মনুসাহিত্য : হাগজ মনে করিলে বেপদ
বহুদিন পরে ধরা খেয়ে গেছি। কবি ফেরদৌস নাহার আবিষ্কার করে ফেলেছে—আমি বরিশাইল্যা। লিখেছে, এইবার, অ মনু—যাইবা কুনহানে?
যাব কই? যাওয়ার কি উপায় আছে? নাহারের কথা সত্যি। আবার কিছুটা মিথ্যেও বটে।
আগে মিথ্যেটা বলি। আমার মা অতি সাদাসিধা। মনে কোনো অন্ধিসন্ধি নাই। বাল্যকাল থেকে পই পই করে বলেছে, অ খোকন, উত্তরে যাবা, পূবে যাবা—পশ্চিমেও যাইতে পার। কিন্তু দক্ষিণে? নো--। নেভার। কদাপি নহে।
দক্ষিণ হল চন্দ্রদ্বীপ—বরিশাল। যাত্রা নাস্তি। যেখানে বাঘের ভয়—সেখানে রাত পোয়ায়। কপাল মুচকি হেসে সেই চন্দ্রদ্বীপেই পাঠিয়ে দিল। সে এক ট্রাজেডি বটে। নতুন চাকরি। এক বিশেষজ্ঞ বন্ধুস্বজন এল ভয় ভাঙাতে। যাত্রার দুদিন আগে সদর ঘাটে নিয়ে গেল।সদরঘাটে মানুষ কিলবিল করে আসছে—আর যাচ্ছে। বন্ধু হাসি হাসি করে বলল, দ্যাখছ?
--কী?
--কি আবার! লঞ্চ।
এমভি সাগর পরিবহন। নদীর জন্য সাগরের হাতির ব্যবস্থা--জলহস্তি। জল কপোত। রাজদূত। দ্বীপরাজ। কোকো। বেশ বড় সড়। বুড়িগঙ্গার বক্ষ বরাবর লঞ্চের লেজ ঠেকেছে। তিনতলা—চারতলা। বন্ধু বলল—কীরে, এখনো ভয় আছে?
ভয় করার কোনো কারণ নেই। শীতলক্ষ্যা ছেড়ে যখন চানপুর এল—চারিদিকে ঘোর অন্ধকার। কিছু মালুম হয় না। মাঝে মাঝে ঢেউয়ের উপর আলো ঝলক মেরে যাচ্ছে। শাকিরার মত ওয়াকা ওয়াকা গানে কেঁপে কেঁপে উঠছে লঞ্চ। জানালা দিয়ে ছলকে ঢুকছে ঠাণ্ডা জল। আমার সহযাত্রী বীরেণদা চিৎকার করে উঠল, গেছি। গেছিরে।
তিনি যে কোথায় গেছেন বোঝা গেল না। চারিদিকে শো শো শব্দ। আর শতসহস্র সর্প-নাসিকা গর্জন। এর মধ্যে একটি রাত্রিভর কখনো বীরেণদার হাত, কখনো পা, কখনো মাথা, কখনো মুখ—চোখ, কোমর ঝাপটে ধরে ধরে রাখতে হল।বীরেণদার সেই দীর্ঘবাদনের মত গেছি গেছি করে সত্যিই যখন ‘গেছি’ হয়ে গেছি--তখন সূর্যদেব সবে উঁকি দিচ্ছেন।একদম ফ্রেস।বেশ ডগো মগো।দুজন লোক পাশে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। উঠে পড়ল। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে পড়ল, ও মনু—আইসা গেছে?
--কোথায়?
--যেখানে যাইবার চাও।
--কুনহানে?
--যাইতে শ্যাল আর আইতে শ্যাল
হ্যার নাম বরিশ্যাল।
জলবৎ তরলং। বীরেণদা এরপর হাসতে হাসতে চাঁদে গিয়েছিল। সে এক মহাউপাখ্যান। পরে একদিন হবে।
এবার সত্যি গল্পটা বলি।
তখনো তো বোতলের দিন আসে নি। হাড়িতে করে হাড়িয়া খেতে হত। বোতল বিনা মনুষ্যচরিত ছিল ধোয়া তুলসীর পাতা। এজন্য তখনো কোনো ধর্মগ্রন্থ নাজেল হয় নি। এরশাদও পয়দা হয় নি। এরকম এককালে আকাশের চাঁদ মাঝে পৃথিবীতে নেমে আসত। চাঁদ তো নয়—ঝকমকা চন্দ্র। এলাকাটির নাম চন্দ্রঘটিত চন্দ্রদ্বীপ। এই চন্দ্রদ্বীপের একটি গ্রামের নাম হত—চাঁদকাঠি। এই চাঁদকাঠির চাঁদুবাড়ির কাচারি ঘরে একদিন খুব জলতেষ্টা পেয়েছিল।বহুক্ষণ চেপে চুপে বললাম, জল।
কে একটা মেয়ে আড়াল থেকে হেসে উঠল। বলল, অ মা, এহন জল আইল কুনহানে। এহনতো ভাটা।জোয়ার আইলে জল আহে।
--না, না। জল খাব।
--জল খাইবেন ক্যান? দাঁত নাই নাকি?
এইবার মুখব্যাদান করে প্রমাণ দিতে হল—দাঁত আছে। মাত্র চারটে কম।ওটা ডাক্তারের কম্ম। ফি হিসাবে নিয়ে গেছে। মহা মুশকিল। শরমে উর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল।
জল খেতে হলে নদীতে যেতে হবে। ঝিঁঝিঁ আর শিয়ালের ডাকের মধ্যে? এই রাতে? ভেবে তেষ্টা উবে গেল। মধ্য রাতে গায়ে টুক টুকি দিয়ে ঘুম ভাঙাল সেই মেয়ে। হাতে হারিকেন। কপালে ঘাম। কোমরে আচঁল পেচানো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এই ন্যান। আপনের জল।
টেবিলের উপরে ঝকঝকে অসংখ্য কাঁচের গ্লাস। কোনটায় লাল জল। কোনটায় হলুদ। ঘোলাটে, কালচে। ডালিমের মত টসটসে জলও আছে। ফুটফুটে জল। অসংখ্যা জল। পুরো জলের ফ্যাশন শো।ক্যাট ওয়াক নয়। টাইগার ওয়াক।হালুম।গেলুম রে বাবা, গেলুম। কাকে রেখে কাকে দেখি। চক্ষু চড়ক গাছ।
--খায়েন!
--কোনটা খাব?
--আপনের জেডা মন চায়। লাল জল—আর্সেনিক টিউকল। হলদেটা—আয়রণী টিউকল। ফুটফুটে জল—ডিপের। কালাডা—পুহরের। প্যাকপ্যাকে—ব্যাড়ের। ঘোলাডা—নদীর। কুটকুটে—ডাবের।… জয় ব্যোম ভোলা বলে ডিপ টিউকলের জল মুখে দিতেই নামিয়ে রাখতে হল। বললাম, আরেক গ্লাস ডিপের জল দ্যান।
মেয়েটি এনে দিল। মুখে দেই। জিবে ছুইয়েই নামিয়ে রাখি। আর মেয়েটি আরেকটি গ্লাস এনে রাখে। এইভাবে টেবিলটি ভরে গেল।জলময়। মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে বলল—এত জল চান ক্যান? খানও তো না! ঘটনা কি?
--খাব কি করে? লবণ মিশিয়ে আনছেন কেন?
--ডিপকলের জলে লবণ পাইলেন কুনহানে? লবণ তো আছে নদীর জলে। যদি কন—আইনা দিমুআনে।
আহা, এই মোটা লোকটার নাম যদি হয় চিকন আলী, তাইলে মোটা লোকটা না জানি কী আকারে! রইক্ষে কর মা জগদম্বা!
ডিপ টিউকলের জলই সই। নো নোনতা। চিনির লাহান মিডা।পাণির পানি বলে কথা।বিনা পানে উপায় আছে!
আমাকে রক্ষা করতে আমার মা জননী একদিন দক্ষিণ দেশে চলে এল। রীতিমত উন্মাদ দশা। আমাকে যে বাঘে খায় নি, কুমোইরে খায় নি, বা ডাইনীতে কাঁচা গেলে নি—দেখে তার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। রক্ষাকালীর উদ্দেশ্যে পাঁচসিকে মানত করে বসল। বলল, বাবা, তোর এখানে থাইকা কাম নাই। বাড়ি ফিরে চল।
ছেলেকে নিয়ে ঘরে দোর দিয়ে বসে আছে স্নেহময়ী মা। জানালাও আটকেছে শক্ত করে। চোখে ঘুম নাই। দরোজায় শব্দ হল। মার মুখ রক্ত শুন্য হয়ে গেল। খুলতে গেলে হাত চেপে ধরেছে। বলছে, খুলিস না। খুলিস না। ডাকাইত। ডাকাইত আইছে।
ডাকাইত না। প্রতিবেশী বৌদি এসেছেন। হাতে পাকা আমরে ঝুড়ি। খেয়ে মা বলল, অ মা, এ দেহি আম--মিঠা।
বৌদিদের বড় ফলবাগান। গাছে কাঁঠাল পেকেছে। খেয়ে জগজ্জননী আরও অবাক, এ তো দেহি সত্যি সত্যি কাডাল!
এর পর সত্যি সত্যি বরিশালের গাছে গাছে আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা ধরেছে। ক্ষেতে ধান। পুকুরে কুমোইর নয়—মাছ। আকাশে চিল। রাস্তাঘাটে ডাকাইত নয়—মানুষজনের দেখা মিলেছে। কোন ডাইনী নয়—বেনী বাঁধে-পাট করে শাড়ি পরে সরস্বতী অথবা লক্ষ্মী। মা বলে, পিতিমে গো—পিতিমে।
পিতিমেদের লগে মাসখানেক মা থেকে গেল। খুব মুখ কালো হয়ে গেল ফিরে যাওয়ার দিন। ফোঁস ফোঁস করে বলল, সরগো হৈতে বিদেয়।
আমাকেও যেদিন সত্যি সত্যি সরগো হৈতে বিদেয় নিতে হল—ততদিনে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছর গিয়েছে চলে। কে হায় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে। আমার সঙ্গে একটি পিতিমে। লক্ষ্মী অথবা সরস্বতী—কোন জন বলা কঠিন। আর ফুটফুটে দুটো মেয়ে।ডানা শুধু নেই। নিউ ইয়র্কের টিচার মিস বেল জানতে চাইল, ও মেয়ে তোমাদের বাড়ি কোথায়?
বড়টি বলল, বরিশাইল
--বড়…ইশ্যাল?
ছোটটি দিদির কথা খুব মনযোগ দিয়ে শুনল। তারপর আধো আধো গলায় বলল, মোগো বাড়ি বরিশাইল।
আমার স্ত্রীর চোখে আনন্দজনিত অশ্রু। আমার হাতে হারিকেন।
নাহার, বরিশ্যাল ছাইড়া যামু আর কোন দ্যাশে? উপায় আছে?
মনুসাহিত্য দারুণ উপভোগ করলাম।
আপনার লেখাগুলো নিয়ে শুধু ভালো বললে কম বলা হয়।
অনেক শুভেচ্ছা।
ব্লগ নীতিমালায় ডাবল পোস্টিং নিষিদ্ধ । মডারেটর এসে সরিয়ে দেয়ার আগে আপনাকে সরানোর অনুরোধ করবো । মডারেশনে লেখা কাটা যাচ্ছে দেখতে ভালো লাগে না ।
লেখাটা সুন্দর ।
ভালু পাইলাম
বেশ মজার তো মনু সাহিত্য! উপভোগ্য। শুভেচ্ছা কুলদা।
মন্তব্য করুন