মা
“তোমার কি মনে হয়, আত্মহত্যা করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?”
মৃত্তিকার পেছন থেকে অচেনা নারী কণ্ঠ। একজন মধ্যবয়স্কা দাঁড়িয়ে। পরনে সবুজ শাড়ি, চুল উষ্কশুষ্ক, চোখের নীচে কালি পড়া, ঠোঁটে অম্লান মৃদু হাসি।
“এছাড়া তো আমার আর কোন পথ নেই”, কোনদিকে না তাকিয়েই উত্তর দিল মৃত্তিকা।
“কী আর এমন হয়েছে তোমার?”, নারীকণ্ঠের ব্যঙ্গাত্বক জিজ্ঞাসা।
“এর চেয়ে খারাপই বা কী হতে পারে?”
“তুমি অবহেলিত?”
“যাকে জীবনে সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছিলাম তার কাছেই।”
“এই মানুষটিই কি তোমাকে ছোট থেকে বড় করেছে? ভালোবাসতে শেখার উপযোগী করে তুলেছে?”
“ভালোবাসতে শিখেছি বলেই সে এসেছে।”
“সেটাই স্বাভাবিক। ভালোবাসতে জানলেই তারা কাছে আসে। সম্পদের পাহাড়ই তাদের একমাত্র কাম্য।”
“সম্পদের তো ওর অভাব ছিল না!”
“এ জগতে হায়, সেই বেশি চায়, যার আছে ভুড়ি ভুড়ি,
রাজার হস্ত করে, সমস্ত কাঙ্গালের ধন চুরি।
আমরা কাঙ্গালের চেয়ে কম কিসে?”
“তুমিও কি আমার মত...”
“তুমি নির্যাতিত?”
“আগে কখনও ছিলাম না।”
“এই নির্যাতন নিশ্চয়ই ওই স্বার্থপর মানুষটির দ্বারা!”
“ও স্বার্থপর না। ও ভালোবাসতে জানে, তবু বাসেনা।”
“এটাই কি তোমার ওপর নির্যাতন?”
“এই শাস্তিই তো সহ্য করা যায় না।”
“প্রত্যেকের কষ্টই তার নিজের কাছে বড়। তবে...”
“তবে কী?”
“লক্ষ কোটি সন্তানের জন্য এই কষ্টের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা যায়।”
“সন্তান!”
মৃত্তিকা চমকে উঠল। ছাদের কিনারা থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে তলপেটে হাত রাখল। জায়গাটা প্রসারিত হতে শুরু করেছে। খুব সাবধানে ধরে রাখল যেন কোন আঘাত দু’হাত ভেদ করে ঢুকতে না পারে।
“তুমি তো একেই মারতে চেয়েছিলে!” নারীকণ্ঠের অট্টহাসি।
“না, কখনোই না। ওর জন্মের আগেই নিজেকে শেষ করে ফেলতে চেয়েছিলাম।”
“তখন কি ও বেঁচে থাকত?”
“সেটা তো ভেবে দেখিনি!” মৃত্তিকার দীর্ঘশ্বাস।
“তুমি তো ধর্ষিতা নও?”
“তবে এটাতো ভালোবাসাও না, ভালবাসার নামে অভিশাপ।”
“এই নির্লজ্জ ভালোবাসাকেই যদি অভিশাপ বলো, তবে বাহুবলকে কী বলবে?”
“আজরাইল কিংবা যমরাজ!”
“আর গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানটি?”
“তুমি কি এই বাহুবলের শিকার?”
“একবার না, হাজার বার, লক্ষ বার।”
“তুমি তাহলে বেঁচে আছ কীভাবে?”
“সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে বাঁচতে হয়েছে। এদের ম্লান হওয়া হাসি আমার সহ্য হয়না। শুধু আমি না, পৃথিবীর কোন মায়েরই এই সহ্যক্ষমতা নেই।”
“আর এই সন্তানের জন্মদাতা?”
“এদের মাঝে পশুত্বটাই বেশি। তবে তোমার সন্তান তো আছেই এই পশুত্বকে দমন করতে!”
“এরাও যদি পশু হয়ে যায়।”
“মায়ের কাছে এই পশু সবসময়ই অসহায়।”
“আর যদি জন্মদাত্রীর জীবন ফিরে আসে কারো জীবনে?”
“আমিতো সবসময়ই আছি তাদের পাশে।
মৃত্তিকা দু’হাত দিয়ে তলপেট এখনও আগলে রেখেছে। গর্ভে হুটোপুটি খেলতে খেলতে বেড়ে ওঠা নিষ্পাপ ভ্রূণটির জন্য তাকে বেঁচে থাকতেই হবে। পশু হলেও সে তার বাবার পশুত্বকে দমন করতে পারবে একদিন। আর না পারলেও বা কী আসে যায়! একটি সন্তান তার মায়ের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার, যেমনটি মা তাঁর সন্তানের।
মৃত্তিকা পেছনে ফিরল, এতক্ষণ যে নারীর সাথে তার কথা হল তাঁকে সৌজন্যতার ধন্যবাদ দেয়া দরকার। তিনি জীবন বাঁচিয়েছেন মৃত্তিকার, তার সন্তানের।
পেছনে কেউ নেই। সেখানে পতপত করে উড়ছে লাল সবুজের পতাকা। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী আভায় কালচে সবুজের মাঝে লাল সূর্যের হাসিটাই সন্তানের জন্য মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার ঘোষণা দিচ্ছে। সন্তানের মুক্তির জন্য মা প্রস্তুত সবসময়, সবখানে।
মন্তব্য করুন