আততায়ী বইটি হাতে পেয়ে……
১.
আমার পড়া প্রথম মাসুদ রানার বই স্বর্ণমৃগ। তখন ক্যাডেট কলেজে পড়ি। সেখানে গল্পের বই পড়া নিষিদ্ধ। মাসুদ রানা ছিল আরও নিষিদ্ধ। কারণ সেখানে যৌনতা থাকে। মাসুদ রানা বড়দের বড়. লেখা থাকতো প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য।
ক্যাডেট কলেজ জীবনের সমস্যা হচ্ছে কলেজে থাকলে মনে হতো কবে বাসায় যাবো। আর বাসায় গেলে মনে হতো কবে কলেজে ফিরে যাবো। সে সরকম এক মনখারাপের দিনে হাতে পাই স্বর্ণমৃগ বইটি। মুভি অব দ্য উইকে সেন্সর করা কিছু ইংরেজি সিনেমা দেখতে পেতাম। সুতরাং জেমস বন্ডের সিনেমাগুলো দেখার সুযোগ ছিল না। ফলে জানতে পারিনি স্বর্ণমৃগের মূল গল্প কোথা থেকে নেওয়া।
মনে আছে মন ভাল হয়ে গিয়েছিল, আর পেয়েছিলাম এক নতুন গুপ্তধনের সংবাদ। সেই যে মা
সুদ রানা ডুবলাম, আগের মতো না হলেও এখনও আছি। আমার শৈশবের বড় সঙ্গী মাসুদ রানা।
২.
স্বর্ণমৃগ নিয়ে মজার গল্পটা বলি। আসজাদুল কিবরিয়া আমার সহকর্মী। সে এক সময়ে সেবার লেখক ছিলেন। কিবরিয়া ২০০৬ সালে সাপ্তাহিক ২০০০ এর জন্য কাজী আনোয়ার হোসেনের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। গল্পটা কিবরিয়ার কাছে শোনা। পরে কিবরিয়া পুরোনো পত্রিকাটাও এনে দিল।
স্বর্ণমৃগ প্রথম প্রকাশের পর তীব্র সমালোচনা হয়। সচিত্র সন্ধানীতে গাজী শাহবুদ্দিন তীব্র সমালোচনা করে এই বইয়ের একটি আলোচনা লিখেছিলেন। সেখানে লেখা ছিল-লেখকের কলম কেড়ে নিয়ে হাতে আগুনের ছ্যাকা দেয়া দরকার, পল্টন ময়দানে বেঁধে জনসম্মুখে চাবুক মারা দরকার, ইত্যাদি। কাজী আনোয়ার হোসেন গাজী শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করলেন। সাক্ষাৎকারে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছেন, মামলায় তিনি জিততে পারেননি। কারণ মামলা করার পরই সরকারি প্রকাশনা অধিদপ্তরে তার বন্ধুবান্ধবদের সহায়তায় সে বইটি নিষিদ্ধ করায়।
আদালতে গাজী শাহাবুদ্দিনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন আওয়ামী লীগ করেন এমন বড় বড় উকিল। এর মধ্যে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানও ছিলেন। মজার ব্যাপার হল, আদালতে জিল্লুর রহমান তাঁকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘নওয়াব, তুমি কেসটা তুইলা লও। তুমি হাইরা যাইবা। তবে বইটা দারুণ লিখেছো হে।’
৩.
মাসুদ রানার প্রথম দুই বই মৌলিক। যেমন, ধ্বংস পাহাড় ও ভারত নাট্যম। এর পরেরগুলো বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে। কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে প্রকাশিত হলেও লিখতেন আরও অনেকে। তবে সম্পাদনা করতেন তিনি নিজেই। সম্ভবত সবচেয়ে বেশি মাসুদ রানা লিখেছেন শেখ আবদুল হাকিম। মাসুদ রানা আরও লিখেছিলেন শাহাদত চৌধুরী, রাহাত খান, খোন্দকার আলী আশরাফ, রকিব হাসান, ইফতেখার আমিন, কাজী শাহনুর হোসেন এবং কাজী মায়মুর হোসেন।
অনেকেরই প্রিয় মাসুদ রানা আই লাভ ইউ ম্যান। এটা আমারও সবচেয়ে প্রিয়। এটি লিখেছিলেন শেখ আবদুল হাকিম। আই লাভ ইউ ম্যান-২ এর প্রচ্ছদটির কথা কে ভুলবে। বিশালবক্ষা বিকিনি সু্ন্দরীর সেই প্রচ্ছদটি করেছিলেন শাহাদত চৌধুরী। আরেকটি প্রিয় বই হ্যালো সোহানাও লিখেছিলেন বিচিত্রা সম্পাদক শাহদত চৌধুরী।
মজার ব্যাপার হল, একই গল্প নিয়ে দুবার মাসুদ রানার সিরিজ হয়েছিল। বন্দী গগল আর ক্রিমিনাল একই গল্প। বলা হয় মাসুদ রানা সিরিজের সবচেয়ে ইরোটিক বইটি ছিল মূল্য এক কোটি টাকা মাত্র। এটিও লিখেছেলেন শাহাদত চৌধুরী। এ নিয়ে কাজীদার ভাষ্য শুনতে পারি। তিনি বলেছেন, ‘আসলে শাহাদতকে ঠেকানো যেতো না। বিদেশী বই পড়ে পড়ে হাফেজ হয়ে আছে। তার কাছে এগুলো কিছুই মনে হচ্ছে না। আমি বলতাম, ‘সর্বনাশ করেছেন।’ ও বলত, ‘থাক, থাক এগুলি বাদ দিয়েন না।’
৪.
কেবল মাসুদ রানাই নয়, সেবা থেকে প্রকাশিত হত আরও কিছু রহস্য উপন্যাস। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রতিশোধ, শেখ আবদুল হাকিমের বন্দিনী, কামিনী ও কাঞ্চন, আততায়ী-বইগুলোর নাম। এসব বই আর পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ আবার পড়তে খুবই ইচ্ছা হয়। এর মধ্যে আজ পেলাম আততায়ী বইটি। কেন ফলেটের এই বইটির অনুবাদ করেছিলেন শেখ আবদুল হাকিম। মনে আছে রহস্য পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে এটি বের হতো। অপেক্ষায় থাকতাম রহস্য পত্রিকার। পেপারব্যাক হয়েই বইটি আবার প্রকাশ করা হল।
খুবই দু:খজনক যে শেখ আবদুল হাকিম আর রকিব হাসানরা আর সেবার সঙ্গে নেই। আরও দু:খজনক যে শেখ আবদুল হাকিম ও ইফতেখার আমিন কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে কপিরাইটের মামলাও করেছিলেন। যদিও মামলায় জিততে পারেননি। এ কারণে হয়তো অনেকেই শেখ আবদুল হাকিমকে পছন্দ করেন না। তারপরেও তাঁর লেখা বইগুলো তো আর মিথ্যা হয়ে যায় না। সেই সব পুরোনো বই আবারও পড়তে মন চায় ।
পড়ি নাই একটাও,
সেই এক পারিবারিক নিসিদ্ধ আবহের কারনেই।
মাসুম ভাই, খুব মজা পাইলাম আপনার এবারের লেখাটা পড়ে।
কেউ মাসুদ রানার পাঠক শুনলেই খুশি লাগে আমার। আমি নিজেও যে মাসুদ রানা পড়তে পড়তেই বড় হইসি। প্রতিটা সিরিজ যেন এখনো মুখস্থ বলে দিতে পারি। রানা সোহানার প্রেম, গিলটি মিয়া, সোহেল, মেজর জেনারেল রাহাত খান, সব চরিত্রগুলি যেন এখনো জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভাসে। অদ্ভুত ভাল লাগা ছিল। আজও তেমনি আছে। বদলায় ননাই এক বিন্দু ও।
বড়ভাই'রা ছিলো বইয়ের পোকা, ২ভাই মিলে সেবাপ্রকাশনীর বই কিনতেন টিফিনের পয়সা বাচায়ে, তাই অনেক বিধি নিষেধ থাকা স্বত্তেও রানা'র বই সহজেই পড়ার সুযোগ পেয়েছি আমরা শেষের ভাইবোনগুলো। আহা, সেই কি মজা। আগের মতোন দূর্দমনীয় ঘোর কাজ না করলেও এইকালে এসেও রানা হাতে পেলে ফেলে রাখতে পারি না।
আপ্নের সবরকমের লেখা থেকেই কত্তো গল্প জানা যায়।
ক্যামনে ভুলি গিল্টি মিয়ার সেই ফেমাস ডায়ালগ " নড়েচ কি মরেচ"।
আমরা যৌথ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর সেভাবে মাসুদ রানা পড়তে পারিনি (
আমার ভাগ্যে পড়লো পুরানো ভারতীয় বাংগলা, নীহার, নিমাই, ফালগুনী, আশুতোষ, আশা ইত্যাদি
তবে হ্যালো সোহানা আমারো খুব পছনদ ছিল।
একটা ব্যাপার ছিল কাজিনদের মধ্যে, বইতো অনেক সময় উধাও রাখা যাবে না। শুধু ঐ জায়গাগুলো তাড়াতাড়ি সবাই পড়ে নিতাম, অন্য ব্যাপারে ঝগড়া থাকলেও চুড়ির ব্যাপারে মিল ছিল আমাদের
মাসুদ রানা দূর্দান্ত। ধ্বংস পাহাড় থেকে বোস্টন জ্বলছে পর্যন্ত পড়ছি। একটাও বাদ দিই নাই। বইগুলার দিকে বড়দের একটা সচেতন নজরদারি থাকতো বলেই মনে হয় এত আগ্রহ নিয়ে পড়া হইসে।
ভাই, সেবা প্রকাশনীর ক্লাসিকগুলো নিয়ে একটা লেখা লিখবেন্না?
সেবা প্রকাশনীর কোনও বই ই আমার পড়া হয় নাই! সমবয়সী বন্ধুরা এত প্যাশান নিয়ে পড়তো, তাই পড়ার কোনো চেষ্টা করি নাই!
এই বয়সে মাসুদরানার কথা মনে করায় দিলেন ভাই। ক্যামিস্ট্রি ক্লাশে বই এর নিচে নিয়ে খুব মন দিয়ে পড়তে যেয়ে স্যারের কাছে যে ধরা খাইছিলাম। বইটা ছিল পিচাশ দ্বীপ। তার ফলাফল আর না ই বা বললাম।
এই বয়সে মাসুদরানার কথা মনে করায় দিলেন ভাই। ক্যামিস্ট্রি ক্লাশে বই এর নিচে নিয়ে খুব মন দিয়ে পড়তে যেয়ে স্যারের কাছে যে ধরা খাইছিলাম। বইটা ছিল পিচাশ দ্বীপ। তার ফলাফল আর না ই বা বললাম।
আততায়ী... এই বইটা কতবার খুজছি নীলক্ষেতে, এখনও হস্তগত করতে পারিনাই
আর মাসুদ রানা তো মাসুদ রানাই। বস জিনিস। আমার পয়লা রানা ছিলো 'সাগর সঙ্গম' না বুইঝা পড়ছিলাম ক্লাস ফাইভ কিংবা সিক্সে। মজা পাইনাই তেমন, তাই কুয়াশাতেই আটকায়ে ছিলাম। পরে বিশাল গ্যাপ শেষে ইন্টারে আইসা রানায় বুঁদ হয়া গেলাম...
তবে নিকট অতীতের সেই কুয়াশা বইটা একেবারে ভালো লাগেনাই। কুয়াশা আর মাসুদ রানাকে দেখা না করালেই ভালো হ'তো...
আপনি এত্ত কিছু মনে রাখেন কেমনে? মন অপারেট করনের উপায় কি জনাব?
একটা জেনারেশন বড়ই হইছে মাসুদ রানা পড়ে...
আহা সেই দিন..
আহা, মাসুদ রানা...
কী সুন্দর ছিলো সেই দিনগুলো, যখন মাসুদ রানা-য় বুঁদ হয়ে থাকতাম!
মাসুদ রানা চিরতরুণ কিন্তু আমার বেলায় হিসাব ভিন্ন! বয়স বেড়ে গেলো, সেই সাথে ব্যস্ততা! মাসুদ রানার সাথে এখন আর দেখাই হয় না! তবে রহস্যপত্রিকা-টা এখনো ছাড়তে পারিনি...!
কত কথা মনে পড়ে যায়!
সেবা প্রকাশনী নামটা মনে পড়লেই খুব মিস করি ছেলেবেলার প্রিয় সেই কিশোর ক্ল্যাসিক, তারপর একে একে নামি-দামী লেখকের দারুণ সব অনুবাদ, ওয়েস্টার্ন আর অবশ্যই রানা সিরিজের বইগুলোর কথা! অসাধারণ!
মাসুদ রানা'র সাথে আর কিছুর তুলনা চলে না।বয়স বেড়ে গেসে। চুল পেকে গেসে। কিন্তু রানা আর সোহানা এখনো সবুজ, মনের ভিতর।
গত পঞ্চাশ (প্রায়) বছরে এপার বাংলার সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পৌরুষদীপ্ত নায়ক চরিত্র একজনই - মাসুদ রানা।
সোহানা আর রানার প্রথম প্রেম রাফেলা বার্ডের খোঁজে জীবন সারা...
বইয়ের পিছনের অনেক গল্প জানা গেল।
~
মন্তব্য করুন