ম্যাঙ্গো পিপল এবং আমের "আঁটিখেলা "
বাড়িতে শেষ দিনটা কাটালাম আজ। আক্ষরিক অর্থেই শেষ দিন কাটালাম, ভাবতেও অবাক লাগে সারা দিন বাড়িতে কাটানোর পর এখন রাত বারটায় শুয়ে আছি বাড়ি থেকে আশি কিলোমিটার দূরে! আমি বাড়িতে যেমন যাই হুট করে কোনরকম পূর্বাভাস না দিয়ে, তেমনি বাড়ি থেকে চলেও আসি হুট করে। অর্ধদিবস হরতাল ছিল, তাই গাড়িতে উঠলাম বিকাল পাঁচটায়, কিন্তু ড্রাইভার শুরু করল ফাইজলামি, প্রায় এক ঘন্টা বসিয়ে রাখার পর বাস ছাড়ল। হরতাল দিলে যেন এদের ঈদ লাগে, পাঁচ টাকার ভাড়া পঞ্চাশ টাকা হাঁকিয়ে বসে, ভাব এমন যাইলে যাও, না গেলে ফুট। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও বেশিরভাগ সময় এদেরকে রাজি করানো যায় না। ইচ্ছে করে জুতিয়ে ওদের আর পিশাচ রাজনীতিবদগুলোরর মুখ আর পিঠের ছাল উঠিয়ে দেই, কিন্তু আমাদের কিচ্ছু করার ক্ষমতা নাই, ওদের চুলটা পর্যন্ত ছিঁড়তে পারি না। আমরা হইতাছি ম্যাংগো পিপল, মানে আম জনতা। আমাগোরে ওরা আমের মত চুইষা চিপ্যা র তো খায়-ই, এর পরেও ছাড়ে না। ছোটবেলায় আমের রস চিপে খাওয়ার পর তার আঁটি দিয়ে এক ধরনের খেলা খেলতাম, খেলাটার নাম মনে নাই, তবে আপাততঃ "আঁটি খেলা"-ই ডাকি। খেলাটায় আমের আঁটিগুলোর উপর নির্মম অত্যাচার হত। খেলার কেন্দ্র থাকত একটা বৃত্তাকার ঘর, খেলায় যে হেরে যেত তার আমের আঁটিকে পালাক্রমে সবাই তার নিজ নিজ আঁটি দিয়ে আঘাত করত। বিজয়ী আঁটির আঘাতে পরাজিত আঁটি দূরে ছিটকে পড়ে আর আঁটির মালিক হাতের কনুই দিয়ে আঁটিটি বৃত্তাকার ঘরে ফেলার চেষ্টা করে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে সফল হবে না ততক্ষণ তার রেহাই নেই। এভাবে একে একে সবাই পরাজিত ব্যাক্তিকে মহা উল্লাসে শাস্তি দেয়। কিছু কিছু ছেলে ছিল যারা "কনুই খাটানোতে" ওস্তাদ ছিল। ওরা একবার কাউকে ধরলে ওকে একেবারে কাঁদিয়ে ছাড়ত, শেষমেষ পরাজিত ছেলেটি সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যেত। এ খেলায় বিজিত ও বিজয়ী উভয় আমের আঁটির উপর যে অমানুষিক নির্যাতন হয় তাতে আমার মনে হয় ওদের যদি প্রাণ থাকত আর পরজন্ম বলে কিছু থাকত তাহলে ওরা পরজন্মে ভুলেও আমের আঁটি হয়ে জন্মাতে চাইত না। আহারে বেচারা আমের আঁটি! ওদের দুরবস্থার কথা ভেবে এখন মায়া লাগে। আঁটিগুলো মনে হয় দিনরাত প্রতি মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তার কাছে এ অবস্থা থেকে মুক্তি চাইত। খোদা মনে হয় ওদের দোয়া কবুল করেছেন, কারণ আজকাল আর "আঁটিখেলা" চোখে পড়ে না। তাতে আঁটিরা বেঁচে গেলেও, আমরা ম্যাঙ্গো পিপলরা কিন্তু নিস্তার পাইনি।
আজ বহুদিন পর "আঁটিখেলা"র কথা মনে পড়ছে। কারণ দেশের "সুশীল সমাজের" হর্তাকর্তারা এখনো আমাদের ম্যাংগো পিপলদের চিপে, চুষে রস বের করে খাচ্ছেন, এরপর আমাদের আঁটিগুলোকেও রেহাই দিচ্ছেন না। "আঁটিখেলা"র মত করে সবাই আমাদের নিয়ে খেলছে। "আঁটিখেলা"য় যেমন সবাই আমের আঁটিগুলোকে ইচ্ছেমত অত্যাচার করতাম, তেমনি করে অমানুষগুলো আমাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে দুই-তিনদিন হরতাল দিয়ে দেশ অচল করে দিচ্ছে, পাখির মত মানুষ মারা যাচ্ছে। ভাবটা এমন ছয়-সাতজন মানুষ মারা না গেলে কিসের হরতাল, কিসের আন্দোলন। অথচ হরতালে প্রাণ যায় আমাদের ম্যাঙ্গো পিপলদেরই, কিন্তু হরতাল বা আন্দোলনের ডাক দেন তাদের কারো একটা চুলও ছিঁড়ে না। কখনো কি কেউ দেখেছি রাজনৈতিক দলগুলোর বড় বড় নেতারা অথবা তাদের ছেলে-পেলে কেউ হরতাল বা কোন আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে নিরাপত্তা ছাড়াই মাঠে নেমে এসেছে? যদিওবা আসে তাহলে সামনে-পিছে-ডাইনে-বাঁয়ে নিরাপত্তার চাদরে ঘেরাও হয়ে আসে। অথচ এরাই আমাদেরকে চরম নিরাপত্তাহীন অবস্থায় আন্দোলনের নামের "মৃত্যুকূপের" দিকে ঠেলে দিয়ে মজা করে সার্কাস দেখে আর অপেক্ষা করে কখন কেউ মারা যাবে আর তার সুযোগ নিয়ে প্রতিপক্ষের প্রতি বিষোদগার করবে আর নোংরা রাজনীতি শুরু করবে। ম্যাঙ্গো পিপলদের ছোবড়া বানিয়ে যে টাকার পাহাড় এরা গড়ে তা দিয়ে ওদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করবে বিলেতে, মেরিকায় আর আমাদের ছেলে-মেয়েরা শ্রেণীকক্ষের অভাবে খোলা আকাশের নিচে পড়বে অথবা চল্লিশজনের কক্ষে আশি জন ক্লাশ করবে, টাকার অভাবে পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে পারে না। ওদের ছেলে-মেয়েরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যায় গাড়ি হাঁকিয়ে, আর আমাদের ছেলে-মেয়েদের ভাল স্কুলে ভর্তি হতে হয় লটারির মাধ্যমে, সেখানেও দুর্নীতি নামের ভূত ওদের রেহাই দেয় না। ওরা আমাদের টাকা দিয়ে প্রতিবছর ঈদের শপিং করতে চলে যায় ইন্ডিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, আর আমাদের লাখো বাবা তার সন্তানকে ঈদের সময় ফুটপাত সামান্য জামা কিনে দিতে পারেন না, লাখো মা ঈদের দিন সন্তানের মুখে একটু ভাল খাবার তুলে দিতে পারেন না। এরাই এমপি-মন্ত্রী হয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর রাস্তায় চলার সময় সব যানবাহন বন্ধ করে হুইসেল বাজিয়ে চলে যায়, আর আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে পড়ে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ওদেরকে অভিশাপ দেই।
আমের আঁটিগুলোর প্রারথনা কবুল করে সৃষ্টিকর্তা ওদেরকে মুক্তি দিয়েছেন, কিন্তু আমাদের ম্যাঙ্গো পিপলদের মুক্তি নেই। আমের আঁটি মুক্তি পেয়েছে কারণ ওদের সব সবাই একসাথে নিজেদের মুক্তির জন্য প্রারথনা করেছে, ওরা সবাই মিলে এক ছিল, ওদের মাঝে কোন বিভেদ ছিল না। আমাদের মাঝে এত বিভেদ, কুটিলতা দেখে বিধাতাও হয়ত আমাদের ভয় পান, তাই আমাদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রেখেছেন, আমরা জানিনা কিভাবে বধাতার নজর নিজেদের দিকে ফিরানো যায়, জানতেও চাই না; তাইতো বিধাতা আমাদের দিক দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছেন। জানি আমার কথাগুলো কারো ভালো লাগেনি, সবাই আমাকে হতাশাবাদী বলবেন। আমারও এসব হতাশার কথা বলতে লাগে না। কিন্তু কি করব বলুন, মাঝে মাঝে ভন্ডদের ভন্ডামি দেখে এত অভিমান হয় যে নিজের অজান্তেই মনের ভেতরে আজন্মলালিত ক্ষোভ, দুঃখগুলো লেখা হয়ে বেরিয়ে আসে। এই যে দেখুন না আজ দিনপঞ্জি লিখতে বসে কি লিখে ফেললাম, ধান ভানতে শিবের গীত। আমি আশাবাদী; আশাবাদী আমরা তরুণরা একদিন দেশকে জঞ্জালমুক্ত করব। আমি আশাবাদী একদিন আমাদের মাঝে কোন বিভেদ থাকবে না। আমি আশাবাদী সবাই আমরা আমের আঁটি হয়ে উঠব।
আমি আশাবাদী একদিন আমাদের মাঝে কোন বিভেদ থাকবে না। আমি আশাবাদী সবাই আমরা আমের আঁটি হয়ে উঠব।
কি আশায় বাধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে
(
মন্তব্য করুন