ইউজার লগইন

তিশানের চলে যাওয়া

১.
তিশানের ভাল নাম ইশমাম। দুটোই আমার রাখা। তিশানের জন্ম ১৯৯২ সালে, ১২ জুলাই। তথন খুব ইউরোপীয় চিত্রকলা নিয়ে পড়তাম। ইতালীর এক বড় শিল্পীর নাম তিশিয়ান বা তিশান।আমার বড় বোনের ছেলে হল, নাম রাখলাম তিশান।
তিশান আমাদের চার ভাই–বোনের পরিবারের প্রথম সন্তান। সেই যে পিজি হাসপাতাল থেকে ওকে নিয়ে আসলাম সেটা এখনও চোখে ভাসে।তিশান ছিল সবচেয়ে আদরের। চোখ দুটি ছিল অসাধারণ।কখনো রাগ হতে দেখিনি। কিছু বললে কেবল হাসতো।
সেই তিশানের জীবন থেমে গেছে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর। আমার ভাইবারে তিশানের প্রোফাইলে দেখা যাচ্ছে ‘লাস্ট অনলাইন অন অক্টোবর ১৫’।
আমার অফিস যেতে হয় সকাল ১১ টায়। ওই দিন ভাল লাগছিল না, বের হলাম দেরিতে। খামার বাড়ি মোড় পার হতেই ফোন। আমার বউ ফোন করে বলল, এক পুলিশ সার্জেন্ট ওকে ফোন করে বলেছে যে কুড়িল–বিশ্বরোড রেল ক্রশিং–এ ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট করে তিশান কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে।সাথে সাথে আমি ফোন দিলাম তিশানের নাম্বারে। পুলিশ সার্জেন্ট একই কথা বলে বলল, দ্রুত আসেন। আমি যখন পৌঁছালাম, তখন প্রায় তিনটা।এমার্জেন্সিতে যেয়ে জানলাম আমি আমার বড় ছেলেকে চিরদিনের মতো হারিয়েছি।
ভয়াবহ এই বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত আমাদের পুরো পরিবার। সবার জীবন যেন থমকে গেছে। তিশান আমাদের জীবনের আনন্দ নিয়ে চলে গেছে, রেখে গেছে আজীবন বয়ে বেড়ানোর বেদনা।
তিশানের এভাবে চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। এ অন্যায়, চরমতম অবিচার। তিশানের মৃত্যু আমার অনেক বিশ্বাসকে টলিয়ে দিয়েছে।

২.
তিশান জগন্নাথে বিবিএ করছিল। খণ্ডকালীন কাজ করতো একটা কলসেন্টারে।হাসপাতালে ওর বন্ধুরা এসে ভিড় করেছিল।এসেছিল সহকর্মীরা। দূর্ঘটনায় মৃত্যু, তাই পুলিশের বেশ কিছু প্রক্রিয়া ছিল। সেগুলো শেষ করতে সময় লাগছিল। এর মধ্যে দাফনের ব্যবস্থা করতে হচ্ছিল। বন্ধুরাও মেনে নিতে পারছিল না তিশানের মুত্যু।
একটু দূরে আর সামরিক বাহিনীর ব্যবস্থাপনায় থাকা হাসপাতালটিতে ভিড় একেবারেই কম। সেই হাসপাতাল প্রাঙ্গন ভরে গেলে সহপাঠিদের কারণে। আমাদের আত্মীয়–স্বজনেরাও ছিলেন। আর ছিল ফেসবুক। তিশানের মৃত্যু স্থান পেল বন্ধুদের ফিসবুকের পাতায় পাতায়। দাফনের সিদ্ধান্ত ও সময় ঠিক করার সাথে সাথে মুহুর্তে আপডেট হতে লাগল ফেসবুক। বুঝলাম অনেকেরই শোক প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম এখন ফিসবুক।
তিশান এখনও ফেসবুক জুড়ে আছে। আমাদের আত্মীয় স্বজনেরা কেউ কেউ তাদের কাভার ফটো বদলে ফেলেছে।সেখানে স্থান পেয়েছে তিশানের সঙ্গে তোলা তাদের ছবি। আমি সেসব ছবি দেখি, তিশানের ফিসবুকে যাই। ওর ভাবনাগুলো বোঝার চেষ্টা করি, স্ট্যাটাসের ধরণ দেখে ওর চিন্তা–ভাবনা বোঝার চেষ্টা করি।
আমরা সবাই ব্যস্ত। তিশানও ছিল ব্যস্ত। এই ব্যস্ত জীবনে কাজের কথাই হতো। কিন্তু ওকে বোঝার জন্য কথা তো কখনো বলিনি। তিশান কি ভাবতো, কি নিয়ে ছিল ওর মনোজগৎ সে সব তো জানা হয়নি। মনে হলো, শুধুমাত্র তিশানকে নিয়ে তো তিশানের সাথে সেরকম কথাবার্তা আমার হয়নি। এখন সেসব জানতে আমার আগ্রহ হচ্ছে। কিন্তু তিশান তো নেই। তাই আমি তিশানের ফেসবুকেই ঘোরাঘুরি করছি প্রতিনিয়ত।
৩.
মনে হল তিশান কি কাউকে পছন্দ করতো? ২২/২৩ বছরের একটা ছেলের তো পছন্দ থাকতেই পারে।আমার চার খালাতো বোন তিশানের প্রায় একই বয়সী। সম্পর্কে খালা হলেও ওরা বন্ধুর মতোই। জানলাম, পছন্দ ছিল, তবে মেয়েটা জানে কিনা তা কেউ বলতে পারলো না। না জানুক, না বুঝুক, তারপরেও খুব ইচ্ছা করে মেয়েটিকে একদিন ডেকে কথা বলি।
৪.
মৃতের পরিবারের আবহাওয়াটা কেমন হয়? খবর পাওয়া মাত্র আত্মীয়–স্বজনে ভরে গেল পুরোটা বাসা।ছিল পাড়া–প্রতিবেশীরাও। কবিতায় আছে মানুষের শোকের আয়ু বড় জোর দুই বছর। কিন্তু সবার জন্য নিশ্চই তা নয়। প্রত্যেকেরই আলাদা জীবন আছে।অনেকেরই আর মনে পরবে না হয়তো।মনে পরলেও দীর্ঘস্থায়ী হবে না।না থাকুক। তারপরেও কারো নিষ্ঠুরতা দেখা হয় শোকের বাড়িতেও।
দূর্ঘটনা কখনো ভাল কোনো দৃশ্য হবে না। আর সেই দুর্ঘটনার বিবরণও দেওয়ার মতো হয় না। তারপরেও কেউ কেউ আছেন তাদের পুরোটাই জানতে হবে। আর সেটি তাদের বলবেন তিশানের মা–বাবা–নানু অথবা মামা–খালারা। একজন আসেন। কান্নারত আমার মা কে জিজ্ঞেস করেন কিভাবে ঘটলো। আমার মা বলতে গিয়ে শেষ করতে পারেন না। কান্না শেষ করতে দেয় না। একটু পর আরেকজন আসেন। আবার এই প্রশ্ন। আবার কান্না।
দ্বিতীয় দিন থেকে আসলো খাবার। বাসায় রান্নার অবস্থা নেই। অনেকেই রান্না করা খাবার নিয়ে আসছেন। এই সহমর্মীতা দেখতে ভাল লাগে, প্রয়োজনও আছে। এরই মধ্যে দেখলাম কেউ একজন পোলাউ রান্না করে পাঠিয়েছেন। দেখা গেল তিশানের মৃত্যৃ উপলক্ষ্যে অনেকেই পোলাউ–মাংস খাচ্ছেন। সেই তিশানের মুত্যৃতে, যে তিশান পারলে তিন বেলাই পোলাউ খেতো। আমার মা বলতো, মামার ভাগ্নে, যার পোলাউ হলে আর কিছু লাগে না।
আমরা কিন্তু তিশানের মৃত্যুতে ৮শ জনকে মিস্টিও খাওয়ালাম। অনুষ্ঠানটার নাম কূলখানি। সবচেয়ে ভাল দোকানের রসগোল্লা, বালুসাই, নিমকি আর সিঙ্গারা খাওয়ালাম। আমাদের তিশান ওর নানার কবরের পাশে শুয়ে আছে, আর আমরা তখন মিস্টি খেলাম, আমাদের অনেকের সাথে অনেকের বহু বহু দিন পর দেখা হল। সেই দেখা–সাক্ষাতের কারণে একটা আড্ডাও হল। কুলখানি নামের অনুষ্ঠানটি আমরা অনেকে আনন্দের সাথে পালন করলাম।
আমার অনেক বিশ্বাসই টলে গেছে–আমি কথাটি আবারও বললাম।
৫.
সব কাজ তুচ্ছ মনে হয়, পণ্ড মনে হয়
সব চিন্তা, প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়
শূন্য মনে হয় ।

পোস্টটি ২২ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

প্রিয়'s picture


নিষ্ঠুরতা!

আরাফাত শান্ত's picture


Sad

মিশু's picture


Sad

জ্যোতি's picture


যার প্রিয়জন চলে যায় চলে যাওয়ার, না থাকার কষ্টটা সে সবচেয়ে ভালো বুঝে। এই কষ্ট কেউ কমাতে পারবে না। তবু বলি আল্লাহ শোক সহ্য করার শক্তি দিন। তিশান যেখানেই থাকুক আল্লাহ তাকে ভালো রাখুন। ভালো থাকেন সবাই।
কূলখানি নামক আনন্দ অনুষ্ঠান মানুষ বানিয়েছে, এইটা নিজেদের বিশ্বাস। এসব বর্জন করা উচিত

উচ্ছল's picture


পরম করুনাময় আপনাদের শোক সহ্য করার শক্তি দিন। Sad
তিশান যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক।

টুটুল's picture


কারো স্থান কেউ পুরণ করতে পারে না কখনো... শুন্য স্থান সবসময়ই শুন্য থাকে... আর যার যায় সেই একমাত্র বোঝে যে, সে কি হারাইছে Sad

কিছু বলার নেই বস Sad

আল্লাহ আপনাদের পরিবারকে এই শোক কাটিয়ে ওঠার তৌফিক দান করুন... আমিন

এ টি এম কাদের's picture


" সব কাজ তুচ্ছ মনে হয়, পণ্ড মনে হয়
সব চিন্তা, প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়
শূন্য মনে হয় ।"

কি ক্ষটক্র অনুভুতি ! মহান আল্লাহ আপনাদের ক্ষট সহ্য ক্রার শক্তি দিন !

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


তিশানরা কেন অকালে ঝরে যায়?
মন খারাপ করা লেখা। Sad

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


প্রচণ্ড মন খারাপ করা লেখা। Sad

১০

লোকেন বোস's picture


শূন্য মনে হয়
শূন্য মনে হয়

১১

ফাহিমা দিলশাদ's picture


আপনার লেখা পড়ে আসলেই অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরছে মনে।
তিশান তুমি যেখানেই থাকো অনেক অনেক ভালো থেকো

১২

সামছা আকিদা জাহান's picture


সব শূন্য মনে হয়।

১৩

রুধীন's picture


মাসুম ভাই, আমার মনে হয় আমার মা আমার বা সন্তান এদের মধ্যে কেউ মারা গেলে আমি স্বাভাবিক ভাবে বেচে থাকতে পারব না । এই সব ভাবলে আমি স্হির থাকতে পারিনা। সেদিন কি আমার বিশ্বাস ও টলে যাবে? মৃত্যূ শোক সইবার শক্তি আল্লাহ হয়তো দিয়ে দেন আমাদের। আপনার লেখাটা পড়ে খুব খারাপ লাগছে। সহানুভূতি রইল।

১৪

স্বপ্নের ফেরীওয়ালা's picture


অনেকদিন পর মাসুম ভাইয়ের লেখা দেখে রীতিমত ঝাঁপিয়ে পরলাম....তারপর... Sad(

যেখানেই থাকুক, ভাল থাকুক তিশান...

~

১৫

তানবীরা's picture


দেরীতে পড়লাম - জানলাম ...... সমবেদনা

কিছু বলার নেই বাকীটা নিয়ে। কূলখানীর মেনু ভাল না হলেও অনেক সমালোচনা হয়, সেদিকটা খেয়াল করেছেন ....এইতো

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শওকত মাসুম's picture

নিজের সম্পর্কে

লেখালেখি ছাড়া এই জীবনে আর কিছুই শিখি নাই।