আশরাফুলঃএক হতাশার, এক স্বপ্ন ভঙ্গের কাব্য
জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই ক্রিকেটের সাথে পরিচয়, আর জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই ক্রিকেটের সাথে প্রেম। মনে ১৯৯৯ সালে অভিষেক বিশ্বকাপেই যখন বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানকে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে তখন আআআমার পাঁচ কি ছয় বছর। সেদিনের ছোট্ট আমি কিছু না বুঝেই বড়দের সাথে বাঁধহীন উল্লাসে মেতে উঠেছিলাম। তখন থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রায় প্রত্যেকটি জয়-পরাজয়ের সাক্ষী হয়ে আছি। ক্রিকেটারদের সাফল্য-ব্যর্থতায় হেসেছি-কেঁদেছি। সাক্ষী হয়ে আছি ২০০৪এ ভারতকে মাটিতে নামিয়ে আনা জয়ের, ২০০৫এ জিম্বাবুয়ে, অস্ট্রেলিয়া বধ, ২০০৬এ শ্রী-লঙ্কান সিংহকে খাঁচায় পুরা, কিংবা ২০০৭ বিশ্বকাপের অবিস্মরনীয় সাফল্যের। শুধু দলের ভাল সময়ে আনন্দ করেছি তাই নয়, দল যখন খারাপ খেলেছে তখন মন খারাপ করেছি, কিন্তু গালি দেইনি; আশায় বুক বেধেছি পরের খেলার জন্য। গত বছর ২২'শে মার্চ যখন এশিয়া কাপের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে মাত্র ২ রানে হেরে যাই তখন সবার সাথে আমিও চোখের পানি ফেলেছি; সেই সাথে তাদের জন্য গর্বও অনুভব করেছি আমরা ১৬ কোটি বাঙ্গালী। এরকম হাজারো আনন্দের-গর্বের আমৃতি আমাদের উপহার দিয়েছেন ক্রিকেটাররা। হাজার দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত, দারিদ্র্য, দুর্নীতি, হিংস্র রাজনীতির কশাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত বাংলার মানুষকে উতসবের উপলক্ষ্য এনে দিয়েছে ক্রিকেট দল। এই ক্রিকেটের এমনই শক্তি যে আমাদের রাস্তায় নামিয়ে এনেছে মধ্যরাতেও। যে দুই রাজনৈতিক নেতা একজন আরেকজনের ছায়া পর্যন্ত মাড়ান না তাদেরকে এক বিন্দুতে মিলিয়েছে ক্রিকেট। যারা দেশের বাইরে থাকেন সেই প্রবাসীরাও বলেন দেশের বাইরে তাঁদের সবচেয়ে গর্বের জায়গা এই ক্রিকেট। আর কোন খেলা কবে এভাবে এই জাতিকে এক সুতায় গাঁথতে পেরেছে? অথচ এই ক্রিকেট থেকেই কিনা এযাবতকালের সবচেয়ে বড় আঘাতটা এল!
অনুভূতিগুলো সব ভোঁতা হয়ে গেছে। যে আশরাফুল বাংলাদেশের ক্রিকেটে এসেছিলেন রূপকথার রাজপুত্র হয়ে সেই আশরাফুল-ই কিনা হয়ে গেলেন রূপকথার রাক্ষস-খোক্কস! ক্ষোভ, অভিমানে স্তব্বধ হয়ে গিয়েছি। কত কত আনন্দের মুহূর্ত এনে দিয়েছেন এই আশরাফুল! আশরাফুলের ব্যাট কতবার শিহিরণ জাগিয়ে উতসবের উপলক্ষ্য এনে দিয়েছে আমাদেরকে তার কোন হিসেব নেই। আশরাফুল যে কবে, কখন, কীভাবে চেতনায় মিশে গিয়েছিলেন তা এখন আর মনে পড়ছে না। দেশের ক্রিকেটীয় সামর্থ্য যখনই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে ঠিক তখনই অবতারের মত আবির্ভাব হয়েছে আশরাফুলের, এক একটি মহাকাব্যিক, শিহরণ জাগানো জয় উপহার দিয়ে জবাব দিয়েছেন সব সমালোচনার। দেশের ক্রিকেটের সর্বকালের সবচেয়ে প্রতিভাবান ক্রিকেটার হয়েও যে তিনি সে প্রতিভার যথার্থ ব্যবহার করতে পারেননি তার জন্য আপামর ক্রিকেটপ্রেমী, ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের আফসোস থাকলেও তাঁর প্রতি ছিল না কোন রাগ, ক্ষোভ বরঞ্চ ছিল সহানুভূতি, সহমর্মিতা, ভালবাসা। কিন্তু আজ এক ফুতকারে সব ভালবাসা, সহানুভূতি উড়ে গেলো। এতদিন একটা গর্ব ছিল আমাদের ক্রিকেট ফিক্সিংমুক্ত বলে, কিন্তু সেই দর্প যে এভাবে চুরমার হয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
একজন ক্রিকেটেরের জীবনের সেরা খেলা নাকি আসে ২৮-৩২ বছর বয়সের মধ্যে। সেই হিসেবে ২৯ বছর বয়সী আশরাফুলের এখন সময় ছিল মাঠ মাতিয়ে বেড়ানোর; সেই ইঙ্গিতও পেয়েছিলাম গত শ্রী-লঙ্কা সফর থেকেই। অথচ এখন কিনা অ্যাশকে সামলাতে হচ্ছে চারদিক থেকে আসা প্রশ্নবাণ, মানসিক অত্যাচার! এমন তো কথা ছিল না অ্যাশ! কথা তুমি ক্রিকেট মাঠে একেকটা মহাকাব্য রচনা করবে, আর আমরা তোমার স্তুতিতে মাতব। শ্রী-লঙ্কার সাথে যেদিন ১৯০ করেছিলে বড় আশায় বুক বেঁধেছিলাম পরেরদিন সকালেই তুমি দেশের যোগ্যতম প্রতিনিধি হিসেবেই দেশের হয়ে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি করবে আর আমরা সবাই মিলে তোমার বন্দনায় মাতব। কিন্তু পরেরদিন তুমি ডাবল সেঞ্চুরি না পেলেও আশায় বুক বেঁধেছিলাম-তোমার মাপের খেলোয়ারের জন্য ডাবল নয় ট্রিপল সেঞ্চুরি অপেক্ষা করছে বলে। আর কেউ বিশ্বাস না করলেও আমি বিশ্বাস করতাম তুমিই প্রথম ৩০০ করবে। সেই স্বপ্ন বুঝি স্বপ্নই রয়ে গেল। বাস্তবতা যে বড়ই নিষ্ঠুর!
মাথায় একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসছে-আশরাফুলের ক্যারিয়ার তো শেষ হয়ে গেল, কিন্তু যারা তাকে এই অন্ধকার জগতে টেনে নিয়ে গেছে তাদের কি কিছুই হবে না? ফিক্সিং কেলেংকারিতে শাস্তির খড়গ মাথায় নিয়ে শেষ হয়ে যাবে একজন আশরাফুলের ক্যারিয়ার, কিন্তু জুয়ারিদের কপালে কি আদৌ কোন শাস্তি জুটবে? এই জুয়ারিদের খপ্পরে পড়ে শেষ হয়ে গেছে আজহারউদ্দিন, হ্যান্সি ক্রোনিয়ে, সালমান বাট, আসিফদের মত খেলোয়ারের ক্যারিয়ার, কিন্তু জুয়ারিদের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি কেউ। ওদের একটা চুলও ছিঁড়তে পারেনি কেউ। বারাবার আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বগল বাজাতে বাজাতে সেলিম চৌধুরীরা সর্বনাশ করে গেছে একের পর এক খেলোয়ারের। সেলিম চৌধুরীরা খেলোয়ারদের পাপের পঙ্কিল সমুদ্রে গায়ের জোরে টেনে নামিয়ে নিজেরা রয়ে গেছে নিরাপদ দূরত্বে। খেলোয়াররা সেই অন্ধকার জগতে ঢুকতে না চাইলেও ক্যারিয়ার নষ্টের হুমকি ধামকি দিয়ে বাধ্য করেছে কুকর্মে লিপ্ত হতে। কিন্তু শেষমেষ কলঙ্ক আর শাস্তির সবটুকু ছিটা লেগেছে শুধু আশরাফুলদের গায়েই, মালিকদের কিছুই হয়নি। কি আর হবে, বড়জোর ফ্রাঞ্চাইজি বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু এতে তাদের কি এসে যায়? ওরা আবার খোলস বদলে নতুন দলের মালিক হবে নতুন আশরাফুলদের টেনে আবার পাপের সাগরে ডুবাতে। কলঙ্ক আর শাস্তি তা শুধু আশরাফুলদের জন্যই, কলঙ্কের কালিমা মুখে লেপন করবেন আশরাফুলরা, শাস্তির খড়গ মাথায় নিয়ে দেশের ক্রিকেট থেকে ঝরে যাবে আশরাফুলরা, আর এমন মজার সার্কাস দেখে সঙ্গী সাথী নিয়ে আনন্দে বগল বাজাবে সেলিম চৌধুরীরা। তবে কি আইন শুধু খেলোয়ারদের জন্যই, যারা তাদেরকে ফাঁদে ফেলে এসব ঘৃণ্য কাজ করিয়েছে তাদের জন্য কোন আইন নেই? নাকি ওরা পকেটে ডলারের খনি নিয়ে ঘুরে বলে ওদের গায়ে আইনের বাতাসও লাগে না? জানি এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত কেউ নেই, আসলে কারো সাহসই নেই। তাই কলংকের দায় মাথায় নিয়ে চিত্রপট থেকে মুছে যাবে এক আশরাফুল, দৃশ্যপটে আবির্ভাব হবে আরেক আশরাফুলের, কিন্তু বহাল তরিয়তে থেকে যাবে অন্ধকার জগতের সম্রাটরা। আর আমরা তো অনেকদিন আগে থেকেই সাক্ষীগোপাল হয়ে আছি, এখনো সাক্ষীগোপাল হয়েই দীর্ঘঃশ্বাস ফেল্ব আশরাফুলদের নিয়তির জন্য, আর সেলিম চৌধুরীদের অভিশাপ দিয়ে যাব। আমাদের আমজনতার এর বেশী কিছু করার সামর্থ্যও নেই, বোধহয় ইচ্ছেও নেই।
একটা সময় ছিল দেশের ক্রিকেট পুরোটাই ছিল আশরাফুলময়, আশরাফুলের ব্যাট হাসলেই হাসত সারা দেশ। আজকের সাকিব-তামিম-মুশফিক-নাসিররা তারা হয়ে উঠেছেন মাত্র পাঁচ-ছয় বছর আগে। এর আগে সারা দেশের প্রত্যাশার ভার একাই বহন করতে হয়েছে অ্যাশকে। জানি কথাটা হাস্যকর শুনাবে, কিতু এটাই সত্যি-অভিষেকের পর থেকে প্রায় এক দশক আশরাফুলকে বইতে হয়েছে শচিনের সমান প্রত্যাশার বোঝা। আজ আশরাফুল ফিক্সিং কেলেংকারিতে কলংকিত-এটা যেমন সত্যি, তেমনি আগের বলা কথাগুলোও সত্যি। দেশের ক্রিকেটে অ্যাশের এত এত অবদানের কথা কীভাবে ভুলে যাই? তাই হাজার চেষ্টা করেও অ্যাশকে গালি দিতে পারলাম না, থেকে থেকে বুকের ভেতর থেকে কষ্ট, হতাশা, অভিমান, দুঃখগুলো কেবল দীরঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসছে।
সবশেষে আশরাফুলের জন্য একরাশ হতাশা, আফসোস আর অভিমান(কেন জানি আশরাফুলকে ঘৃণা জানানোর সাহস আমার হচ্ছে না, মনও কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। হাজার হলেও এই ছেলেটাই আমাদের প্রথম বড় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল, বিশ্ব ক্রিকেটকে জানিয়েছিল আমাদেরও সামর্থ্য আছে। এই আশরাফুলই প্রায় দশক ধরে দেশের ক্রিকেটের প্রতীক হয়ে বইছিলেন দেশের ক্রিকেটের ঝান্ডা, তাই আর যাই হোক অ্যাশকে ঘৃণা জানানোর সাহস অন্ততঃপক্ষে আমার নেই।) জানিয়ে এবং সেলিম চৌধুরীদের হৃদয় নিংড়ানো ঘৃণা জানিয়ে আমিও আমজনতার দায়িত্ব পালন করে শেষ করছি। চারদিক কেমন জানি ঝাপসা হয়ে আসছে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে নাকি? জানিনা, জানতেও চাই না।
আপনার লেখার সাথে আবেগ অনুভূতি বাস্তবতা সবদিক থেকেই একমত। আর অসাধারন উপস্থাপনার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ও নিজেকে ছোট করব না। আশারাফুল যখন কাদছিল তখন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমার কাছে সেটাকে বৃষ্টি মনে হয়নি, মনে হয়েছে, আশরাফুল তার ভক্ত ও আপামর ক্রিকেট ভক্তের সাথে বাংলার আকাশ ও তার অশ্রু সংবরণ করতে না পারায় অঝোরে ঝরছে।
খুবই যুকতি দিয়ে ভেবে লেখা
(
আমাদের জতীয় অ্যালবামে কেউ চিরকাল শ্রদ্দজা-ভালবসায় সিক্ত হয়ে থাকার স্বংস্কৃতি নাই । হবেওনা কোনদিন । বংগবন্ধুছন সর্বকালের শ্ রেষ্ট বাংগালী, হয়েরইলন জাতীয় ইতিহাসে১ম ডিক্টেটর । জিয়া ছিলেন নন্দিত মুক্তিযোদধা, রাষটপতি হয়ে বনে গেমলেন রাজাকার-দোসর ।
একদম খাঁটি কথা
আশরাফুলের ঘটনাটা খুব আঘাত দিয়েছে। তবে এতে করে আমার আশরাফুলপ্রীতি ও বাংলাদেশপ্রীতি কমবে না কোনো অংশেই। এখনও বাংলাদেশের খেলা আগে মতো জোশের সঙ্গে দেখার আগ্রহই পাচ্ছি। মনে হচ্ছে একটু বেশি বেশিই পাচ্ছি। এ যেন নেগেটিভ মার্কেটিং কিন্তু সাকসেসফুল মার্কেটিং!
আশরাফুল একটা অন্ধ আবেগের নাম। ওর অন্যায় সহ্য হচ্ছে না কিন্তু যে রাগ বা ক্ষোভ আসা উচিত, তার তিলমাত্রও নেই মনে!
আশরাফুল বাংলাদেশ ক্রিকেটে একজনই। আসেনি, আসবে বলেও মনে হয় না। আসে ও যদি, দুর্বল, হারে হারে জর্জরিত একটা দল আর তাদের অন্ধ সমর্থনে থাকা লাখ লাখ মানুষকে এক একটা চার আর এক একটা ছয়ে অসম্ভব আর অভাবনীয় এক একটা জয় উপহার দেয়ার সুযোগ সে পাবে কোথায়!
মন্তব্য করুন