স্পর্শের বাইরে
সেদিন রাস্তার ধারে গুঁড়ের জিলাপী দেখে রোমেল ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। গুঁড়ের জিলাপী ওনার খুব প্রিয় একটা জিনিস। ঢাকা শহরের কোথায় কোথায় ভালো গুঁড়ের জিলাপী পাওয়া যায়, রোমেল ভাইয়ের তা মুখস্ত। উনি যে কতবার আমাকে নিয়ে সেসব জায়গায় নিয়ে গেছেন তার হিসেব নেই। এই জিনিস যে আমার খারাপ লাগে, তা কিন্তু না। সমস্যা হল গুঁড়ের জিলাপীর দোকানে রোমেল ভাই যান হেঁটে হেঁটে। আর তাঁর সাথে আমাকেও হাঁটতে হয়, যেটা আমার সবচেয়ে অপ্রিয় কাজ। শুধু যে ঢাকার ভেতরেই ‘গুঁড়ের জিলাপী অভিযান’ চলে, তা না। ঢাকার বাইরে বেশ কিছু জায়গায় আমরা গিয়েছি জিলাপী খেতে। সেই যাত্রাগুলো আরো ভয়ংকর। ঢাকায় অলি-গলি এমনিতেই বেশি, রোমেল ভাইয়ের জিলাপীর দোকানগুলো আবার এসব গলির শাখা-প্রশাখার ভেতর, যেখানে কোনভাবেই রিক্সা ঢোকা সম্ভব না। অবশ্য সম্ভব হলেও কোন লাভ হত না! রোমেল ভাইয়ের মতে কয়েক মাইল হাঁটার পর গুঁড়ের জিলাপী নাকি অমৃতের মত লাগে।আমার কাছে তো কোন কিছুই অমৃতের মত লাগে না। অমৃত কোনদিন খেয়ে দেখিনি তো! এই কথা কখনও রোমেল ভাইয়ের সামনে বলা যায় না। ওনার মতে অমৃতের স্বাদ পুরোপুরি নিজের কাছে। কেউ তামাক শলাকায় অমৃতের স্বাদ পায়, কেউ পায় গুঁড়ের জিলাপীতে। কিন্তু এই অমৃত গ্রহণ করেও কেন তারা মৃত্যুকে এড়াতে পারেনা, এর ব্যাখ্যা রোমেল ভাই কখনও দিতে পারেননি।
আমি হাফ কেজি গুঁড়ের জিলাপী কিনে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম, অথচ ফুটপাত ফাঁকা। গাড়িগুলো সব রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, কোনদিকে নড়াচড়ার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছেনা। প্রায় আধ ঘণ্টা বাসে বসে থাকার পর আমি নেমে পরেছি। আর লোকজন ঠাসাঠাসির মধ্যেও কি সুন্দর সিগন্যাল ছাড়ার অপেক্ষা করছে। অবশ্য তাদের হেঁটে রওনা না দেয়ারও একটা কারণ আছে। আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে। যেকোন সময় বৃষ্টি নামতে পারে। শীতল আশীর্বাদের বদলে তাদের কাছে উষ্ণ অভিশাপই হয়তো শ্রেয়!
জিলাপী খেতে খেতে আমি এগুচ্ছি। এখান থেকে হেঁটে বাসায় যেতে ঠিক কতক্ষণ লাগবে তার ধারণা আমার নেই। এতটা রাস্তা কোনদিন হাঁটিনি। হাঁটার কাজটা আমার অপছন্দের হলেও আজ কেন জানি হাঁটতে ভালোই লাগছে। এর মধ্যে দু’এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পরতে শুরু করেছে। ভাবছি, বৃষ্টি নামলে বৃষ্টিতে ভিজেই হাঁটতে থাকব। অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয়না!
রোমেল ভাইয়ের সাথে শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল, সেদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি তখন কাম্পাসে, কোন একটা গাছের নীচে বসে ইশিতার জন্য অপেক্ষা করছি। ইশিতা একটু অলস প্রকৃতির, হল থেকে বের হতে বেশ সময় নেয়। আমি তো ভয়ে ভয়ে আছি, কখন যে বৃষ্টি থেমে যায়! ইশিতার সাথে আর বৃষ্টিতে ভেজা হবে না।
রোমেল ভাইয়ের ফোন আসল তখনই।
“হ্যালো দাদা?”
রোমেল ভাইকে আমি দাদা বলে ডাকি। এই ডাকটাতে একটা আপন আপন ভাব আছে। দাদা আমাকে ডাকেন ‘আলু’ বলে। আমার নাম আলভি, সংক্ষেপে আলু। এই নামে আর কেউ আমাকে ডাকার সাহস পায়না। অবশ্য নামটা জানে কিনা তাতেও সন্দেহ আছে।
দাদাকে সেদিন খুব ব্যস্ত মনে হল। তাড়াহুড়ো করে বললেন, “এই আলু, ইশিতাকে নিয়ে মগবাজার কাজী অফিসে আয় তো! এক্ষুনী...”
আমি কিছু বলার আগেই উনি ফোন কেটে দিলেন। আমি রিক্সা নিয়ে ইশিতার হলের সামনে গেলাম। আমার আশঙ্কা ঠিক হল। বৃষ্টি থেমে গেছে, ইশিতার হাত ধরে আর বৃষ্টিতে ভেজা হলনা। আমি হলের গেটের সামনে দাঁড়াতেই ও বেরিয়ে এলো, যেন আমার জন্যই ভেতরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। আমি রিক্সার উপর দাঁড়িয়ে ইশিতার হাত ধরে ওকে রিক্সায় তুললাম। সিনেমায় যেমন রাজা রাণীর হাত ধরে ঘোড়ার গাড়িতে তোলে। এই কজটা করলে নিজেকে রাজা আর ইশিতাকে রাণী মনে হয়। গরীবের রাজা রোগ আর কি! প্রথম প্রথম ওর হলের সামনের অলিখিত দোকানদারেরা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। এখন আর দেখেনা, অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
মগবাজার পৌঁছানোর আগেই মিন্টরোডের মাথায় রোমেল ভাইয়ের সাথে আমাদের দেখা হয়ে গেল। তিনি বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন। ততক্ষণে আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। রোমেল ভাই রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন, অথচ ওনার সিগারেটে এক ফোঁটা পানিও পরছেনা। আমরা ওনার কাছাকাছি এসে রিক্সা দাঁড় করাতে উনি বললেন, “তোরা যা, আমি আসছি।”
কাজী অফিসের সামনে আমরা সেদিন রাত বারোটা পর্যন্ত দাড়িয়ে ছিলাম। রোমেল ভাই আসেননি। ওনাকে ফোনেও পাওয়া যায়নি। আমি যেতে চাইনি ওখান থেকে। আমার বিশ্বাস ছিল দাদা আসবে। দাদা আর আসেনি। ইশিতার তোড়জোড়ে ওখান থেকে আমাকে চলে যেতে হয়েছিল।
সেদিন রাতে যে ঘটনাটা ঘটল তার আমি অপেক্ষা করছিলাম অনেকদিন ধরে। অবশ্য যে কাজটা আমারই করা উচিত ছিল, সেটা ইশিতা করে ফেলল। আর আমি কাপুরুষের মত চেয়ে থাকলাম।
ইশিতাকে হলে রেখে বাসায় ফিরতে বেজে গিয়েছিল রাত দেড়টা। এমনিতেই নিজ উদ্যোগে ফোনে চার্জ দেয়ার অভ্যাস আমার নেই। তার উপর এত দেরিতে বাড়ি ফিরলে ফোনের চার্জ অবশিষ্ট থাকার কথা না। কখন যে ফোন বন্ধ হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। বাসায় ফিরে দেখি মা চিন্তিত মুখে খাবার টেবিলে বসে আছেন না খেয়ে। মা’র ঝাড়ি আর রাতের খাবার হজম করে ফোনটা অন করে দেখি ৯৯টা মিসড কল। সবগুলোই ইশিতার। কল ব্যাক করার সাথে সাথেই ও রিসিভ করল, যেন ফোন সামনে নিয়ে বসে ছিল। তখন বাজছে রাত তিনটা, ওর আবার তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস। এত রাত পর্যন্ত জেগে আছে, ভেবেছিলাম ও কোন ঝামেলায় পড়ল না তো!
“কি, ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”
ইশিতা এই প্রশ্নের উত্তর দিলনা। রেগে গিয়ে বলল,
“আচ্ছা আলভি, তুমি এত ভীতু কেন?”
আমি ওর রেগে যাওয়ার কারণ বুঝলাম না। কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও পেলাম না। ও বলেই চলল,
“যার তার বিয়ের জন্য তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজতে পারো। নিজেরটা কি কখনও ভাববে না?”
রোমেল ভাইয়ের নামে কেউ কিছু বললে আমার ভীষণ রাগ হয়। অথচ উনাকে ‘যার তার’ বলার পরও ইশিতার উপর আমি একটুও রাগলাম না। বরং খুশিই হলাম। তবে এই খবরটা আমি দাদাকে আজও দিতে পারিনি।
বাসায় ফিরে দেখি ইশিতা নেই। অবশ্য এই সময় ওর বাসায় থাকারও কথা কথা না। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, একটু বৃষ্টি হলেই ও ছাদে চলে যায়। আমি ভেজা কাপড়েই ছাদে গেলাম। ছাদের এক কোণে ইশিতা দু’হাত ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ও সাধারণত শাড়ি পরেনা। কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজার সময় শাড়ি পরে। এর কারণ জানার সৌভাগ্য আমার হয়নি। জানার অবশ্য চেষ্টাও কখনও করিনি। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ তার নিজস্ব একটা জগত তৈরি করে রাখতে ভালোবাসে, যেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দিতে চায়না। ইশিতার এই জগতের প্রবেশাধিকার আমি কোনদিন চাইনি, ও যেমন আমার জগতটায় কখনও উঁকিও দেয়নি।
আমি নিঃশব্দে ইশিতার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
“তোমার সাথে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল, সেদিন এরকম বৃষ্টি হচ্ছিল, মনে আছে ?”
“হুম, মনে আছে। তোমার ভাষায় আমি ‘নিষিদ্ধ বিরল শিল্পকর্মে’ ব্যস্ত ছিলাম।”
ঝুম বৃষ্টিতে দাঁড়িয়েও সিগারেটের গায়ে এক ফোঁটা পানি না লাগিয়ে সিগারেট টানার পারদর্শিতা আমার আছে। ইশিতা বলে এই শিল্পকর্ম নাকি একাধারে নিষিদ্ধ এবং বিরল। সহজে কোথাও দেখা যায়না। ওর সাথে প্রথম দেখা হওয়ার সময় আমি এই কাজেই ব্যাস্ত ছিলাম। ও আমাকে এসে বলেছিল,
“প্রকৃতির সুধাধারাকে অপবিত্র করার শিল্পকর্মটা আপনার বেশ ভালো। শিল্প হলেও কাজটা কিন্তু নিষিদ্ধই।”
হঠাৎ একটা অপরিচিত মেয়ের পরিচিত আচরণে অবাক হবারই কথা। তার উপর হালকা নীল শাড়িতে পৃথিবীর বুকে স্বর্গের পরী দাঁড়িয়ে থাকলে বাকরুদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। ঠিক তখনই রোমেল ভাই কানের কাছে এসে বললেন,
“যাবতীয় নিষিদ্ধ কাজেই তো মানবমন জর্জড়িত!”
বিজলি চমকাচ্ছে, মেঘ গর্জন করছে। আমরা দু’জন হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ ইশিতা জিজ্ঞেস করল,
“এত বছর হয়ে গেল, রোমেল ভাইয়ের সাথে একদিনও দেখা হল না। অথচ বৃষ্টি আসলেই তুমি দাদার কথা বল।”
ইশিতার এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। আমি রোমেল ভাইয়ের কথা ওকে শুধু শোনাতেই পেরেছি, দেখাতে পারিনি কখনও। জানিনা, এই মানুষটাকে এতটা ভালোবাসার পরও কেন সে আমার কথা কোনদিন শোনেননি! মা’র সাথে তো দেখাই করতে চাননি। ইশিতার সাথেও কোনদিন দেখা করেননি। মিন্ট রোডের মাথায় সেদিন ইশিতাকে দেখে দূরে সরে গেলেন, আর এলেন না! অথচ ইশিতার সাথে দেখা হবার পরই এই মানুষটার সাথে আমার পরিচয়। এরপর থেকে তো ওনার কথামতই তো চলেছি! আমার নিজস্ব জগতটাতে কেবল তাকেই স্থান দিয়েছি, কিন্তু তার জগতটাকে কখনও বুঝিনি। আর কোনদিন বোঝাও হয়তো সম্ভব না, ওনাকে হয়তো আর ফিরেই পাবোনা!
ইশিতা শক্ত করে আমার হাত ধরে আছে, জানি এ হাত ও কোনদিন ছাড়বেনা।





ভালো লাগলো লেখাটি!
ধন্যবাদ
ওয়েল ! খুব ভাল লেখা ! দাদার জন্য খারাপ লাগছে । লেখা চালিয়ে যান ।
চমত্কার লেখা।
তবে মাঝামাঝি জায়গায় রাত ৩টা থেকে হঠাত্ বাসায় ফেরাটায় খটকা লাগলো।
আর ঢাকায় কোথায় ভালো গুড়ের জিলাপি পাওয়া যায় বলেন তো..
চমত্কার লেখা।
তবে মাঝামাঝি জায়গায় রাত ৩টা থেকে হঠাত্ বাসায় ফেরাটায় খটকা লাগলো।
আর ঢাকায় কোথায় ভালো গুড়ের জিলাপি পাওয়া যায় বলেন তো..
রাত তিনটায় বাসায় ফেরাটা আসোলেই স্বাভাবিক না

আর গুড়ের জিলাপি আমার খুব প্রিয় একটা জিনিস। তবে ঢাকায় কোথায় ভালো পাওয়া যায় জানিনা। আপনি জানলে জানাবেন।
বন্ধু গুরের জিলাপির কথা শুনে আমার জিহবাতে যে জল এসে গেল!
মন্তব্য করুন