কুশিয়ারা ও একজন লেখকের গল্প
ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হতে চলল। বইমেলায় যেতে পারিনি। চট্টগ্রাম থেকে দু’এক দিনের জন্য ঢাকা যাওয়া খুব যে কঠিন তা নয়। তার ওপর আমার একটা উপন্যাস এসেছে মেলায়। কিন্তু আমি একা তো আর যেতে পারি না। মেয়ের বায়না- সেও যাবে। মেলা থেকে বই কিনবে। আমার স্ত্রী একটা স্কুলে চাকরি করেন। তাঁর আর আমার ছুটির সময়টা মেলেনি বলে যাওয়া হয়নি।
কিন্তু মেয়েকে কী করে সামলাই? তার বই চাই। নিয়ে গেলাম আন্দরকিল্লা। লাভ কিছু হয়নি। মেয়ে বইমেলা থেকেই বই কিনবে।
কষ্টের একটা বোধ থেকে ফেসবুকে এই স্ট্যাটাসটা দিলাম- ''আমার মেয়ে কুশিয়ারা শুধু পড়ার সুযোগ খোঁজে। খেতে খেতে, টিভি দেখতে দেখতে, এমন কী স্কুলের পড়া তৈরি করতে করতে সে পড়ে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে পড়ে, ঘুম থেকে উঠেও পড়ে। কিন্তু আমার বাসায় তার পড়ার উপযোগী বইয়ের সংখ্যা খুব কম। গত বইমেলা থেকে কিনেছিলাম আহসান হাবীবের ছোটদের জোকস এবং শাহানা সিরাজীর প্রজাপতির দেশে। এ দুটো বই সে মুখস্থ করে ফেলেছে।
এবার শুরু থেকেই বলছে- বাবা বইমেলায় যাব। নতুন বই কিনব।
কিন্তু আমাদের বোধহয় এবার বইমেলায় যাওয়া হবে না।
আজ আন্দরকিল্লা গিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়ের এক কথা- সে বইমেলা থেকে বই কিনবে।
এই প্রথম ঢাকার বাসিন্দা হতে না পারার জন্য কষ্ট বোধ করছি।''
স্ট্যাটাসে অনেকেই লাইক দিলেন। কমেন্ট করলেন। কিন্তু আমাকে অবাক করলেন এক খ্যাতিমান তরুণ লেখক। আমার ইনবক্সে তিনি লিখলেন- ''আপনার স্ট্যাটাসটা পড়ে মন ভিজে উঠলো। মেয়ে বই পড়তে চাইছে, বইমেলায় যেতে চাইছে, অথচ ঢাকায় না থাকার কারণে নিয়ে যেতে পারছেন না, সত্যিই মন খারাপ হবার মতো ব্যাপার।
আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমার না-দেখা মামনিটার জন্য আমি কি কিছু বই পাঠাতে পারি? যদি অনুমতি দেন তাহলে প্লিজ কুরিয়ার করার জন্য ঠিকানাটা আমাকে লিখে পাঠান। আচ্ছা, ওর বয়স কতো? কোন ক্লাসে পড়ে? কি ধরনের বই পড়তে বেশি পছন্দ করে? ছড়া-কবিতা নাকি গল্প-উপন্যাস? এরপর যেদিন বইমেলায় যাবো, ওর জন্য কিছু বই সংগ্রহ করে পাঠাতে চাই। দয়া করে 'না' করবেন না।
এই ধরনের একটা মেয়ে পেয়েছেন, আপনি তো সৌভাগ্যবান। অনেক অনেক আদর দেবেন ওকে।''
আমি না করিনি। বরং তাঁর বার্তা পড়ে আমারও মনটা ভিজে উঠল। কেন জানি না। তবে বোধহয়, বোধ-অনুভূতিসম্পন্ন যে মানুষদের আমি খুঁজে বেড়াই, সেরকম একজনকে পেয়ে যাওয়ার আনন্দে।
তিনি কুরিয়ার করে ১২টি বই পাঠালেন। বইগুলো হাতে পাওয়ার পর আমার মেয়ের চোখেমুখে খুশির যে ঝিলিক দেখেছি, তা অভূতপূর্ব। এর আগে আর কোনো উপহার পেয়ে সে এত খুশি হয়নি। ইতিমধ্যে সে পড়া শুরু করে দিয়েছে।
আমিও খুশি এবং গর্বিত হয়েছি- ওনার মতো একজন মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে- এজন্য। এবং একটা নতুন ব্যাপার আবিষ্কার করেছি- বই উপহার পেয়ে শিশুরা অশেষ আনন্দ পেতে পারে।
ছয় বছরের কুশিয়ারাকে ঘুম পাড়ানো খুব কঠিন। প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প বলতে হয়। তাও আবার গল্পের বিষয় সে ঠিক করে দেয়। তাৎক্ষণিক গল্প বানাতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয় আমাকে। অবশ্য একটা লাভ আমার হচ্ছে। গল্পের ভাণ্ডার বাড়ছে। ওর ঠিক করে দেওয়া বিষয় নিয়ে বলা দুটো গল্প প্রথম আলো গোল্লাছুটে ছাপাও হয়েছে।
কুশিয়ারা অন্ত্যমিল দিয়ে ছড়া লেখার চেষ্টা করে। দুটো লিখেছে এরকম-
১. রাজা এল না
রানী খেল না।
কেন দেরী হলো
রানী চেরি খেল।
২. জগে ভরা জল
সত্যিটা তুই বল।
তবে বইগুলো পাওয়ার পর, পড়তে শুরু করার পর তার চিন্তা ও কল্পনাশক্তিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এতদিন আমি তাকে গল্প বলে ঘুম পাড়িয়েছি। কাল রাতে সে বলল, বাবা আমি গল্প বলছি, তুমি ঘুমাও। সত্যি সত্যি সে নিজের মতো করে গল্প বলতে শুরু করল- এক দেশে ছিল এক বাবা...
মেয়ের গল্প শুনতে বেশ লাগলো। এত ছোট বয়সে কি চমৎকার সব অভ্যেস ওর গড়ে উঠেছে! ওর লেখার হাত-ও তো দারুণ
সেই লেখককে ধন্যবাদ; মানুষের এমন সংবেদনশীলতার জন্য মানুষ নামক প্রাণী থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রদ্ধা হারাই না।
হ্যাঁ, সংবেদনশীল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা।
কুশিয়ারার জন্য অনেক স্নেহ।
আপনার স্নেহ জানিয়ে দিলাম কুশিয়ারাকে। ধন্যবাদ আনোয়ার সাদী।
মেয়ের জন্য অনেক অনেক আদর আর খ্যাতিমান তরুণ লেখক। কে স্যালুট।
লেখককে আমিও স্যালুট জানাই।
বাহ, আমার মাথায় এটা আসতো না।
শিশুরা এমন অনেক কিছুই চিন্তা করে, যা আমাদের মাথায় আসে না।
ধন্যবাদ মাসুম ভাই।
কুশিয়ারার জন্য অনেক আদর, অনেক ভালোবাসা।
পৌঁছে দিলাম।
মেয়ের ছড়াটা দারুণ। আপনার লেখাটাও।
সেই লেখককে শ্রদ্ধা।
ধন্যবাদ জ্যোতি
মেয়ের প্রতি শুভকামনা।
তরুণ লেখকেরে স্যালুট।
আপনার শুভকামনা জানিয়ে দিলাম
প্রতিদিন গল্প বলা ! চমতকার একটি অভ্যাস গড়েছেন আপনি। ভালো লাগলো লেখাটা। কুশিয়ারার জন্য শুভকামান। আর নাম না জানা ওই লেখকের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ সাগর ভাই।
সিরাজী ভাই কেমন আছেন? আপনার লেখা অসাধারণ হয় বরাবরই। এ লেখাটাও তাই হয়েছে।
পিচ্চিটার জন্য আদর থাকলো।
আমি ভালো আছি মীর ভাই। আপনি?
ব্যস্ততার জন্য আপনাদের সঙ্গে কথাবার্তা কম হয়। কিন্তু ফিল করি। মিস করি।...
মিসিংএর কথাটা সত্যি। আমিও আপনাকে মিস করি।
অনেক অনেক শুভকামনা আর ভালবাসা
আমার গল্পগুলোও শুরু হয় -এক দেশে ছিল এক... দিয়ে।
এখন কুশিয়ারাও শুরু করেছে। মজাই লাগে।
দোয়া করবেন।
কুশিয়ারা নামটির সাথে আমার আবেগের একটি সুক্ষ্ম সম্পর্ক আছে..আপনার মেয়ের গল্প শুনে ঈর্ষা হলো। এখন অনেক বাচ্চাই পড়তে চায় না। আমি ধরে বেধে চেষ্টাও করেছি..
লাভ হয়নি.. আর ধন্যবাদ সেই লেখককে ..আপনি আসলেই ভাগ্যবান। এমন সন্তান এবং একাধারে বন্ধুবাৎসল মানুষ কজনের ভাগ্যে জোটে!..
কুশিয়ারা নামটি আমি রেখেছি। যদিও আমি মেঘনা অঞ্চলের মানুষ। অবশ্য মেঘনার সাথে কুশিয়ারার একটা সম্পর্ক আছে।
এমনিতে েতাহ নদীগুলো বাঁচবে না..না হয় মানুষের নামেই বেঁচে থাকুক...আমিও দুটি নাম ঠিক করে রেখেছি..এখন দেখা যাক...
আমার মেয়ে কাল পনেরটা বই উপহার পেলো, বইগুলো বাসায় নেবার পর সে মোটামুটি একটা লাফ দিলো। রাতের খাবার খাওয়াতে গিয়ে তাকে বই পড়ে শোনালাম, সে সব বই একসাথে পড়ে ফেলতে চায়। রাতে বইগুলো মাথার কাছে নিয়ে ঘুমালো, আজ সকালে দারুণ এক দৃশ্য হলো। এমনিতে ওকে স্কুলের জন্য তৈরী করা, নাশতা করানোর জন্য ডোরেমন দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে হয় এবং খুব ঝামেলা করে মুখে খাবার তুলে দিতে হয়। আজকে ডোরেমনের কথা তুললোই না, ছড়ার বই নিয়ে মেতে থাকলো, আমি ওকে চটপট খাবার খাইয়ে দিলাম, রোজ রুটি খায় অর্ধেকটা, আজকে পুরোটা খেলো
আমরা অভিভাবকরাই পারি শিশুদের রুচি গড়তে বা পালটাতে। ডোরেমন-জুজুতে আক্রান্ত হয়ে আমরা শুধু আগ্রাসনের দোহাই দিচ্ছি। কতটা দায়িত্ব আমাদের আছে- সেটা দেখিয়ে দিল আপনার মেয়ে, আমার মেয়েও।
কুশিয়ারা আমার দেখা উজ্জ্বল শিশুদের অন্যতম। অনেক আদর কুশিয়ারার জন্য। আর সেই তরুন লেখকের জন্য অনেক শুভকামনা।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ নীড়দা।
মন্তব্য করুন