালমা বেগমকে দেখতে পেয়ে বললেন, শুনলাম আজ রান্ধা ভালো। দুপুরে এখানে খাইয়াই পল্টনে যামু ভাবতাছি।
খাইলে খাইলেন! কিন্তু অবেলায় পল্টনে কি?
আইজকা শেখ মুজিবের ভাষণ আছে। যাবি নাকি?
যাইতে তো মন চায়। কিন্তু আপনের দোস্ত যে হাঁটুর ব্যথায় বিছনা থাইক্যা নামতে চায় না।
নমাজ পড়ে কেমনে?
নমাজ তো পড়ে না।
শৈলেশ বর্মণ হেসে বললেন, আরে, শেখ মুজিবের কথা হুনলে দেখিস কেমনে ফাল দিয়া ওঠে!
তারপরই তিনি, কইরে রহমান? বিছনায় পইড়া থাকবি আর কত দিন? বলতে বলতে রহমান সাহেবের উদ্দেশ্যে ড্রয়িং রুমের দিকে চলে গেলেন।
মনু মিয়া রান্নাঘরে ঢুকতেই সালমা বেগম বললেন, কী মাছ আনছস?
মনু মিয়া উজ্জ্বল মুখে জানালো, চিতল!
সালমা বেগম অবাক হয়ে বললেন, এত ট্যাকা পাইলি কই? যেমন টুকরা দেখলাম না হইলেও পঞ্চাশ-ষাইট ট্যাকা দামের হইবো।
ভাগা আনছি। আট ট্যাহা কইরা ভাগা!
সালমা বেগম যেন আরো বেশি অবাক হলেন মনু মিয়ার কথা শুনে। বললেন, ভাগা? গুঁড়া মাছ ভাগা দিয়া বেচে হুনছি। তাই বইলা বড় মাছও?
বড় মাছ বেচা না অইলে কাইট্যা ভাগা দিয়াই বেচে।
সালমা বেগমের মনে হলো, মানুষ আগের তুলনায় বেশ অভাবী হয়ে গেছে। পুরো মাছ কেনার সামর্থ্য নেই বলে কয়েকজনে মিলে ভাগ করে নিয়ে যায়। দেশের মানুষের দুর্দিন কি তাহলে খুব কাছেই?
বিষণ্ণ মনে তিনি একবার মাথা ঝাঁকালেন। তারপর বললেন, তাইলে রান্ধা শেষ কইরা ফালা তাড়াতাড়ি। পল্টন গেলে খাওয়া দেরি করা ঠিক হইবো না।
সালমা বেগম রান্না ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে যেতে যেতে শুনতে পেলেন, ড্রয়িং রুমে কোনো একটি বিষয়ে বেশ উচ্চ কণ্ঠে হাসছেন রহমান সাহেব।
(চলবে)
অনেকদিন পর যদিও কিন্তু খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ
ধন্যবাদ বুজি!
অনেক দিন পর... অপেক্ষায় ছিলাম
অপেক্ষায় থাকেন বইলাই আলসেমী করতে ভরসা পাই
ভালো থাইকেন।
সালমা বেগম আর রহমান সাহেব এগিয়ে চলুক।
চলুক। এতো দিন পর যে?
অ-নে-ক-দি-ন পর! আগের পর্বগুলা আবার পড়তে হবে। এবার আবার নিয়মিত হোন। চলুক সিরিজ।
বুজি, সময় কম। ইট্টু ফ্রি হইয়া নেই!
মন্তব্য করুন