আধুনিক ঈশপের গল্প
সেই গল্পটা মনে আছে? সেই যে ঈশপের মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পটা। এক রাখাল বালক প্রতিদিন বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে বলে চিৎকার করত আর গ্রামের সব মানুষ ছুটে আসত তাকে বাঁচানোর জন্য। রাখাল বালক মানুষের নির্বুদ্ধিতা দেখে হাসত, আর নিজেকে খুব চালাক মনে করত। কিন্তু যেদিন সত্যি সত্যি বাঘ আসল আর সে শত চিৎকার করার পরও সবাই এটাকে দুষ্টুমি ভেবে কেউ তাকে বাচাঁতে আসল না সেদিন সে তার জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছিল সে মোটেও বুদ্ধিমান ছিল না। এই গল্প জানে না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব এক কাজ। তাহলে আপনারা ভাবছেন সবার জানা গল্প নতুন করে আবার বলে আপনাদের কেন বিরক্ত করছি? কারণটা বলছি, তবে তার আগে বলে নেই আমরা কিন্তু জানা কথাটাই বারবার ভুলে যাই, আর বিপদে পড়ি। এবার আসল ঘটনাটি বলি।
সন্ধ্যায় ঘরে বসে টিভি দেখছিলাম, এমন সময়ে চিৎকার শুনতে পেলাম। ভাবলাম বাইরে গিয়ে দেখি কিসের জন্য এত চিল্লাফাল্লা। বাইরে বেরোতেই দেখি তৌহিদও বেরিয়ে এসেছে, ওকে জিজ্ঞেস করলাম-"কিসের চিল্লাচিল্লি বুঝতে পারতাছস?" একটু কান পেত শুনতেই বুঝতে পারলাম কোথাও আগুন লেগেছে। ব্যাস, আর সাত-পাঁচ না ভেবে দিলাম এক দৌড়। কদিন আগেও আমাদের এলাকায় আগুন লেগে দশ-বার ঘর পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেছে। ঐ পরিবারগুলো এখনো খোলা আকাশের নিচে রাত পার করছে। অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা কিছুদিন আগেই স্বচক্ষে দেখেছি, তাই সাত-পাঁচ না ভেবেই আমরা কয়েকজন দৌড় দিলাম। এই অন্ধকার রাতে কোথা দিয়ে দৌড় দিয়েছি কিছুই খেয়াল করিনি। প্রায় দশ মিনিট কলাবাগানের ভেতর দিয়ে এলোমেলোভাবে দৌড়াদৌড়ি করে এখানে সেখানে ঠোকর খাওয়ার পরে রাস্তায় উঠলাম। রাস্তায় এসে চিল্লাচিল্লির উতস লক্ষ করে দিলাম আরেক দৌড়। প্রায় দশ মিনিট আধা মাইল রাস্তা দৌড়ানোর পর ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি চারদিকে যত দূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ, কিন্তু আগুন নেই! আশেপাশে যত মানুষ আছে সবাই ছুটে এসেছে। ব্যাপার কী? কেউ আসল ঘটনা বলতে পারছে না। যাকেই জিজ্ঞেস করি সেই বলে চিলে কান নিয়েছে শুনে কানে হাত না দিয়েই চিলের পিছনে ছুটে এসেছে। এসে দেখে কিসের কি, চিলও নাই, কানও খোয়া যায়নি, কান কানের জায়গাতেই আছে। সবাই আমরা কাল্পনিক চিলের পিছনেই দৌড় দিয়েছিলাম। এ ধরনের ব্যাপারে এ ছাড়া উপায়ও থাকে না। যদি দেখতে যাই সত্যি সত্যি আগুন লেগেছে কিনা তাহলে দেখতে দেখতেই সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তাই অনুমানের উপরেই কষ্ট করে হলেও দৌড় দিয়েছিলাম। এবার ঘটনার তদন্তে লাগলাম। আশেপাশের বাড়ির মেয়েদের জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছিল। ওরা বলল কলাবাগানে কয়েকটা কলাগাছে কে জানি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, তা থেকেই এত বড় ঘটনা। বুঝলাম নিশ্চয়ই কিছু ছেলেপেলে মজা করার জন্য সুকীর্তিটি করেছিল, পরে অবস্থা বেগতিক দেখে ওরা কেটে পড়েছে। সমস্ত ইতিহাস শোনার পর আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্দ হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। ফেরার পথে দেখলাম এখনো দলবেঁধে মানুষ আসছে। কাজটি মজা করার জন্য করলেও এর প্রভাব কিন্তু নেতিবাচকই হয়েছে। আজ আগুন লাগার কথা শুনে তা নিভানোর জন্য যত মানুষ এসেছে আরেকদিন কিন্তু মানুষ এভাবে আসবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আসলেও তারা যে অনেক গড়িমসি করে নিশ্চিত খবর পেয়ে আসতে চাইবে তাতে কিন্তু কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে এক সেকেন্ডের দেরিও কিন্তু অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আমাদের উচিৎ এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম না দেয়া। আজকের এ ঘটনা থেকে অনেক বড় একটা শিক্ষা পেলাম। জীবনেও এ ধরনের মজা করতে যাব না। আমার বয়সী বা আমার কাছাকাছি বয়সী ছেলেরাই মজা করার জন্য এ ধরনের কাজ করে থাকে। আমার এই লেখাটা তাদের জন্য। একবার ভেবে দেখুন আমরা যদি সেই রাখাল বালকের মত পরিস্থিততে পড়ি তাহলে কি অবস্থা হবে। চিন্তা করতেও আমার গা শিউরে উঠছে।
আজকের এ ঘটনাটি আপনাদের কাছে খুবই ছোট ও গুরুত্বহীন মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে মোটেও ছোট বলে মনে হচ্ছে না। কারণ এভাবে মজা করতে করতেই কখন যে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমাদের কাছে গুরুত্ব হারায় আমরা তা টেরও পাই না। আর তার মূল্য দিতে হয় অপূরণীয় ক্ষতির মাধ্যমে। হুমায়ূন আহমেদে "এলেবেলে" প্রবন্ধে একটা কথা বলেছিলেন, আমার হুবহু মনে নেই; তবে কথাটা অনেকটা এরকম-
"রসিক মানুষরা অত্যন্ত দুঃখের কথা বললেও সবাই সেটা নিয়ে মজা করে, মানুষ ভাবে এটাও তাদের রসিকতা। আমার এক বন্ধু খুবই রসিক। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম তার খবর কি। তখন সে চোখমুখ করুণ করে বলল-'কয়েকমাস ধরে চাকরি নেই, প্রায় না খেয়ে থাকি, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন দিতে পারি না।' একথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল, যেন না খেয়ে থাকার চেয়ে মজার কোন ঘটনা পৃথিবীতে নেই।"
এই হচ্ছে সবসময় রসিকতা করার ফল। তাই আমি আবারো আপনাদের অনুরোধ করে বলছি আপনারা এ ধরনের ঘটনা তো ঘটাবেন না-ই, এর সাথে সাথে যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটনা ঘটাতে চায় তাদেরকে নিবৃত্তও করবেন। এ লেখা পড়ে একজনও যদি সচেতন হন তাহলেই আমি সার্থক।
ওতো রসিক মানুষ হয়ে কাজ নাই।
ওতো রসিক মানুষ হয়ে কাজ নাই।
মন্তব্য করুন