ডেভ১০১, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক সেমিস্টার, ট্রেইনিং বনাম লার্নিং
ধরুন আপনাকে ২০ জন বাংলা মিডিয়াম এবং ১০ জন ইংলিশ মিডিয়াম, মোট ৩০ জন ছাত্রছাত্রী দেয়া হল। তাদের গড় বয়স ২০ বছর অর্থাৎ যথেষ্টই ম্যাচিউর। আপনার দায়িত্ব বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে এদের কিছু অংশ ‘শেখানো’। আপনাকে বেঁধে দেয়া সময় ত্রিশ দিন। আপনি(আমি) নিজের সুবিধার্থে বেছে নিলেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১। প্রথমে আপনি যে কাজটা করতে পারেন তা হল একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা, যেহেতু আপনার হাতে সময় কম এবং শেখানোর বিষয়টা অনেক বিস্তৃত। বলা বাহুল্য আপনার ৩০ জন ছাত্রছাত্রীর ২৭ জন অর্থাৎ ৯০% নিজের দেশ, রাজনীতি ও ইতিহাস সম্পর্কে ‘ব কলম’ এবং ৭০% ‘ক অক্ষর গো-মাংস’। প্রথম ২৭ জনের ৩ জন অর্থাৎ মোট পরিমাণের ১০% মুখস্ত বিদ্যায় অতি মাত্রায় পারদর্শী এবং আরও ৩ জন সত্যিকার অর্থেই মেধাবী। বাকি থাকে ৭০% অর্থাৎ ২১ জন, যাদের সিংহভাগ মাঝারি লেভেলের স্টুডেন্ট আর বাকিরা হালকা থেকে তীব্র মাপের ফাঁকিবাজ। এদের ৮৫% আবার বই পড়ায় বিন্দুমাত্রও আগ্রহী না, ১০% মোটামুটি আগ্রহী এবং বাকিরা একাডেমিক বই ছাড়া সব ধরণের বই পড়তে আগ্রহী। এখন আপনার পাঠ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দুটি রাস্তা খোলা থাকতে পারে।
রাস্তা ১
এই সংসার নিয়ে যখন ঘর বাঁধতে যাবেন, তখন চিন্তা ভাবনা ছাড়াই আপনি ‘দৈনিক আজাদ থেকে কালের কণ্ঠ’ পর্যন্ত দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক কিংবা সান্মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ বিষয়ক’ অংশ কেটে একটি তথাকথিত ‘রিডিং ম্যাটেরিয়াল’ বানিয়ে ফেলবেন। এক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক চিন্তাধারা প্রাধান্য পাবে।
রাস্তা ২
আপনি যদি দূরদর্শী হয়ে থাকেন এবং ‘ছাত্রছাত্রীদের কিছু হলেও শেখানো’র সদিচ্ছা আপনার থেকে থাকে, আপনি একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ‘রিডিং ম্যাটেরিয়াল’ এর ব্যাবস্থা করবেন। একটু বেশি মাত্রার বন্ধুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে হুমায়ুন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেল’ এবং বোনাস হিসেবে খুশবন্ত সিং এর ‘ট্রেইন টু পাকিস্তান’ বেছে নিতে পারেন। এই বইগুলো বেছে নেয়ার প্রধান কারন আপনার ছাত্রছাত্রীদের গড়পর্তা বৈশিষ্ট্য।
তার ওপর আপনার হাতে যে ‘কোর্স কারিকুলাম’ দেয়া হয়েছে তাতে একটু বেশি পরিমাণেই ‘পোস্টার মেকিং, প্রেসেন্টেশন, রেসপন্স পেপার, সেমিনার’ টাইপের অবাঞ্চিত বস্তু(!!) সমূলে বিদ্যমান।
অতঃপর কার্যক্রম ১
যারা মুখস্ত বিদ্যায় পারদর্শী তারা এই ত্রিশ দিনে আপনার দেয়া পেপার কাটিং মুখস্ত করে ফেলবে। যাদের মোটামুটি বই পড়ার অভ্যাস তারা আপনার তৈরী ‘পেপার কাটিং’ নামক বই কিছুক্ষণের জন্য পড়ে সময়ে সময়ে ঘুমিয়ে পড়বে। যাদের বই পত্র বেশি পড়ার অভ্যাস, তারা আপনার একপেশে রাজনৈতিক মতবাদ সম্পন্ন ‘রিডিং ম্যাটেরিয়াল’ খুলে দেখবে এবং ‘দিশেহারা’ হয়ে পড়াশুনা ছেড়ে দেবে। আর বাকিরা অর্থাৎ আপনার সিংহভাগ ছাত্রছাত্রী কখনও এই রিডিং ম্যাটেরিয়াল পড়ে, কখনও আদিকালের নোটপত্র পড়ে, কখনও বা স্বল্প সংখ্যক দিশেহারা ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে একটি ভালো সিজিপিএ’র আশা করতে থাকবে। আর প্রেজেন্টেশন কিংবা পোস্টার মেকিং এর ক্ষেত্রে সবাই ভুগবে তথ্যের সীমাবদ্ধতায় কিংবা বিকৃত তথ্যের বেড়াজালে। চিন্তাশক্তিতো কারও বিকশিত হবেই না, পূর্বে উল্লেখিত ‘কিছু শেখা’র আশেপাশে দিয়ে যাবার সুযোগটাও এদের কারো হবেনা।*
অতঃপর কার্যক্রম ২
যারা মুখস্ত করার জন্য সবসময় উন্মুখ, তারা চাইলেও এই বইগুলো মুখস্ত করতে পারবেনা এগুলোর বন্ধুত্বপুর্ণ বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ যথেষ্ট আবেদন থাকার কারনে। যারা মোটামুটি বই পড়ে আর যারা এসব বই পড়তেই অভ্যস্ত তাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই দেখা যাবে তারা এই বইগুলো পড়ে ফেলেছে। সুতরাং প্রায় ১৫% ছাত্রছাত্রী পড়াশুনা থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত চিন্তায় সময় ব্যয় করার কিছু সময় পাবে। আর যেসব ফাঁকিবাজ কিংবা আংশিক ফাঁকিবাজ আপনার ছায়ায় আছে, এসব বই তারাও অনায়াসে পড়ে ফেলবে হুমায়ুনের সহজ সাবলীল বাক্য, ইতিহাস জানাতে শাহাদুজ্জামানের এডভেঞ্চার কিংবা খুশবন্তের নিষিদ্ধ ১৮+ গল্পের উপস্থিতির কারণে। ‘শেখা’র ক্ষেত্রে মাওলানা ইরতাজউদ্দিনের ঢাকায় আসা থেকে শুরু করে নগ্ন হয়ে নীলগঞ্জের বাজারে ঘোরার ঘটনা থেকে ২৫শে মার্চ থেকে মোটামুটি একাত্তরের নভেম্বর পর্যন্ত জানা হয়ে যায়। উদ্বাস্তু শিবিরের ব্যাপারে কৌতূহল পূরণ করতে শাহেদের সাথে কংকন এর পরিচয় আর আসামে গিয়ে আসমানি আর রুনির সাথে সাক্ষাতের ঘটনাই যথেষ্ট। সাথে আছে পুলিশ অফিসার ফয়জুর রহমানের উদ্যোগ, রাজাকারদের কর্মকান্ড, গেরিলা ট্রেইনিং। আর মুক্তিযুদ্ধের অপরিহার্য অংশ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ, মুক্তিবাহিনী গঠন, কাদেরিয়া বাহিনী, মুজিব বাহিনী, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর, বিজয় অর্জন, বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের তারিখ তো আছেই। এই গেল ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ এর কথা। ‘ক্রাচের কর্নেল’ পড়লে এসব ঘটনার গভিরে তো যাওয়া যাবেই, বোনাস হিসেবে থাকছে মুজিব শাসনামল, সংবিধান তৈরি প্রক্রিয়া, বাকশাল, সেসময় দেশের দুরবস্থা ও এর থেকে পরিত্রাণ, জিয়াউর রহমানের আগমন ও তার শাসনামল। যদিও এখানে ‘ট্রেইন টু পাকিস্তান’ এর কোন প্রয়োজন নেই, তবে ‘মানোমাজরা’ গ্রামের ভ্রাতৃত্ব ও পরবর্তী অবস্থা থেকে বৃটিশ পরবর্তি অবস্থা কিছু হলেও আঁচ করা যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এই বইটা যারা বই পড়ার প্রতি উদাসীন তাদের ‘পাঠকার্যে’ রসদ যোগাবে ১৮+ কল্পনার সাহায্যে। বস্তুত এখানে শেখার, বিশেষ করে মুক্ত চিন্তা করার পথ অনেকটাই প্রশস্ত। আর পোস্টার কিংবা প্রেসেন্টেশনের জন্য তথ্য বিনা বিরক্তিতেই খুঁজে বের করা সম্ভব।*
*ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, প্রকৃত মেধাবীদের ক্ষেত্রে আসলে এটাই ঘটে।
ফলাফল
ব্র্যাকের 'ট্রেইনিং এন্ড রিসোর্স সেন্টার (TARC)' দেখে জনৈক বিদেশী বলেছিলেন, "You can only train animals, not human being". এই বিদেশীর মহামূল্য কথা শুনে 'ট্রেইনিং এন্ড রিসোর্স সেন্টার (TARC)' কে 'ব্র্যাক লার্নিং সেন্টার(BLC)' বানানোর উদ্দেশ্য পুরোপুরি জলে যাচ্ছে এখানে। আসলে নামে কিছু আসে যায় না, যা আসে যায় তা সব কাজে! BLC হলেও যেমন সবাই এখনও একে TARC ই বলে, তেমনি এখানে এসে তারা 'ওয়েল ট্রেইন্ড' হচ্ছে মুখস্থ বিদ্যায়। আই মিন ইতিহাস মুখস্থ বিদ্যায়! গুটি কয়েক শিক্ষার্থীর সিজিপিএ বাড়ছে, আর তাতেই নাম হয়ে যাচ্ছে 'টার্কে গেলে সিজিপিএ বাড়ে', সাভার সেমিস্টারের আসল উদ্দেশ্য টা কি সিজিপিএ বাড়ানো? নাকি কিছু শেখানো? কর্তৃপক্ষের কথা শুনে যেহেতু মনে হয় উদ্দেশ্যটা শেখানো, আসল দৃশ্য দেখার পর চোখ বন্ধ করে বলা যায় "the ultimate result is HYPOCRISY"
মতামত
আমি বলছি না আপনি ‘কোর্স ম্যাটেরিয়াল’ এ হুমায়ুন, শাহাদুজ্জামান কিংবা খুশবন্তকে ঢোকান। বলছি বইটার পেছনে একটু সময় দিন। আপনাকে বুঝতে হবে আপনার হাতে ‘ফাংশনাল এলিট’দের ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, বলা হয়েছে এদের দেশ সম্পর্কে ‘কিছু শেখান’! তারা কি কিছু শিখছে? অবশ্যই না। যারা জানার, তারা আগে থেকেই জানে। আর যাদের জানাবার চেষ্টা করছেন তারা বাবা টাকার বিনিময়ে সারা সেমিস্টার দিনে পাঁচ বেলা খাচ্ছে আর পরীক্ষার খাতায় তা উগড়ে দিচ্ছে। ফলাফল কি? শুণ্য! তাছাড়া আপনি যদি ‘বিবিসি ওয়ার্ল্ড’ এর নিউজ রিপোর্টারকে ‘অমুক টিভি’র থেকে খবর সংগ্রহ করতে, কাজটা হয়তো সে করবে। তবে মন থেকে না। কিছু জানলেও হয়তো জানবে। তবে শিখবে না। ওই যে, ‘ফাংশনাল এলিট’ উপাধিটা যে কর্তৃপক্ষ গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে! ‘ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় সাভার সেমিস্টার’ এর উদ্দেশ্য যদি কিছু ‘শেখানো’ই হয়, তাহলে শেখার পরিবেশ সৃষ্টি করুন। ছাত্রছাত্রীদের সিজিপিএ’র বাধনে আটকে রাখবেন না। সেমিস্টার ফি’র নামে শুধু টাকাই কামাবেন না। জানি, ইংলিশের আংশিক ছাড়া এই সেমিস্টারের কোন কোর্সই কোন কাজে আসবে না । বাংলাদেশ স্টাডিস (ডেভ১০১) এর কথা তো আগেই বললাম। ২০+ বয়সে কখনও কাউকে ‘ইথিক্স এন্ড কালচার’(হাম১০৩) গলধকরন করানো সম্ভব না। সতের একরের এই জায়গাটা থেকে সবাই অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে আসে, নিয়ে আসে অনেক সুন্দর অভিজ্ঞতা। এর পরিমান এতোটাই বেশি যে কোন তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকলে তা চাপা পড়ে যায়। আমরা কি আশা করতে পারিনা এই সুন্দর স্মৃতি কিংবা অভিজ্ঞতার সাথে ইতিহাস, সংস্কৃতি আর তথাকথিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরিতে একটু সুন্দর ধারণা জন্ম হবে আমাদের পরবর্তী শিক্ষার্থীদের মাঝে?
পড়লাম, জানলাম!
বাংলাদেশ স্টাডিস নামের একটা কোর্স প্রত্যেক ইউনির সব সাবজেক্ট এর পোলাপাইনের জন্য বাধ্যতামূলক করা উচিত। আমরা বড় হয়েও নিজের দেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানি না।
মন্তব্য করুন