নিউ ইয়র্কের কবিতা : পাঁচটি পুরনো কবিতা
জার্নাল: ঘুমপার্ক থেকে
চড়ুই পাখিটা এসেছিল
আমি ঘুমিয়ে পড়ার আগে
রোদ্দুরকে দেখেছিলাম আমার গলা অবধি
একটা উমের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে,
দূর থেকে কানে ভেসে আসছিল-
কে যেন সাদা পুকুরের উপর রিনি ঝিনি করে
পা মেলাচ্ছে, বাজছে খয়েরি ভায়োলিন
আর ফুটে উঠছে আস্ত লাল লাল পদ্ম
সেই সুর আমি আজও মনে করতে পারি
মনে করতে পারি দুচোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে
একটি বার্চ গাছ তার খোলস বদলে দাড়িয়ে রয়েছে
তাকেও দেখেছি কিছুটা বিহ্বল, শ্বাস নিচ্ছে ঘন ঘন
গালে লাল লাল ছোপ, বলছে-
আমার ডালে ডালেও সে কিছুটা ছুটোছুটি করেছিল
আঙুলগুলো এত নরম যে মার কথা মনে পড়ে
আমার ঘুমিয়ে পড়ার ভেতরে তার সবুজ স্তন
বারবার ফিরে ফিরে আসে
কি সব কাণ্ড কারখানা যে ঘটে ঘুমিয়ে পড়ার পরে
সব বোঝা মুশকিল, কিন্তু সেই চড়ুই পাখিটা?
আর তার ভেজা পালকের গান?
পার্কের ভেতরে সারি সারি বার্চ গাছ
তাদের মাথায় সবুজ রঙের স্কার্ফ
পুকুর জুড়ে জল শিউরে শিউরে উঠছে
আর থেকে থেকে কে যেন রিণরিণে গলায় বলছে-
তোমার ঘুমটুকু টুক টুক করে খেয়ে নিয়ে
চড়ুই পাখিটা ঘুমোতে চলে গেছে
স্কেচবুক
ট্রেন থেকে বাড়িগুলো দেখা যায়
দূরে বনভুমি- হলুদ পাতার ফাকেঁ
জীর্ণ শীর্ণ চোখ ঘুরে ঘুরে যায়
আর উঁচু নিচু হয়ে ছানাপোনা নিয়ে
শান্ত বাড়িগুলি লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকে
হাওয়ার শন শন শব্দ বেজে ওঠে
চমকে তাকিয়ে দেখি-
যে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি
তার দরোজাটা হাট করে খোলা
একটা জুবুথুবু ছায়া নেমে এসেছে
ঘর থেকে পেভমেন্ট অবধি, প্লাস্টিকের টবে
সদ্য গজিয়ে ওঠা ভারবেনার পার্পল পাপড়িতে
আর একপাশে হেলে রয়েছে সবুজ কুকুর
স্তব্ধ দুটি কান, একটি আধ ভাঙা, খয়েরি…
কিছু না বলে মাঝ রাত্তিরে চাঁদ
ফিরে গেছে একা একা
কনকনে হাওয়ার মধ্যে
বাড়িটার ছাদে ঝুলে পড়েছে ক্লান্ত মেঘ
রেল-পুলিশ ঢুলছে জানালার পাশটিতে
যার যার ঘুম এইভাবে সেরে নিচ্ছে
শিশুর কান্নার শব্দে অনেক সময়
সত্যি সত্যি আমাদের চোখ খুলে যায়
অনেক সত্যি আমরা সত্যি করে দেখতে পাই
এইজন্য ঘুমিয়ে পড়ার আগে-
বার কয়েক মুছে নেই চশমার কাঁচ
ট্রেন থেকে দেখা যায়-
বাড়িগুলো ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে আসছে
তার ছানাপোনাগুলোও উধাও
সব কিছু তেড়ে ফুঁড়ে জেগে উঠছে
একটি নির্জন খা খা সাদা প্রান্তর
আর তার গা বেয়ে চুয়ে নামছে জল রং
ভিজে জবজবে ছবির কাগজ
নার্সপার্ক
নার্সের সঙ্গে দেখা হলে হেসে ফেলে নার্স
বলে, আজ তুমি ভাল আছো।
আজ তুমি ভালোবাসো।
তার দীর্ঘ ধবল পা, আর তারা জ্বলা চোখ
নার্স বলে, আজ শীত নেই, চারিদিকে সামার
জমে থাকা বরফ কুচির উপর তাই রোদ পড়ে
থেমে থেমে বৃষ্টি নামে, দাঁতগুলো ফুলের কোরক-
ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে, মনে পড়ে
হাসপাতালে নার্সের হাত ছুয়েঁ বসে থাকি
দরোজায় পর্দা নেই, হুড়কো তুলে দেয়া
বলি, বলো নার্স- সেইসব পরীদের গল্প বলো
বলো, সন্ধ্যেটা রাত্রির সুঘ্রাণ পরীর মতো-
স্ট্রবেরি আসইসক্রিম খেতে খেতে ঢুলতে থাকুক
বলুক সেও কোনো নির্ঘুম নার্সের কথা
ছোট্ট ঘরের মধ্যে পরীদের ছবি- মগ্ন জলের পরে
হাসি হাসি মুখ, এর মাঝে-
নার্সের কতো কাজ- জ্বর দেখা দেখা, রক্তচাপ মাপা,
ওজোনের বাড়াকমা- এরকম নার্সের ছুটোছুটি
গ্লুকোমিটারের সুতীক্ষ্ণ পিন নারোম মাংসের
ভেতরে ঢুকে পড়ে, নার্স ফিস ফিস করে-
তার কথা মনে করো- তার কথা ভেবে চলো
কার কথা মনে করি? কার কথা ভেবে চলি?
সূচীবিদ্ধ বেদনার কথা?
রক্তের নীরব দীর্ঘ ধারার কথা?
চেয়ে দেখি, দুপা ভাজ করে বসে আছে নার্স
পায়ের বিম্বিত ছায়া থেকে-
সন্ধ্যা রাত্রিকে বোন বলে ডেকে ওঠে
বলে, বৃষ্টি নামার আগে আয় বোন দুজনে পালাই
মাউস টিপে টিপে হেলথ ডাটা
আপডেট করে শুধু নার্স, স্থির তার চোখ
তারাগুলো নিভে আছে, বৃষ্টি ঝরার আগে
থমথমে হাওয়া
কতো ঘুম জানে এই সাদা নার্সের চোখ
এইসব দেখে শুনে ঘেমে ওঠার আগে
আমি ফিরে যাই, একটু একটু করে পা ফেলি
নতুন করে হাটিঁ-
নার্সের ধবল পায়ের কথা মনে করি
পদ্ম কোরকের মতো ছোট ছোট দাঁতগুলি
আর রক্তজমা লাল ঠোঁট ভেবে ভেবে
রাস্তা পার হয়ে যাই, ঠিক ঠিক গাড়িগুলো
নিরাপদে চলে যায়
আর আমাকে পথ দেখিয়ে চলে শত শত ঘুমন্ত নার্স
সাদা জামার ভেতর থেকে -
শত শত গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে দীর্ঘ প্রান্তর জুড়ে
তাদের পায়ে নেই জুতো, নেই কোনো শীত মোজা
সামারে জেগে ওঠা কংক্রিট ফুড়েঁ ধবল শিকড় শুধু
ঢুকে পড়ে বহুস্তর মাটির গভীরে
আমি দেখি নার্স হেসে ওঠার আগে
বৃষ্টি থমকে যায়
পার্কে বৃষ্টি থেমে গেলে গাছগুলো কেঁদে ওঠে
ভাইগাছ বোনগাছ
পার্কে ভিখিরিরা সন্ধ্যার আলো খেয়ে বেঁচে থাকে,
আর সারাদিন বেঞ্চিতে পড়ে পড়ে ঘুমায়
এই নিয়ে গাছের সঙ্গে ভিখিরিদের কোন
মৌল বিবাদ নেই
পুকুরের জল থেকে হাওয়া ওঠে
শীতলতা হেতু মাছগুলো নির্ভার
পুষ্পকাল এখনো কিছু দেরী আছে
বরফ গলছে ধীরে ধীরে
যে মেয়েটি বসে আছে টিলার উপরে
হাটুদুটো খোলা, হালকা হাওয়ার মধ্যে
তার সামার জ্যাকেট বারবার খুলছে আরে পরছে
পরছে আর খুলছে
তাকে দেখে মনে হয়-
পাহাড়ের কাছে নগ্নতার কোনো মানেই হয় না
পার্কজুড়ে সারি সারি ভাইগাছ বোনগাছ
থেকে থেকে বোন বলে, সাতভাই জাগো রে
ভাই বলে, কেন বোন পারুল ডাকো রে...
গাছের ফোঁকর থেকে উকিঁ মারে কাঠবিড়ালি
হুট করে বের হয়ে রৌদ্রে নামে
ঝাউপাতার মধ্য থেকে কাঠবিড়ালিটি
সেই কালো মেয়েটির উরুর নিচে ঢুকে পড়ে
কোল বেয়ে উঠে আসে, একবার কাঁধের উপরে
দাঁড়ায়, এ সময় ভিখিরিরা পাশ ফেরে
তারপর কালো মেয়েটির খয়েরী চুল ছুয়েঁ
স্তব্ধ স্তনের ফাঁক দিয়ে লাফ মারে
উদ্গত ঘাসের ভিতরে হঠাৎ হারিয়ে যায়
এই কাঠবিড়ালিটির সংগে গতকাল ফিরে যাওয়া
সেই স্পর্শকাতর সাদা ছেলেটির কোন মৌল বিবাদ নেই
পার্কের বেঞ্চিতে হোমলেস ভিখিরিরা শুয়ে থাকে
সূর্য ডুবে গেলে-
সন্ধ্যার আলোটুকু ছুড়ে দেয় ভাইগাছ বোনগাছ
এই আলোটুকু ভিখিরিদের দিনের আহার
তারপর রাত্রি যেভাবে গভীর রাত্রির ভিতরে
অনায়াসে ঢোকে
ভিখিরিরাও এইভাবে ঢুকে পড়ে ভাইগাছে বোনগাছে
উষ্ণ ফোঁকর জুড়ে কাঠবিড়ালির পাশটিতে
পুষ্পিত মাছের মতো শোয়
কাঠবিড়ালির সঙ্গে পার্কের ভিখিরিদের কোন
মৌল বিবাদ নেই
সমুদ্র মেয়ে অথবা জমজ বাড়ির আলো
স্কুল থেকেই বালিকারা বাতাসও চিনতে পারে
তাদের দরকার একটি সানগ্লাস
তারা জানে, জল কখনো খণ্ড হয় না
মাঝে মাঝে ফুলে ফুলে ওঠে
ম্যানহাটনের লেজে ই-ট্রেনের লাস্ট স্টাপ
এরপর থেকেই থৈ থৈ সমুদ্র
যেখানে প্লেনগুলোও ভয় পায় নিচু হতে
সেইখানে একটি মেয়ে একা হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে
রোদ বৃষ্টি আর অন্ধকারেও তার স্কুল নেই
শুধু কান পেতে শোনে- সাউথ ফেরির ভোঁ...
এদেশের মেয়েরা বহুবর্ণিল
সামারে জামাকাপড় ছুড়ে ফেলে
আর গায়ের এখানে ওখানে আকেঁ উল্কি
কানে আইপড
সমুদ্র মেয়ে একটিমাত্র তুতেঁ রঙের ঘাঘরা পরেই
পার করলো তার বালিকাপর্ব, শুধু মাথায়
এটে নিয়েছে বেথলেহেমের কাঁটার মুকুট
বিড়বিড় করে বলছে- আমিই পথ, আমিই জীবন...
ব্যাটারি পার্কে রাত্রি পার করে যেসব বিষণ্ণ মানুষ
তারা জানে এইসব ছেঁদো কথা
যেদিন তাদের চোখ থেকে পালিয়েছে ঘুম
সেদিন থেকেই বালিকাদের স্কুল বন্ধ
ডানকিন ডোনাটে এরা সবাই কড়া কফি বেঁচে
এই বিষণ্ন মানুষগুলো ব্যাটারি পার্কে
পাথুরে পরীর সামনে বসে থাকে, কফি গেলে
একটি ইঁদুর দৌড়ে গেলেও পরীদের স্তন
কখনো কেঁপে ওঠে না
যে পাঁচটি পুরুষ সমুদ্র মেয়েটির মুখোশ পরেছে
তাদের যে কোনো একজনের সংগে
ছবি তোলার দাম পাঁচ ডলার
তাদের চোখেও তুঁতে রঙের সানগ্লাস
কাছে গেলেই পুরুষ পাঁচটি একসাথে বলে ওঠে-
একটু অপেক্ষা করো, বাথরুম সেরে আসি
এই ফাঁকে ডানাহীন পাখিদের সামনে
একজন স্প্যানিশ গায়ক অন্ধের মতো গান করে-
'আমার থাকতো যদি সোনার পাহাড়...'
সমুদ্র মেয়েটির কাছে যেসব স্কুল বালিকারা আসে
তাদের প্রত্যেকেরই আছে গুপ্ত মোমবাতি
পাহাড়ের মতো জল ফুলে উঠলেই
ঢেউয়ের মাথায় ভাসে পবিত্র আলোবিন্দু
আর ফসফরাসের মতো জ্বলে যায় দুটি জমজ বাড়ি
চারিদিকে ছিটকে পড়ে খণ্ড খণ্ড জল
ব্যাটারি পার্কে বিষণ্ন মানুষগুলো বসে থাকে
তাদের মাথায় নানা রঙের উইগ
তারাই সত্যি সত্যি জানে,জলে নয়-
পোড়া ছাইগুলো পড়েছে সমুদ্র মেয়ের চোখে
আর আকাশ ছোঁয়ার আগেই অগ্নিপিণ্ডগুলো
ধরা পড়েছে তার হাতের মুঠোয়
সেই থেকে স্কুল বালিকারা চশমাবিহীন
বাতাস থেকে গন্ধ শুকেই তারা বলে-
এখন অগ্নিশিখার চেয়ে পাথরের টুকরো
অধিক দৃশ্যমান
*(কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল-- গেল বছর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মার্চ এপ্রিলের দিকে। এর পরে আর কবিতা লিখেছি বলে মনে পড়ে না।)
তন্ময় হয়ে পড়লাম । স্যালুট দাদা ।
ভালো লাগলো...
দারুণ লাগলো... সুন্দর...
আবার কবিতা লেখা শুরু করে দেন
দারুন
কবিতা লেখা শুরু করেন
এক একটা কবিতা আলাদা আলাদা পোষ্টে দিবেন। আরাম করে পড়বো রসিয়ে রসিয়ে
খুব ভালো লেগেছে। আরো অনেক কবিতা আপনার থেকে আশা করব।
ধন্যবাদ। আমি কবিতা আর লিখছি না।
কবিগুলো পড়লাম। বেশ ভাল লাগলো। কবিতা মানে কম কথা!
মন্তব্য করুন