হোয়াট হ্যাপেনস ইন ভেগাস...( শেষ পর্ব)
পবিত্র রমজান মাস চলে আসতেছে। ভেগাস নিয়া পোস্টে দিতে দেরী করলে পরবর্তীতে রমজানের পবিত্রতা বিনষ্ট করার অপরাধে আমার ফাঁসির দাবী আসতে পারে। তাই হাজার ঝামেলার মধ্যেও শেষ পর্বটা নামিয়ে ফেললাম। তাড়াহুড়া করে লেখা, ছবি পোস্টানো, ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়
ভাবছিলাম হোটেলে ঢুকে একচোট ঘুমিয়ে নেব। কিন্তু কীসের কী, চারদিকের তেলেসমাতি দেখে ঘুম পালিয়ে গেল মরুভূমিতে, আর আমিও ভূতে পাওয়া মানুষের মতো চোখ বড় বড় করে মানুষ আর যন্ত্রের কাজ কারবার দেখতে লেগে গেলাম। এক সময় শুনতাম চান্দের দেশে গেলেও নাকি নোয়াখালীর মানুষের দেখা পাওয়া যায়। কথাটা যা নির্জলা মিথ্যা না তা বুঝলাম ক্যাসিনোতে ঢুকেই। এক অ্যাটেন্ডেন্ট এগিয়ে আসলো, ট্যাগে দেখি নাম লেখা--মফিজ। আমি ইংরেজীতে জিগাইলাম আপনার বাড়ী কই? জবাব আসলো--ইন্ডিয়া। আমার বাড়ি কই জিগাইলে জবাব দিলাম বাংলাদেশ। সাথে সাথে হড়বড় করে খাঁটি নোয়াখালীর ভাষার মফিজ ভাই বলতে শুরু করলেন, আরে আমার বাড়ীর বাংলাদেশে, ফেনী, এইখানে কেউ চিনে না তাই বলি ইন্ডিয়া। আমি মনে মনে কইলাম, কেউ চিনুক বা না চিনুক আমি যতদিন বাঁচি বাংলাদেশী হয়েই বাঁচবো। জুয়া খেলায় আমার খুব একটা উৎসাহ নাই, আমি গেছিলাম একটু ঘুরে ফিরে দেখতে, তাই মফিজ ভাইয়ের সাথে তেমন জমলো না।
ক্যাসিনোর যেদিকে তাকাই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। মটর সাইকেল আমার খুব প্রিয় একটা বাহন, এক কালে শখ ছিল দামী একটা রেসিং বাইক কেনার, সামর্থ ছিল না। এখন সামর্থ থাকলেও, সময়-সুযোগ নাই। ক্যাসিনোর কোণায় কোণায় দেখলাম অসম্ভব দামী সব হার্লে ডেভিডসন মোটর বাইক সাজানো আছে। অন্তত গোটা তিরিশেক তো হবেই। একটার পাশে দাঁড়াইয়া ছবি তুললাম--
এমন দামী দামী গাড়িও সাজানো চারপাশে
এইটা লটারী পুরুষ্কার, টিকেট একটা কিনে আনছি, দেখি লাগে কী না
টপলেস রেস্টুরেন্টে খাইতে যাই নাই, তবে এইটাতে গেছিলাম, কোনো অংশে কম না
ওহ্ আরেকটা কথা ভুলে যাচ্ছিলাম। এইটা আমার অন্যতম স্মরণীয় লাস ভেগাস অভিজ্ঞতা। যেদিন পৌঁছালাম, সেদিন সন্ধ্যাতেই আমাদের দুবাই অফিসের দুই কলিগ খুব ধরলো একটা ম্যাজিক শো দেখতে যেতে। আমেরিকার সবচেয়ে নামকরা ম্যাজিশিয়ানদের একজন ডেভিড কপারফিল্ড । তাঁকে চেনে না এমন লোক আমেরিকাতে পাওয়া দুষ্কর। একেকটা শোতে হাজার হাজার লোক হয়, প্রতিটা টিকেটের দাম প্রায় শ'খানেক ডলার। আমি খুব একটা উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। কিন্তু কলিগেরা এমনভাবে চেপে ধরলো যে আর বলার মতো না, একজন গিয়ে টিকেটও কিনে আনলো, আর না বলার কোনো উপায় থাকলো না। অবাক করা মানুষ এই কপারফিল্ড। অদ্ভুত, নাটকীয় তার যাদুকরী কাজ কারবার। একের পর এক অসাধারণ সব ভেলকিবাজী দেখিয়ে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলো। আলোর খেলা, শব্দের খেলা, উধাও হয়ে যাওয়া, মানুষ কেটেকুটে দুই ফুট সাইজের করে ফেলা ইত্যাদি গোটা বিশেক অবিশ্বাস্য সব খেলার পরে সব শেষ আসলো একবারে দশজনকে উধাও করার খেলা। এটা দিয়ে শো শেষ করা হবে। মঞ্চ থেকে দর্শকদের দিকে অনেকগুলো বড় প্লাস্টিকের বল ছুঁড়ে দেয়া হলো, যার যার হাতে পড়বে, তাঁদেরকে কপারফিল্ড মামু মঞ্চে নিয়ে উধাও করে ফেলবে। এমনই কপাল একটা বল এসে গিয়ে পড়লো আমার হাতে, আমিও আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কপারফিল্ডের যাদুতে এতই অবাক হয়েছিলাম যে, খুব ইচ্ছা ছিল নিজে মঞ্চে উঠে দেখা ফাঁকফোঁকড় কিছু ধরা যায় কী না। মঞ্চে যাবার পথে তার সহকারীরা শ'খানেক প্রশ্নে আমাকে ঝাঁঝরা করে ফেললো। আমি কে, কই থাকি, ম্যাজিশিয়ান বা সাংবাদিক ? ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন। সব শেষ এমন একটা প্রশ্ন করলো যেটা শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু সেটা বলার উপায় নাই। যাই হোক দশজনে গিয়ে মঞ্চের উপরে বানানো মিনি মঞ্চে গিয়ে উঠলাম। আমাদের হাতে একটা টর্চ ধরিয়ে দেয়া হলো। টর্চ চালু রেখেই আমাদের চারপাশে পর্দা নামিয়ে মঞ্চটা ঘুরতে শুরু করলো। লোকজন হা করে দেখছে। এক, দুই, তিন গুনতে না গুনতেই আমরা উধাও হয়ে গেলাম। সবাই পেছনে তাকিয়ে দেখে আমরা দশজনে একেবারে পেছনের সারিতে দাঁড়ানো, হাতে সেই টর্চ জ্বালানো। পুরা অডিয়েন্স হাততালিতে ফেটে পড়লো। শো শেষে কপারফিল্ড মামু আমাদের তার নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে করজোরে অনুরোধ জানালো এই ম্যাজিকের গোমর কারও কাছে ফাঁস না করতে, করলে নাকি তার পেটে লাত্থি পড়বে। সম্মতি জানালে সে নিজে তার ছবিতে অটোগ্রাফ দিয়ে আমাদের একটা করে গিফট করলো, আর তার আরও দুইটা চালু ম্যাজিকের গোপন রহস্য জানিয়ে দিল। এই মিলিওন ডলার কামানো ম্যাজিকের গোপন রহস্য আপনাদের কাছে বলতে না পারলেও একটা কথা বলি, এই ট্রিকগুলা খুবই খুবই সাধারণ মানের। মানুষজন ধরতে পারে না বলেই এতটা অবাক হয়, আসলে ভেতরে সব ফকফকা, ফালতু ফাঁকিবাজী। আমার আর ডেভিড কপারফিল্ডের প্রতি কোনো গুণমুগ্ধতা অবশিষ্ট নাই।
আবার বকবক শুরু করে দিলাম। বাদ দেন, ছবি দেখেন--
ভেগাসের রাস্তায় সাকি পরিবেষ্টিতে ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো
সাকির একটা ক্লোজ-আপ না নিয়া আর পারা গেল না, বিয়াফক সৌন্দজ্জ
সিজার প্যালেস, এখানে ছিলাম এক রাত
বেলাজ্জিও ক্যাসিনো, আকারে বিশাল, কাজে কর্মে উন্মাতাল
লাস ভেগাসের ক্যাসিনোরগুলোর মধ্যে বেলাজ্জিও খুবই সম্ভ্রান্ত , পর্যটকদের ঢল লেগেই থাকে সারা বছর সেখানে। ক্যাসিনো এবং পাঁচতারা হোটেলের বাইরেও মূলত দুইটা কারণে। বেলাজ্জিও সামনের লেকেই ভেগাসের বিখ্যাত ড্যান্সিং ফাউন্টেইন, আর ভেতরে লবীতে মিনি পার্ক।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে এগুলো সব কৃত্রিম, ছুঁয়ে দেখলেও
বেলাজ্জিওর সামনে ড্যান্সিং ফাউন্টেনের কয়েকটা ভিডিও করছিলাম। কিন্তু এবিতে কেন জানি ভিডিও আপলোড করতে পারতেছি না। তাই লিংক দিয়ে দিলাম। দেখা যায় কি না দয়া করে জানাবেন।
আসলে সবার পেটে সব কিছু সয় না। আমারও ভেগাসের মুগ্ধতা কাটতে বেশি সময় লাগে নাই। এত অপচয়, টাকার শ্রাদ্ধ আর কোথাও দেখেছি কি না বলে মনে পড়ে না। তবে দেখার শখ ছিল , হাউশ মিটাইলাম এই আর কি। কেউ না গেলে তার তাতে কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। তবে একটা জিনিষ খুব উৎকট লাগলো। সেটা হলো ওখানকার টিপ কালচার। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্যাক্সি, বাস--মানে সার্ভিস ওরিয়েন্টেড যত পদের কাজ আছে, সব খানে মানুষ হাড় হাভাতের মতো ভেটকাইয়া থাকে টিপসের জন্য। জিনিসের দামের উপরে সার্ভিস চার্জ, তার উপরে গ্রাচুইটি, তারপরেও টিপসের জন্য হা করে থাকে, তাও পাঁচ দশ পার্সেন্ট না, বিশ-ত্রিশ পার্সেন্টে নীচে টিপস না দিলে তাতে তাদের গাল ওঠেনা। আমি এক রেস্টুরেন্ট স্টেকের অর্ডার দিলাম, দাম ছিচল্লিশ ডলার, খাবার শেষে দেখা গেল সব হাবিজাবি মিলিয়ে বিল মেটাতে হলো প্রায় একশ ডলারের। বকশিশ আদায়ে এরা এতটা নির্লজ্জ যে বলার মতো না, মোটাদাগে না দিলে চরম গোস্বা হয়। ভেগাসের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের চেয়ে বাংলাদেশের রিক্সাওয়ালারা অনেক বড় মাপের মানুষ। এই সফরে এইটাই আমার চরম উপলদ্ধি। এই বিষয়টা নিয়ে আলাদা একটা ব্লগ লেখার ইচ্ছা আছে। আশাকরি সময় বের করতে পারবো।
ভেগাস শেষ করে লস এঞ্জেলসে গেছিলাম। সেখানে আরেক বিরাট কাহিনি, কিন্তু আজকে আর লেখা বাড়ানোর ধৈর্য হচ্ছে না। আরেকদিন লিখবো।
সবাই ভালো থাকবেন। আপাতত আমি ভাগি
সুন্দর শেষ। লস এঞ্জেলসটা পড়ার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।
আচ্ছা, জ্যাক সাকি নিয়া রাস্তায় কী করে?
আমারও শখ ছিলো বড় হয়ে লাসভেগাস যামু।কিন্তু আপনার কাহিনী পড়ে যাওয়ার সাধ মিটে গেল। হুদাই কামে টাকা পয়সা খরচ।তয় আপনারে একদিন পাইলে কপালে কপাল ঘসে নিমু।মানুষ এত কিছু পায় কেমনে????
হলিউডের কাহিনী তাড়াতাড়ি জানান আর আপনার সিনেমা কবে মুক্তি পাচ্ছে?
মামুন ভাই------------------অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার লেখায় ভার্চুয়ালী বেরিয়ে এলাম লাস ভেগাস।
ভালো থাকুন আর আরো লিখুন।
ভাল্লাগছে।
সেই সাথে পাপের শহরে যাওয়ার শখও মিটে গেলো।
বুঝলাম, নেহায়েত ভালো জায়গা না। বড়ই খারাপ। যাইতে ইচ্ছা করতাছেনা। লেখা ভালো হৈছে। থ্যাংকু।
ধুর , কত্ত কি ভাবছিলাম ভেগাস কে !!! যামুই না আর ।
এই পুষ্ট রোজার মইদ্যে দিলেও কিছু হইতো না এর থেইকা হিন্দি সিনেমা অনেক খুল্লাম খুল্লা
যথেষ্ঠ পয়সা আর পয়সা উড়ানোর মানসিকতা না থাকলে ভেগাস যাওয়ার ফায়দা নাই
হ, অন্য কেউ মেলা টাকা দিতো ফাও ফাও, উড়ানির লাইগ্যা, তাইলে গিয়া জুয়া খেইল্যা বড়লোক হৈয়া যাইতাম, লাস ভেগাসে।
কেউ স্পনসর করবো নি?
জুয়ায় যা জিতুম, তার থেইকা বনিয়োগ কারীকে ২০% দিমু, হারলে আসলও বাদ!!
দারুণ ভাই।

আমিও বড় হয়ে আপনার মত লাস ভেগাস নিয়া ব্লগ লেখুম আর সেখানে মেলা ছবি দিমু। তয় আমি আপনার চাইতে আরো উদার মনে ছবি দিমু
ভেগাস পুরাই ভোগাস । আফসুস
মামুন ভাই, আমি ভাবছিলাম যে আপ্নারে বলি, ভেগাস নিয়ে কিছু দিলে তাড়াতাড়ি দেন। কারণ কয়দিন পর রোজা আসতেসে। তো আপ্নে আগেই দিয়ে দিছেন। ভালো, গ্রেট মেন থিংক্স এলাইক।
পোস্ট মজারু হইসে। লাস ভেগাস যাইতে চাই। টিপ-টুপ নিয়ে খাচরামি বা অযথা টাকা খরচ, এগুলা ব্যপার না। জায়গাটার ছবি যা দেখলাম, মুভিতে আরো যা দেখি; আমার যাইতেই হবে। তয় শুধু ভেগাসে না, আরো অনেক জায়গায় যাইতে হবে।
আপ্নারে হালকা হালকা হিংসা হয়।
সবাইরে অসংখ্য ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়া এবং মন্তব্যের জন্য। আমি আবারও দুঃখিত সবাইকে আলাদাভাবে ধন্যবাদ দিতে পারলাম না
মামুন ভাই, কৈ আপনি? কিজন্য খুঁজতেসি বুইঝা লন।
ইয়ে, নক দেয়ার উদ্দেশ্যেই আইসিলাম। কিন্তু পোস্টে ঢোকার মুখে হার্লে-ডেভিডসন দেইখা মেজাজ আবারো হালকা হিংসায় বিলা হৈল।
অবশ্য আপনে তো আর চালাইতেসেন না, তাই এইডা নিয়া আপনারে হিংসা কৈরা লাভও নাই। তাও করতেসি। ভালবাইশা একটা মানুষরে হিংসা করার ভিত্রেও মজা আছে।
মন্তব্য করুন