ইত্তেফাকের জন্ম রহস্য
একটা সময় বলা হতো বাংলাদেশে তিনটি প্রতিষ্ঠান আছে। আওয়ামী লীগ, সেনাবাহিনী ও ইত্তেফাক। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত ইত্তেফাক। কিন্তু ইত্তেফাকের ইতিহাস নিয়ে আছে ধোয়াশা। এর প্রকৃত মালিকানা নিয়েও অনেক গল্প চালু আছে। পত্রিকাটির ভূমিকা নিয়েও আছে নানা আলোচনা। ইত্তেফাকের জন্ম নিয়ে এই পোস্ট।
অভিভক্ত বাংলায় শেষ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। সে সময়ে মুসলিম লীগ প্রধান রাজনৈতিক দল হলেও এর মধ্যে দুটি গ্রুপ ছিল। একটির নেতা খাজা নাজিমুদ্দিন, আরেকটির নেতা সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। নির্বাচনের পর সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ শক্তিশালী হয় এবং তিনিই অভিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হন। এসময় তিনি কলকাতা থেকে বের করেন একটি পত্রিকা, ইত্তেহাদ। পত্রিকাটি বের করতে হয়, কারণ আজাদ তখন খাজা নাজিমুদ্দিনকে সমর্থন দিতো। ইত্তেহাদের প্রথম সম্পাদক ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ। বলা হয়, ইত্তেহাদের জন্য প্রেস কিনে দিয়েছিলেন রণদাপ্রসাদ সাহা।
দেশ ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে। মতার পালাবদল হয়। কোনঠাসা হয় সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ। নেতৃত্বে আসেন খাজা নাজিমুদ্দিন। এসময় আজাদ পত্রিকাও ঢাকায় আসে। কিন্তু অনুমোদন দেওয়া হলো না ইত্তেহাদকে। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানে পত্রিকাটির প্রবেশও নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। সোহরাওয়ার্দীকেও অনেকদিন কোলকাতায় থাকতে হয়।
মুসলিম লীগ জনপ্রিয়তা হারালে গঠন করা হয় নতুন একটি দল, আওয়ামী মুসলিম লীগ। নতুন দলের জন্য প্রয়োজন ছিল একটি পত্রিকা। কিন্তু ইত্তেহাদ প্রকাশে অনুমতি না দেওয়ায় নাম কিছুটা বদলে রাখা হয় ইত্তেফাক। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক বের করার এই উদ্যোগটি ১৯৪৯ সালের। মওলানা ভাসানী এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম ছাপা হয়, ইয়ার মোহাম্মদ খান প্রকাশক ও ফজলুর রহমান খাঁ সম্পাদক। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান চাঁদা তুলে ইত্তেফাক চালাতেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তর করা হয়। ১৯৫৩ সালের ২৪ বা ২৫ ডিসেম্বর প্রথম দৈনিক হিসেবে আÍপ্রকাশ করে ইত্তেফাক।
তাহলে তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) ইত্তেফাকের মালিক হলো কিভাবে? মনিক মিয়া চাকরি করতেন বরিশালে, কালেক্টটের অফিসের একজন সামান্য কেরানী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্টের প্রোপাগান্ডা অফিসার হয়ে কাজ করতেন। এসময়ই তাঁর পরিচয় হয় সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। তিনি তাকে কলকাতায় নিয়ে যান, এবং চাকরি দেন দৈনিক ইত্তেহাদে। দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন মানিক মিয়া। তখন তিনি বিয়ে করেছেন, নিদারুণ অর্থ কষ্টে আছেন। সরকার তখন ইনফরমেশন অফিসার নিয়োগ করছে। এই চাকরির আশায় ঢাকায় চলে আসেন তিনি। ঢাকায় আসলেও হোটেলে থাকার অর্থ ছিল না। ঢাকার মোগলটুলীতে তখন ছাত্রলীগের অফিস। এই অফিসে রাতে থাকতে চলে আসেন মানিক মিয়া। ঐ রাতে গোপন বৈঠক চলছিল ছাত্রলীগ অফিসে। খবর পেয়ে পুলিশ শেষরাতে হানা দেয় এবং ধরে নিয়ে যায় মানিক মিয়াকে। পরেরদিন যখন মুক্তি পান তিনি, তখন চাকরির ইন্টারভিউর সময় শেষ। হতাশ মানিক মিয়াকে তখন ইত্তেফাকে নিয়ে আসেন শেখ মুজিব. দায়িত্ব দেন ইত্তেফাকের। সম্পাদক হন তিনি। বরিশাল থেকে স্ত্রী কন্যা নিয়ে এসে কমলাপুর বস্তিতে উঠেন।
তখন মুসলিম লীগের নুরুল আমীন ক্ষমতায়। সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটা কলাম লেখা শুরু করেন মানিক মিয়া, মোসাফির ছদ্মনামে। অনেকটাই গ্রাম্য ভাষায় লেখা সেই কলাম দারুণ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ইত্তেফাকের অগ্রযাত্রাও শুরু হয়।
১৯৫৪ এর নির্বাচনে মুসলীগ লীগ বিরোধী জোট যুক্তফ্রন্ট জিতে ক্ষমতায় বসে। কিন্তু মন্ত্রীত্ব নিয়ে শুরুতেই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ভাসানী, ফজলুল হক (শেরে বাংলা) এবং সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব দেখা দিয়ে ইত্তেফাকেও এর প্রভাব পরে। মুখ্যমন্ত্রী তখন সোহরাওয়ার্দী। তাঁর নির্দেশে ১৯৫৪ সালের ১৪ মে ঢাকার জেলা প্রশাসন থেকে ইয়ার মোহাম্মদ খানের জায়গায় মানিক মিয়ার নাম প্রিন্টার ও পাবলিশার করা হয়। একই সময়ে মওলানা ভাসানীর নাম প্রতিষ্ঠাতার বদলে পৃষ্ঠপোষক ছাপা হতে থাকে। জানা যায়, এ নিয়ে ভাসানী মামলা করার কথা ভাবলেও দলীয় ভাবমূর্তির কারণে আর সে পথে জাননি। তারপর একদিন প্রতিষ্ঠাতার জায়গার মানিক মিয়ার নাম ছাপা হতে শুরু করে। ভাসানী নাম আর কোথায় রইলো না তারপর থেকে।
১৯৬৯ সালের ৩১ মে রাওয়ালপিন্ডিতে মানিক মিয়া মারা যান। শুরুতে মানিক মিয়া খানিকটা চীনপন্থী হলেও পরবর্তীতে একদমই মার্কিনপন্থী হয়ে গিয়েছিলেন। সম্ভবত সোহরাওয়ার্দীর প্রভাবে। তাঁর মৃত্যুর পর ইত্তেফাক মানিক মিয়ার দুই ছেলের হাতে চলে যায়। ১৯৭১ সালে পাক বাহিনী পিপল, সংবাদ ও ইত্তেফাক পুড়িয়ে দেয়। তবে যুদ্ধের মধ্যেই ইত্তেফাক আবার প্রকাশিত হয়। বলা হয়, টিক্কা খান মোটা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন।
এই ছবিটি সামুর সেলটিক সাগরের পোস্ট থেকে নেওয়া
তথ্য সূত্র:
১. বাংলাদেশের রাজনীতি, ১৯৭২-৭৫। হালিম দাদ খান। আগামী প্রকাশনী
২. ইতিহাসের রক্তপলাশ, পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর। আবদুর গাফফার চৌধুরী।
ইতিহাস জেনে খুব ভাল লাগলো। জনকণ্ঠ পত্রিকাটা প্রকাশিত হবার আগে ইত্তেফাকই আমাদের বাসায় রাখা হত। ইত্তেফাকের ভাষাটা খুব ভাল লাগতো।
সাধু ভাষায় লিখতে খুবই ভাল লাগতো। সাধু ভাষার একটা আলাদা জোর আছে
ছোটবেলায় পত্রিকা বলতে ইত্তেফাককেই বুঝতাম।
ছোটবেলায় বাসায় রাখা হতো দৈনিক বাংলা। তারপর সংবাদ। ইত্তেফাক বাসায় আসলো আমি ইত্তেফাকে কাজ শুরু করার পর।
ইত্তেফাকের সাথে জড়িত বিভিন্ন স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
মাওলানা ভাসানিকে নিয়ে লিখবেন? উনার ব্যাপরে জানতে ইচ্ছা করে।
মওলানা ভাসানীকে নিয়ে লেখার সাধ্য আমার নাই।
এর আগে কোথাও পড়েছিলাম যে মানিক মিয়া ইত্তেফাকের আসল মালিক না। আজ পেছনের কাহিনী জানলাম। কোত্থেকে কিভাবে কে যে সাম্রাজ্য হাতে পেয়ে যায়।
রাজনৈতিক প্যাচের কারনে মুফতে পাওয়া বলেই হয়তো ইত্তেফাক নিয়ে দুই ভাইয়ের ইদুর-বিড়াল খেলা চলেছে দীর্ঘদিন, পত্রিকার বারোটা বাজলেও।
টিক্কা খানের মোটা ক্ষতিপূরণ দেয়ার কাহিনীটা বিস্তারিত জানায়েন, কারন ব্যারি:মৈনুল হোসেনের ৭১ এর ভুমিকা নাকি প্রশ্নবিদ্ধ। স্বাধীনতার পর বংগবন্ধুর কারনে মাফ পেয়ে যায় সে, দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয় আবার ঝোপ বুঝে গণতন্ত্রের রক্ষার স্বার্থের মোড়কে পদত্যাগ করে। তবে সে কেমন গনতন্ত্রমনা সেটা ২০০৭-২০০৮ এর আর্মি হ্যাকড তত্ত্ব সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে বিলক্ষন দেখিয়েছেন।
ইত্তেফাক আসলে আওয়ামী লীগের দলীয় পত্রিকা হিসেবেই প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু পরে সেটি ব্যক্তি মালিকানায় এভাবে চওেল যায়।
আর টিক্কা খানরা তো কোনো প্রমান রেখে ক্ষতিপূরণ দেয়নি। তাই বিস্তারিত কিছু আর জানা যায়নি।
মইনুল হোসেনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কথা অনেকেই লিখেছেন। আর বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোশতাকের দলে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম লিখিয়েছিলেন তিনি। আর বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এর সমর্থনে ইত্তেফাকের ঐতিহাসিক সম্পাদকীয় তো এখন ইতিহাস।
পুরাই বাটপারি। প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে ভাসানীর নাম থাকা উচিৎ। তফাজ্জল মিয়া তো প্রতিষ্ঠাতা না।
তবে এও ঠিক মানিক মিয়া ছাড়া ইত্তেফাকের এতো জনপ্রিয়তা ঐ সময় হতো না।
পেছনের কাহিনী জানলাম ।
পেছনে ম্যালা কাহিনী
কত অজানা কাহিনী শুনালেন, মাসুম ভাই। থ্যাংকু
কই জয়েন দিলেন?
গুলাপ মিয়া মানিক মিয়ার বুদ্ধিটা পাইলো না , ধূর্তামীটা পাইলেও ........ আফসুস।
গুলাপ মিয়া কেডায়?
শিশুকালে ইত্তেফাকের "টারজান" কমিক্সের ডাইহার্ড ফ্যান আছিলাম...
টানজান সমগ্র দেখতেই মজা
কত অজানা কাহিনী! ইত্তেফাকে বড় বড় করে সিনেমার বিজ্ঞাপন দিতো, দেখতে ভালু পাইতাম।
হু, সেই দিন আর নাই। কতদিন সেই ববিতারে দেখি না। (
মানিক মিয়ার পারিবারিক ইতিহাস সর্ম্পকে জানতে ইচ্ছা করতেছে এই লেখাটা পইড়া। বালক বেলায় মানিক মিয়ার দুই নাতির সাথে ক্রিকেট খেলতাম। শরত আর ফাগুণ ভাইরে দেইখা কিন্তু আমরা আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর স্নব অ্যাটিচিউড বুঝতাম না। তারা অনেক স্টাইলিশ মহল্লার বড় ভাই টাইপেরই ছিলো বইলা মনে পড়ে।
শরত আর ফাগুন কে? মঞ্জু সাহেবের বোনের ছেলে?
গুড জব ।
মুখ্যমন্ত্রী তখন সোহরাওয়ার্দী। তাঁর নির্দেশে ১৯৫৪ সালের ১৪ মে ঢাকার জেলা প্রশাসন থেকে ইয়ার মোহাম্মদ খানের জায়গায় মানিক মিয়ার নাম প্রিন্টার ও পাবলিশার করা হয়।
যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভায় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শেরে বাংলা । কিন্তু এই মন্ত্রীসভার স্থায়ীত্বকাল ছিল মাত্র ৫৭ দিন। ১৯৫৪ সালের ৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী কমিউনিস্ট বিশৃঙ্খলা দমনে ব্যর্থতার অভিযোগে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা বাতিল করে ৯২ (ক) ধারা জারির মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন কায়েম করেন। মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মন্ত্রীসভায় সোহরাওয়ার্দি আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন । ১৯৫৬ সালে চৌধুরি মোহাম্মদ আলির পদত্যাগের পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
বিধায় , আপনার নিচের তথ্যটি যাচাই করার অনুরোধ রইল-
একটু ভুল হয়ে গেছে। বইটিতে কেবল মুখ্যমন্ত্রী কথাটা থাকায় এই ভুলটা হয়েছে।
শেরে বাংলা তার ভাগ্নে নান্না মিয়াকে মন্ত্রী করার জেদ ধরায় সমস্যা শুরু হয়েছিল। বলা যায় এক ধরণের ভাঙ্গন দিয়েই যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার যাত্রা শুরু হয়েছিল।
চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছিল আদমজীর ভয়াবহ দাঙ্গার পরে। বাতিল করা হয় যুক্তফ্রন্ট সরকার।
কমলাপুর বস্তি থেকে ধানমন্ডি আর বারিধারার প্রাসাদ? শর্টজানি ইন লং গেইম। লাকি পিপল আর দে।
অনেক কিছু জানলাম
ইত্তেফাকের বাংলা সিনেমার অ্যাডগুলা খুব ভাল লাগত; আর টারজান তো ছিলোই।
ব্যাপক লাইকস।
:love:ষফঘষদফঘদডক্স
সম্পূর্ণ ভুল ইতিহাস
মন্তব্য করুন