দ্বৈধ
তখন মাঘ মাসের শুরুর দিক। তারিখটা ঠিক মনে নেই। আমাদের গ্রামের বাড়িতে প্রচণ্ড শীত পড়েছে। চারদিক কুয়াশায় ঢেকে আছে। দুদিন হলো সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছেনা। দাদাজান সেদিন ফজরের ওয়াক্তে ঘুম থেকে উঠে ভোর হয়নি ভেবে আবার শুয়ে পড়লেন। দাদাজানের আবার ঘড়ি ব্যবহার করার অভ্যাস নেই, ঘরের ভেতর ঘড়ি থাকলে নাকি তার মনে হয় ঘড়ির কাঁটার সাথে আজরাইল তাঁর চারপাশে ঘুরছে। এই সমস্যা তাঁর শুরু হয়েছে দুই বছর আগে। তখন তিনি জণ্ডিসে ভুগছেন। সারাদিন কিছু খেতে পারেননা, সন্ধ্যা হলেই তাঁর মেজবানী খাবারের প্রয়োজন হয়। আর তিনি দশ বারোজনের খাবার একাই খেয়ে ফেলেন। ডাক্তাররা মানা করার পরও দাদাজানের এই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করা গেলনা। এর কারণটাও কেউ উদ্ধার করতে পারলনা অবশেষে বাড়িতে ওঝা ডেকে আনা হল। ওঝা সারা বাড়ি ঝাড় ফুঁক করে বললেন, মাগরিবের ওয়াক্ত শুরুর আগে বাড়িতে খারাপ জ্বিনের আনাগোনা শুরু হয়। তারা বাড়ির অসুস্থ মানুষের ওপর ভর করে। তারপর পেট পুড়ে খেয়ে আবার চলে যায়। এর সমাধান হিসেবে তিনি বললেন দাদাজানের ঘরের দরজা জানালা চব্বিশ ঘন্টা বন্ধ রাখতে হবে। দাদাজানের ঘরের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখা গেল সকাল থেকেই তার মেজবানী খাবারের প্রয়োজন হচ্ছে। কারণ সকাল থেকে ঘরে লাইট জ্বালানো, আর এই লাইটের আলোয় তিনি দেয়ালে টানানো ঘড়ির কাঁটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। ঘরের দরজা জানালা খোলা থাকলে লাইট জ্বালানোর প্রয়োজন হয়না, তাই ঘরের কোণে থাকা ঘড়ি তাঁর চোখে পড়েনা। ছোট চাচা দাদাজানের ঘরের ঘড়ি সরিয়ে ফেললেন। তাঁর
খাওয়া দাওয়ার প্রয়োজনও ফুঁড়িয়ে গেল। আর সেদিন থেকে দাদাজান ঘড়ি ব্যবহার করা বন্ধ করে দিলেন। পরে অবশ্য জানা গেল, ঘরে ঘড়ি থাকলে তাঁর মনে হয় তাঁর চারপাশে আজরাইল
ঘুরছে। আর আজরাইল যখন ঘুরছেই, জান কবজ করার আগে ভালোমন্দ কিছু খেয়ে নেয়াই ভালো।
সেদিন দাদাজানের ঘুম ভাঙল সকাল দশটায় দাদীজানের ডাকে। তিনি ঘুম থেকে উঠেই হা হুতাশ করতে লাগলেন, তাঁর ফজরের নামাজ ক্বাযা হয়ে গেছে। তিনি ওযু করে নামাজে বসলেন, উঠলেন ঘন্টা দুয়েক পর। কুয়াশা তখনও কাটেনি, সূর্যের আলো ঠিকমত দেখা যাচ্ছেনা। দাদাজান বাড়ি থেকে বেড়োতে যাবেন, তখনই কারো খিল খিল করে হাসি শুনতে পেলেন। কিন্তু আশেপাশে কাউকে দেখলেন না। যখনই তিনি বাড়ির বাইরে পা রাখতে যাবেন, ঠিক তখনই হাসি শোনা গেল। দাদাজান আর বাড়ি থেকে বেড়োলেন না। বাড়ির কাজের লোকদের বলা হল এই হাসির রহস্য উদ্ধার করতে। অহেতুক কাজ পেয়ে তারাও আনন্দিত। ঘন্টা খানেক খোঁজার পর হাজেরা চাচী দেখলেন বাড়ির নতুন এক কাজের মেয়ে উঠানের তালগাছে উঠে বসে আছে, কুয়াশার জন্য এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিলনা। বাড়ির সবাই উপস্থিত হল সেই তালগাছের নিচে। হাজার চেষ্টা করেও সেই মেয়েকে নামানো গেলনা। বরং তার হাসির শব্দ বাড়তে থাকল, যার ফলে প্রায় পুরো গ্রামবাসী উপস্থিত হল বাড়ির উঠানে। অনেকে বলাবলি করতে লাগল মেয়েকে জ্বিনে ধরছে। একজন আবার দাদাজানের অনুমতি না নিয়েই ওঝাকে ডেকে আনলেন, তা নিয়ে দাদাজানের সাথে তার বাড়িতে বিশাল গ্যাঞ্জাম। ওঝা এসেও সেই মেয়েকে নামাতে পারলনা। খবর দেয়া হল কামার চাচাকে। তিনি গাছে উঠতে পারদর্শ্বী। বিশাল তালগাছে উঠতে নাকি তাঁর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। কামার চাচা গায়ে তেল মেখে তাল গাছে উঠে পড়লেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই নামিয়ে আনলেন সেই মেয়েটিকে। তারপর শুরু হলো তার ওপর থেকে ভূত তাড়ানোর কাজ। বাড়িতে তখন হুলুস্থুল অবস্থা। পুরো গ্রাম ভেঙ্গে এসেছে ভূত তাড়ানো দেখতে। এই দৃশ্য গ্রামে নতুন না, তারপরও কোথাও ভূত তাড়ানোর ঘটনা ঘটলে সবাই সেখানে উপস্থিত হয়। অবাক হয়ে দেখে ওঝার অদ্ভুত কাজকর্ম।
বাড়ির সবাই যখন উঠানে দাঁড়িয়ে, ঠিক তখন পশ্চিম কোণার ঘরটাতে আমার জন্ম হয়। শহরে অন্তঃসত্বা মা’র দেখভাল করার মত কেউ নেই বলে দাদাজান মা’কে গ্রামে এনে রেখেছিলেন। সন্তান জন্ম হবার আগেই মা’র ঘরটাকে আতুর ঘর বানিয়ে রেখেছিলেন। ঘরে সবাইকে ঢুকতে দেয়া হত না। সেখানে চব্বিশ ঘন্টার জন্য একজন দাইমা, মা’র প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করার জন্য একজন মহিলা আর দরজার কাছে একজন মহিলাকে সার্বক্ষণিক দায়িত্বে রাখা হত। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমার জন্মের সময় ঘরে দাইমা আর বাবার দূর সম্পর্কের এক ফুপু ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। দায়িত্বে থাকা বাকি দুজন ভূত তাড়াবার দৃশ্য দেখায় ব্যস্ত ছিলেন। বাড়ির শোরগোল ছাপিয়ে আমার কান্নার শব্দ উঠানে পৌঁছতেই নাকি মেয়েটির উপর ভর করা ভূত পালিয়ে যায়। ওঝা এসে দাদাজানের পা ছুঁয়ে সালাম করে চোখ বড় বড় বললেন, ‘এই ছেলে বড় হইয়া সুবিশাল পীর হইব। সাবধানে রাইখেন। খারাপ জ্বিনে আছর জানি না করে।
অবশ্য... কোথায় পীর ফকির! আর কথায় দুই পয়সার জ্বিন!’ ভুতে ধরা সেই মেয়ে নাকি পরে স্বীকার করেছিল, এই বাড়িতে তার থাকতে ইচ্ছা করছিলনা বলে সে তালগাছে উঠে বসে ছিল, যেন পাগল ভেবে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।
এই গল্প মা’র কাছে শোনা। আজ অনেকদিন পর মা’র সাথে কথা হল। সন্ধ্যায় হঠাৎ তিনি ফোন করে বললেন, ‘এই শোন, বউমা কে সিজার করতে নিষেধ করিস।’ আজ সকালে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করেছি, কথাটা কাউকে বলা হয়নি। এখানে আমার আত্মীয় স্বজন কেউ নেই যে তারা মা’কে খবর দেবে। আমি মা’কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন আছ?’ তিনি নির্বিকারে বলে গেলেন, ‘আমি ভালো আছি। বাচ্চা পেয়ে সবকিছু ভুলে যাস না যেন, বউ মা’র খেয়াল রাখিস। ওখানে তো দেখাশুনা করার কেউ নেই। তোকেই দেখে রাখতে হবে।’ বাংলাদেশে এখন মাঘ মাস, সময় দুপুর দুইটা। আর এখানে প্রায় মাঝ রাত। ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই করছে। অপারেশন থিয়েটারের নার্স ইতোমধ্যে কয়েকবার আমাকে সাধিয়ে গেছে ভেতরে যাবার জন্য। আমি যেতে চাইনি তাই অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। এখানকার বাবারা মনেহয় নিজেদের বাবা হবার দৃশ্য দেখতে খুব ভালোবাসেন! আমি হাসপাতালের লবিতে দাঁড়িয়ে আছি। আমার গায়ে এসির বাতাস লাগছে। অথচ আমার মনে হচ্ছে আমি তীব্র শীতের মধ্যে কোন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছি। নিজেকে কেমন একা একা লাগছে। শোরগোলে ভরা সেই মাঘের দুপুরের সাথে আজকের এই মাঘের পার্থক্যটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
ঘড়িতে রাত বারোটার ঘন্টা মৃদু শব্দে বেজে উঠল। আমি নবজাতকের কান্না শুনতে পেলাম। আচ্ছা! ঠিক বারোটায় জন্ম হলে ওর জন্মতারিখ কোনটা হবে? আর ওর নামটাই বা কি রাখব?
আল্ট্রাসনোগ্রামের রিপোর্টটা তো কোনদিন দেখা হয়নি!
সুন্দর লেখা। ভাল লেগেছে
প্রথমটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম পরে না জানি আর কি হয়! যাক, ভালো লাগছে।
অসাধারন লাগল গল্পটা
মন্তব্য করুন