ইউজার লগইন

বিপ্লবের ভেতর-বাহির: সিরাজ সিকদারের ধরা পড়ার চমকপ্রদ নতুন কিছু তথ্য

সিরাজ সিকদার গ্রেপ্তার হন ১৯৭৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর, চট্টগ্রামে। এই তথ্য আমরা সবাই জানি। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি সরকারি প্রেসনোট থেকে সবাই জানেন যে, সিরাজ সিকদার নিহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার ও নিহত হওয়ার মাঝখানের ঘটনার কোনো বিবরণী এখন পর্যন্ত কেউ দেননি। সিরাজ সিকদার হত্যা মামলার বিবরণীতে অনেক কিছু লেখা আছে, কিন্তু এর সত্যতা নিশ্চিত নয়। বিবরণীর মধ্যে যে অতিরঞ্জন আছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না।

সিরাজ সিকদার ধরা পড়েছিল পুলিশের হাতে। কিন্তু তাকে রাখা হয়েছিল শেরে বাংলা নগরের রক্ষী বাহিনীর কার্যালয়ে। এরপর কি হয়েছিল? কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর কোনো বিবরণী এতোদিনে পাওয়া যায়নি। তবে আজ পাওয়া গেল। আনোয়ার উল আলম ছিলেন রক্ষী বাহিনীর একজন উপ পরিচালক। তিনি একটি বই লিখেছেন। রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা নামের বইটি প্রকাশ পেয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই)। বইটিতে অনেক অজানা কাহিনী আছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং নতুন তথ্যও আছে। সেটি হচ্ছে সিরাজ সিকদার কিভাবে ধরা পড়েছিলেন, কে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

বই থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সবাই জানতেন যে দলের বিশ্বাসঘাতকতায়ই সিরাজ সিকদার ধরা পড়েছিলেন। পার্টির মধ্য থেকেও অনুসন্ধান করা হয়েছিল। এমনকি সন্দেহজনকদের নির্মমভাবে খতমও করা হয়েছিল। এর একটি মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এই সিরিজেই আছে। আগ্রহীরা আগের পর্বগুলো পড়তে পারেন। তবে আনোয়ার উল আলম নতুন একটি তথ্য দিয়েছেন। সেই তথ্যটি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন বলেই সিরিজটির আরেক পর্ব সংযুক্ত করার প্রয়োজন বোধ করছি।
গ্রেপ্তারের পর ঢাকায় এনে প্রথমে সিরাজ সিকদার ছিলেন পুলিশের তত্বাবধায়নে রাজারবাগে, হোয়াইট হলে (এখন সেটি নেই)। এরপর গভীর রাতে আনা হয় শেরে বাংলা নগরে, রক্ষী বাহিনীর কার্যালয়ে। তবে এ দায় নিতে চায়নি রক্ষী বাহিনী। তবে লেখক জানাচ্ছেন, স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই এ চৌধুরীর অনুরোধে সিরাজ সিকদারকে সেখানে আনা হয়েছিল।
এবার লেখকের জবানীতে শুনুন,

‘নির্দিষ্ট কক্ষে গিয়ে দেখি, সিরাজ সিকদার মাটিতে বসে আছেন। একটা টেবিলে তাঁকে সকালের নাশতা দেওয়া হয়েছে। তিনি খাননি। কক্ষের ভেতরে একটা বিছানা ও একটা ছোট টেবিল। কোনো চেয়ার নেই। আমরা তিনটি চেয়ার আনার ব্যবস্থা করি। তার একটিতে বসতে দেই সিরাজ সিকদারকে। সরোয়ার (সরোয়ার হোসেন মোল্লা-রক্ষী বাহিনীর সে সময়ের উপপরিচালক-অপারেশন) তাকে জিজ্ঞেস করলাম সিগারেট খাবেন কি না। তিনি হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলে সরোয়ার তাঁকে একটা সিগারেট ও ম্যাচ দেয়। সিরাজ সিকদার দেশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরান। কয়েকবার টান দিয়ে একটু স্বাভাবিক হন। এর আগে বসে ছিলেন বেশ গম্ভীর ভাব নিয়ে। আমরা তাঁকে নাশতা খেতে বলি। তিনি নাশতা খেতে শুরু করেন।
একপর্যায়ে আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। আমরা দুজন যে তাঁর সঙ্গে এত ভাল আচরণ করছি, তিনি তা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাঁর কথায় বোঝা গেল, তিনি নিশ্চিত, তার অনুপস্থিতিতেই তাঁর সহকর্মীরা বাংলাদেশে বুর্জোয়া সরকারকে উৎখাত করে সর্বহারাদের সরকার গঠন করতে পারবে। তিনি বারবার একটি কথাই বলছিলেস, ‘আই নো মাই ফেইট ডিসাইডেড’।’

সরকার বেশ সতর্ক ছিল। কারণ সর্বহারা পার্টি সিরাজ সিকদারকে ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করতে পারে। এমনকি ভারতীয় হাইকমিশনার বা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উপর হামলার আশঙ্কাও ছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনক ঘটনা হচ্ছে পার্টি ছিল একদম চুপ। দলের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই কি? এই প্রশ্নটি আমি আগেও করেছি। আনোয়ার উল আলম বলছেন একটি নাম, বিশ্বাসঘাতকের নাম। পুরো সিরিজটিতে আমি ব্যক্তির উপর আলো ফেলতে চেয়েছি। বলতে চেয়েছি ব্যক্তিগত নানা ঘটনা সে সময় সর্বহারা পার্টিকে বড় ধরণের সংকটে ফেলেছিল। সর্বহারা পার্টি ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে বিপ্লব করতে চেয়েছিল। অথচ ব্যক্তিগত নানা ঘটনায় দলটিতে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি ঘটনাও কম ছিল না। অভ্যন্তরীণ নানা কোন্দল ছাড়াও সিরাজ সিকদারের দুই বিয়ে থাকলেও অন্যকে বিয়েতে নিরুৎসাহিত করার ঘটনাও পার্টিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।
আনোয়ার উল আলমের বইটি আমার এই বক্তব্যকেই সমর্থন করে। তিনি লিখেছেন,

‘আসলে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও কিছুটা নারীঘটিত কারণে সিরাজ সিকদার ধরা পড়েন।’

কথা হচ্ছে বইটির লেখকের তথ্যের উৎস কি। তিনি জানিয়েছেন, ই এ চৌধুরীরর কাছ থেকে তিনি সিরাজ সিকদারের গ্রেপ্তারের কাহিনী জানতে পেরেছিলেন। ই এ চৌধুরী ছিলেন এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। সুতরাং এই তথ্য সঠিক ভাবার যথেষ্ট কারণ থাকছে। বইটিতে এ বিষয়ে আছে,
‘সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন রবিন নামের একজন প্রকৌশলী। তাঁর একজন প্রেমিকা ছিল। সিরাজ সিকদারের দুজন স্ত্রী থাকা সত্বেও তাঁর দৃষ্টি পড়ে রবিনের ওই প্রেমিকার ওপরে। এ নিয়ে তাঁদের দুজনের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। তাঁরা তখন সিলেট ছিলেন। এরপর তাঁরা দুজন সিলেট থেকে আলাদাভাবে চট্টগ্রামে রওনা হন। কিন্তু রবিন সিলেট থেকে চট্টগ্রামের পথে ঢাকায় আসেন এবং তাঁর একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর মাধ্যমে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রবিনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ সাদা পোশাকে কুমিল্লা থেকেই সিরাজ সিকদারকে ও তার কুরিয়ারকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা হদিস পায়নি। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে অপেক্ষমান গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা সিরাজ সিকদার ও তাঁর কুরিয়ারকে সন্দেহ করে। সিরাজ সিকদার স্টেশন থেকে একটা স্কুটার নিলে সাদা পোশাকের কর্মকর্তারা তাঁর পিছু নেয় এবং একপর্যায়ে তাঁকে সন্দেহজনক ব্যক্তি হিসেবে গ্রেপ্তার করে। পরে রবিনই নিশ্চিত করেন, পুলিশ যাঁকে গ্রেপ্তার করেছে, তিনি-ই সিরাজ সিকদার।’

বইটিতে আনোয়ার উল আলম সবশেষে আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,

‘সিরাজ সিকদারের সিলেট থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার সঠিক তথ্য দেওয়ায় সরকার কয়েকদিন পর পুরস্কারস্বরূপ রবিনকে তাঁর স্ত্রী বা প্রেমিকাসহ কানাডায় পাঠিয়ে দেয়।’

আমরা জানি যে, পুলিশের কাছে একটি মেয়েলি হাতে লেখায় সিরাজ সিকদারের পথের নির্দেশনা এসেছিল। সেটি কি তাহলে রবিনের সেই প্রেমিকার? এতোদিন মনে করা হত, চিঠিটি সিরাজ সিকদারের দ্বিতীয় স্ত্রীর লেখা। আবার রবিন যদি মূল বিশ্বাসঘাতক হন, তাহলে অযথা প্রাণ গিয়েছিল সন্দেহভাজন মনসুরের। রবিন কি এখনো কানাডায়? রবিনের প্রকৃত নাম তার সহবিপ্লবীরা জানবেন। আনোয়ার উল আলমের দেওয়া নতুন তথ্য নিয়ে নিশ্চই সর্বহারা পার্টির সাবেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা কিছু বলবেন। রইসউদ্দিন আরিফ নিশ্চই কিছু লিখবেন। সেই অপেক্ষায় থাকলাম।

রক্ষীবাহিনীর সত্য মিথ্যা, আনোয়ার উল আল, প্রথমা প্রকাশনী, মূল্য-৩৫০ টাকা

পোস্টটি ২৫ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

অনুপ সাদি's picture


রক্ষীবাহিনীর ইতিহাস উন্মোচিত হচ্ছে। সেই বাহিনীর এক আমলাই আবার লিখেছেন, সত্য মিথ্যা মিশিয়ে নিশ্চয়। আওয়ামি ফ্যাসিবাদ ও আমলাতন্ত্র একই সুত্র গাঁথা। Glasses

শওকত মাসুম's picture


বইটা না পড়েই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন

আরাফাত শান্ত's picture


দারুন!

শাশ্বত স্বপন's picture


বইটি কিনব। সিরাজ সিকদারে দুই বিবাহ--জানতাম না। এরা এত বিবাহ করার সময় পায় কেমনে?

হয় তার ২য় বউ নয়তো রবিনের প্রেমিকা--আমি বিম্বাস করি।

ডাইনোসর's picture


আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন পুরোটা পড়ে শেষ করি নাই।

লীনা দিলরুবা's picture


বইটা পড়ার আগ্রহ পাচ্ছি।
আহা, কেউ যদি গিফট করতো Tongue

জ্যোতি's picture


দারুণ! কত কাহিনী জানার কিন্তু অজানা থেকে যায় ।

টোকাই's picture


নিজের গদি আর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য দেশের শাসক'রা সবাই বিনা বিচারে অনেক খুন করেছে। একজন মেরেছে সিরাজ শিকদারকে, একজন মেরেছে কর্নেল তাহেরকে, একজন মেরেছে সেলিম দেলোয়ার, বসুনিয়াকে। আরেকজন একেবারে সেনাবাহিনী 'র সব অফিসার মেরে শেষ করে দিয়েছে। নিজের প্রয়োজনে, শুধুই নিজের প্রয়োজনে খুন করা আমাদের দেশের রাষ্ট্রনায়কদের কাছে ডাল ভাতের মত।

অনেক আকাঙ্খিত একটা বিষয় নিয়ে বিসদ ভাবে লিখার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, মাসুম ভাই।

তানবীরা's picture


গনধম খাওয়ার পরিনাম, আদম থেকে সিরাজ Puzzled Sad(

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শওকত মাসুম's picture

নিজের সম্পর্কে

লেখালেখি ছাড়া এই জীবনে আর কিছুই শিখি নাই।