মনের গুরু "তনা"-আমার তসলিমা নাসরিন
“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি”- এভাবেই তো চলতাম! যে যা বলতো শুনতাম, জানতাম একমাত্র লেখাপড়াতেই এ মেয়েজীবনের মুক্তি ঘটতে পারে। পাড়ার সবাই ভালো মেয়ে ভালো ছাত্রী হিসেবে আমার উদাহরণ টানতো। আমি ও তাতে কম আহ্লাদিত হতাম না। মাটির দিকে তাকিয়ে স্কুলে যাই, মাটির দিকে তাকিয়েই ফিরে আসি, যাতায়াতের পথে কেউ ভালো বললেও রা কাড়ি না, মন্দ বললে তো একদমই কাড়ি না। বাসে যদি কেউ গায়ে হাত দেয় কিশোরী আমি লজ্জায় দুঃখে মনে মনে কাঁদি, বাসায় ফিরে কেউ না দেখে মতো করে কাঁদি, কখনো স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে কাঁদি। এই ছিলাম ৯২ সাল পর্যন্ত, ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমার জানা আমি। মা-বাবার ভালো ছাত্রী, ভালো মেয়ে, পাড়া প্রতিবেশীর লক্ষ্মী মেয়ের রোলমডেল হঠাৎ করে রং বদলানো পৃথিবীকে অন্যচোখে অন্যধ্যানে একটু একটু বুঝতে শুরু করলাম। কচি মনে মালুম হতে থাকলো সারাদেশ যে লেখকের লিখা নিয়ে ছিঃ ছিঃ করছে তার লিখা পড়ে আমার বদল হচ্ছে, আর আমি ভালো মেয়ের সার্টিফিকেট হারাচ্ছি প্রতিনিয়ত অল্প অল্প করে।
বাসে প্রাপ্য অশোভন আচরণের বিরুদ্ধে হায় আমি রুখেও দাঁড়ালাম। একতাই বল এ নীতির প্রয়োগে আমরা বান্ধবীরা এসব বিকৃত লোকজনকে হরহামেশাই জটিল মারা মেরেছি, এমন ও হয়েছে বাসের সবাই একযোগে আমাদেরকে বলছে অপরাধী লোকটাকে ছেড়ে দিতে, আমরা দেইনি। আমি জানলাম যে অপরাধ করেছে তাকে কাঁদতে হবে, অপরাধের শিকার আমার কান্নার কোন কারণ ঘটেনি। তনা আমাদের মনোজগত এভাবে পাল্টে দিচ্ছিলেন নিজের লেখনী দিয়ে। ৯৪ এর বইমেলা, ৮-৯জন বান্ধবী গিয়েছি, মাঝখান দিয়ে এক ফ্রেন্ড এর বুকে খামচি দিলো চরম ভীড়ের মাঝে একটি হাত, আমার বান্ধবী ধরে ফেললো সেই হাত, সেই লোক এবার আমার বান্ধবীর হাতে খামচালো ছাড়া পাবার জন্যে, আমরা ধরে ফেললাম, আমাদের ব্যাগ ভর্তি তসলিমার বই, মন ভরা তাঁর দেয়া সাহস, আমরা একমেলা মানুষের সামনে সেই লোককে গালে থাপ্পড় একের পর এক দিলাম, তারপর কান ধরে উঠবোস করালাম। আমরা সবাই সেই সময় কাজে ও তসলিমা হতে চাচ্ছিলাম। এভাবে গুডগার্ল ইমেজ একবারেই তিরোহিত হয়ে গেল, যা নিয়ে আজো আমি গর্বিত।
’”যায় যায় দিন” সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন তখন না পাক্ষিক?? স্মৃতি বলছে সাপ্তাহিক। হায় হায় কি সাংঘাতিক সব কলাম-“মৌচাকে ঢিল” নামক কলামে। ধ্যানের নিভৃতিতে, চরম হলাহলে আমরা একপাল কিশোরী ক্ষুরধার এক লিখনের মুখোমুখি। যে লিখন ল্যাটপেটে প্রেমের কথা বলছে না, বরং আমাদের প্রতিদিনের বঞ্চনাগুলোকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। মর্নিং শিফটে পড়া মেয়েরা না কি ছেলেদের মতো Rag ডে যারা ডে শিফটে পড়ে করতে পারবে না। সবসময় আমাদের মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্যে আলাদা নিয়ম। টিচারদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা এসএসসি পরিক্ষার্থী মেয়েরা ছেলেদের মতোই Rag ডে করলাম।
বাসায় বাইরে সর্বত্র রক্তচক্ষু তাঁর লিখা পড়া নাযায়েয এ মর্মে। আমরা পড়ছি, একজন কিনলে আরেকজনকে দিচ্ছি, টিফিনের ফাঁকে গোল হয়ে পড়ছি, বোরিং কোন ক্লাসের মধ্যে মলাট দিয়ে পড়ছি, আমাদের বাসস্থান মীরপুরে এ লেখকের বই সহজলভ্য নয়, আমরা খোঁজ নিয়ে জানলাম নিউ মার্কেট এবং বেইলী রোডে সব বই পাওয়া যায়। কি কষ্ট করে যে আমরা বেইলী রোড গেলাম সাগর পাবলিশার্সে, “তবুও বই পড়ুন” দোকানে। পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম, সবাই আমাদেরকে ঘুরে ঘুরে দেখছে। আমরা ফিরলাম “নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য” নিয়ে।
“লজ্জা” বা “ভ্রমর কইও গিয়া” সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তা আমাদের কাছে মনে হতো না। তার চাইতে আমরা গোগ্রাসে গিললাম “যাব না কেন যাব”, “নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য”, “নির্বাচিত কলাম’; “বেহুলা একা ভাসিয়েছিলো ভেলা”, রুদ্রর বন্ধু রুদ্রর মতো না হলেও কবিতা ভালো লিখে আমরা একমত হলাম।
সারাদেশ আন্দোলনে জেরবার, সিলেটের কোন এক হুজুর তসলিমাকে তওবা পড়তে বলেছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, তসলিমার ফাঁসী চাওয়া হচ্ছে। যে কোনদিন কোন লিখা তার পড়েনি সেও তসলিমাকে গালি দিচ্ছে। আমাদের সরকার ডুগডুগি বাজাচ্ছে। আমাদের বুদ্ধিজীবিরা আত্মতোষণে ব্যস্ত। একজন তসলিমাকে মুরতাদ ডাকলে কি হয়!একজন নষ্ট নারী দেশান্তরী হলে কি হয়! কিছু হয় না। প্রথম প্রথম খুব মন খারাপ করতাম। দিন যেতে যেতে বন্ধুরা তাকে ভুলে গেল। একজন তসলিমা গোটা দেশ অচল করে দিলো, বহুবছর ধরে চলা সমাজ যেন থমকে দাঁড়ালো একজন তসলিমার আশংকায়। তসলিমা তখন আরো বেপরোয়া, তসলিমা তোমাদের আমি থোড়াই কেয়ার করি এ ভঙ্গী বোঝাতেই যেন টিভিতে সিগারেট পোড়ালেন। আমার মাথার ভেতর তিনি রয়ে গেলেন। সিগারেট হাতে তসলিমা, শার্ট পরা তসলিমা, ডোন্ট কেয়ার তসলিমা, কবিতার তসলিমা, দুঃখী তসলিমা, বেস্ট সেলার তসলিমা। নোংরা রাজনীতি আর মৌলবাদের হাতে হাত ধরে চলা সিম্ফনীর সরল শিকার তসলিমা আমার মস্তিষ্কের ধূসর কোসে রয়ে গেলেন। বন্ধুরা তাকে জীবনের অনেক ঘটে যাওয়া ঘটনার মতোই ভুলে গেল। আমি বইমেলা, বই এর দোকান, ইন্টারনেট সব খুজেঁ আজো তাকে পাঠ করি। আউট অব দ্য বক্স কিছু করলেই আজো শুনি “তসলিমা নাসরিন” হইছো! যারা আমাকে এ কথা বলে তাদের মুখের উপর আমি মনে মনে হাসি এ ভেবে তোমরা তো জানো না এ আমার জন্য কত বড় কমপ্লিমেন্ট!
এমন এক দেশে তোমার জন্ম মেয়ে যেখানে বেগম রোকেয়াকে চাওয়া হয় না, চাওয়া হয় মানুষ নামক ছায়া, যারা কোন কিছুতেই না বলবে না। তুমি ডাক্তার না লেখক, তুমি গুণী না নির্গুণ, তুমি ভাবুক না সংসারী, এসবের কোন মূল্য এখানে নেই। তুমি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, তুমি লেখক বা শিল্পী নও মহিলা কবি, নারী লেখক, লেডি ডাক্তার - এখানে কমন জেন্ডার বলে কিছু নেই। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর, আর অধীনতার শত বছর ধরে এখানে কোন নারী আন্দোলন, মানুষের অধিকার আদায়ের অধিকার দানা বাঁধেনি।তুমি সেখানে কলম দিয়ে বিপ্লব চেয়েছো। আর কিছু সুবিধাবাদীর মুনাফা করার জন্যে পণ্যে পরিণত করেছো নিজেকে নিজের অজান্তেই। তোমার ছবি দিয়ে বই এর মলাট দিয়ে এখনো ব্যবসা করছে এদেশের প্রকাশকেরা। এখানে মনোবিজ্ঞানের নামে বই লিখে কাঁচা যৌনতা যখন কিশোর কিশোরীর হাতে তুলে দেয়া হয়, প্রকাশকেরা তা বাজারজাত করেন তখন কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলে না,কারণ সে পুরুষ লেখক, নারী কোন যৌনতার কথা বললেই তা শ্লীল কি অশ্লীল - বলা ঠিক হয়েছে কি না তার জন্যে পাল্লা মাপা শুরু হয়। এখানে চাঁদকে ফালি ফালি করে কাটার কথা বলতে গিয়ে বারবার সঙ্গমের কথা বললে সেই বই এর কাটতি হয়, সেই লেখক জাতে উঠেন, তারা নিষিদ্ধ হন না- কারণ তারা একে তো পুরুষ লেখক, তার উপর বুদ্ধিজীবির তক্মা আঁটা এবং আমাদের বুদ্ধিজীবিরা নিজেদের পুরুষতান্ত্রিক আহ্লাদীপনা চালু রাখতে ভীষণ রকম সংঘবদ্ধ। এ নারী যেহেতু প্রচলিত সব ট্যাবু ভেঙ্গে চুরমার করেছে তাকে সমর্থন দেবার প্রশ্নই উঠে না, এ নারীর লেখা কেউ ভালোবেসে পড়ছে, কেউ ঘৃণা থেকে পড়ছে, কেউ নিতান্ত কৌতূহলে পড়ছে, মেলায় তখন পুরুষ লেখকদের বই কোণঠাসা, তসলিমার বই উঠে এলো তিন নাম্বার বেস্ট সেলার হিসেবে, একে আটকাও, আমাদের বুদ্ধিজীবি আহমদ ছফা, হুমায়ূন আজাদ সহ আরো অনেকে নিজেদের প্রথম পরিচয় লেখক ভুলে ভীষণ পুরুষ হয়ে উঠলেন -তসলিমার সেই সংকটে তাকে রক্তাক্ত করতে আরো ভয়ংকর সব কথা বলা শুরু করলেন পত্রিকায়। আমাদের তসলিমার বই বিক্রি তাতে কমলো না বরং আরো বাড়লো। দেশে দেশে আজো আমাদের তসলিমা পঠিত- একজন ছফা কিংবা একজন আজাদ বিশ্বের অর্ধশত ভাষায় অনূদিতও হলো না, তাদের নামও শুধু ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে ছাপ্পান্ন হাজার মানুষের ভেতরই সীমাবদ্ধ থাকলো।
তসলিমাকে নিয়ে ভাবনা শেষ হয় না। এখনো কলম ধরলে তার কথা মনে পড়ে, কলাম লিখেছি যখন মনে পড়েছে তার কথা, ২০০৫ এ প্রথম ছোটগল্পের বই তাঁকেই উৎসর্গ করেছি লিখেছি “মনের গুরু তনা’কে”।
কড়া কথা, সুগার কোটিং দিয়ে বলা শেখেনি মেয়ে, তাই তার এবেলা ওবেলা জাত গেল, উনিশ বছর দেশান্তরী, মা কে দেখতে পারেনি মরণকালে। আমার দেশ গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেয়, মা কে দেখার উসিলায় একাত্তর এর পর জিয়ার আমলে গোলাম আযম বাংলাদেশে এসে স্থায় পেয়ে যায়, আর আমার খালেদা তাকে আদালত থেকে নাগরিকত্ব এনে দেন। আমার হাসিনা নির্বাচনের আগে গোলাম আযমের দোয়া নিতে যান, শুধু আমার তসলিমার এদেশে জায়গা হয় না।
আমাদের চুরচুর ধর্মানুভূতি! ধর্ষণ হলে আমাদের ধর্মবেত্তারা ফতোয়া দেন না, বালকের বলাৎকার হলে আমাদের ধর্মজীবিদের মাতম হয় না, এসিড মারা হলে আমরা সেই সন্ত্রাসীর ফাঁসী চাই না, “লজ্জা” লিখিত হলে আমাদের লজ্জা লাগে, ‘লজ্জা” যে কারণে লিখিত হয় তাতে আমাদের লজ্জা লাগে না। তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারো, শুধু ধরা পড়া যাবে না- এ হচ্ছে আমার দেশের নাগরিক সমাজের ঔচিত্যবোধ।
খুব মনে পড়ে তসলিমার সেই কথাটা “যুদ্ধের সকল ভাঙন, বুট ও বেয়নেটের নৃশংস অত্যাচার এবং মৃত্যুর মতো বীভৎসতা সবাই গ্রহণ করলেও ধর্ষণ দুর্ঘটনাটি গ্রহণ করেনি। বাইরে যখন মা-বোনের সম্মান নিয়ে চিৎকার করছে রাজনৈতিক নেতারা, তখন অসম্মান থেকে নিজেকে বাঁচাবার একমাত্র উপায় হিসেবে ঘরের কড়িকাঠে আমার খালা যে মাসে ফাঁসী নিয়েছে সে মাস ডিসেম্বর মাস।“ (নির্বাচিত কলাম, তসলিমা নাসরিন, পৃষ্ঠা-২২)
বীরাঙ্গনা শুধু মুখে মুখে, বীরাঙ্গনা নয় আসলে আমার দেশ বলতে চায় বারাঙ্গনা, বীর শব্দটি শুধু ই আদমের গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ।
তসলিমা আজো আমার একার সম্পদ, আমি তাকে পাঠ করি সময়ে অসময়ে, মনে মনে কখনো মায়া বোধ করি একজন নিঃসঙ্গ গ্রহচারীর জন্য, একজন দেশান্তরী মানুষের জন্যে। লেখক হিসেবে তার সাথে একাত্মতা বোধ করি, তার পক্ষে কথা বলে কটু কথা শুনি। এ শোনার কোন শেষ নেই। আমাদের মাতৃত্বকালীর ছুটি লাগে, আমরা অফিস আওয়ার শেষ হলেই বাসায় দৌড়াই, লেট সিটিং করতে চাই না - এমন অভিযোগগুলো শুনে চুপ করে থাকি। আমরা নারীরা সমঅধিকার চাই, সমান সমান বেতন চাই কর্মস্থলে, নিজেদেরকে পুরুষের সমকক্ষ মনে করি কিন্তু বাসে আমাদের জন্যে আলাদা আসন লাগে, সংসদে আমাদের কোটা লাগে- অভিযোগগুলো শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে সেদিন বলে ফেললাম বাসে কেন আলাদা আসন লাগে বলেন তো!-কোন উত্তর নেই চুপ। আমি বললাম কারণ আমাদের দেশের পুরুষরা জানে না নারী বা পুরুষ কোন মানুষের শরীরেই নিজের শরীরর ছোঁয়ানোর অধিকার কারো নেই অনুমতি ছাড়া। আমাদের পুং রা এখনো অশোভন আচরণের বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি বলেই নারীদের জন্যে এখনো অনেককিছুই আলাদা রাখতে হয় সে বাসের আসন ই হোক আর সংসদের আসনই হোক। প্রতিউত্তরে শুনলাম আমি তসলিমা নাসরিনের মতো কথা বলছি। ১৯বছর, ঊনিশ বছর তারপরও পুরুষের মুখে, নারীর মুখে যখন মেযে তোমার নাম উচ্চারিত হয় বিরক্তিতে ক্রোধে অথবা গালি হিসেবে তখন আমি খুশি হই- তুমি ফেলে দেবার বিষয় নয়, তুমি এখনো মানুষকে ভাবাচ্ছ, তুমি থাকবে, ছিলে, আছো এ প্রমাণ এভাবে দৈনন্দিনতায় উঠে আসে আজো। তাকে দেশে ফিরতে বলতে মন চায়, মন চায় বলি অনেক আগুন হলো, এবার উপশমের কথা বলো মেয়ে; তারপর ভাবি দেশে এলেই বা কি না এলেই বা কি- তোমার কলম যেন না থামে। তোমার কলম তোমাকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে, তোমাকে নিয়ে গবেষণা হবে এদেশেই একদিন আমি জানি নিশ্চয় করে। সত্যি তা কুৎসিত হোক বা সুন্দর সত্যক সত্য হিসেবে বলার শক্তি তোমার আছে, তোমার শক্তি আছে নষ্ট কথা বলার অবলীলায়, তাই তুমি তসলিমা, এটাই তসলিমা, এ ই -ই তুমি আমাদের তসলিমা। আমাদের কৈশোরের আইডল, প্রাত্যহিকতার সঙ্গী।
তসলিমাকে মনে পড়ে ‘আমার মেয়েবেলা” তে, দ্বিখন্ডিত, ক, ফরাসি প্রেমিক, শোধ, খালি খালি লাগে, উতাল হাওয়া সব পঠনে। অনেক নাম হয়েছে, অনেক খ্যাতি শুধু এদেশে তসলিমার কোন স্থান নেই- খুনি, যুদ্ধাপরাধী, দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, নষ্ট রাজনৈতিক সবার এদেশে থাকার অধিকার আছে। যে নারী প্রথা ভাঙবে এদেশ তার নয়, সরকার তার নয়, রাষ্ট্র তার নয়। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র অনায়াসে তার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাঁড়িয়ে যাবে, তথাকথিত নারী আন্দোলনের পুরোধারা একটি শব্দও উচ্চারণ করবে না।
আমাদের ১৫-২০ বছর বয়সী অনেকেই জানে না তসলিমা জমানার কথা, উত্তাল বইমেলার কথা, আমাদের লেখক সমাজের অনৈক্যের কথা। সব মনে পড়ে, আজ বিজন ঘরে তসলিমাকে খুব বেশী মনে পড়ে...মনে পড়তে পড়তে তসলিমার কবিতায় বিষণ্ন হই :
আমার জন্য অপেক্ষা করো মধুপুর নেত্রকোনা
অপেক্ষা করো জয়দেবপুরের চৌরাস্তা
আমি ফিরব। ফিরব ভীড় হট্টগোলে,খরায় বন্যায়
অপক্ষো করো চৌচালা ঘর, উঠোন, লেবুতলা, গোল্লাছুটের মাঠ
আমি ফিরব। পূর্ণিমায় গান গাইতে, দোলনায় দুলতে, ছিপ ফেলতে বাঁশবনের পুকুরে-
অপেক্ষা করো আফজাল হোসেন, খায়রুন্নেসা, অপেক্ষা করো ঈদুল আরা,
আমি ফিরব। ফিরব ভালোবাসতে, হাসতে, জীবনের সুতোয় আবার স্বপ্ন গাঁথতে-
অপেক্ষা করো মতিঝিল, শান্তিনগর, অপেক্ষা করো ফেব্রুয়ারীর বইমেলা
আমি ফিরব।
মেঘ উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পূবে, তাকে কফোঁটা জল দিয়ে দিচ্ছি চোখের,
যেন গোলপুকুর পাড়ের বাড়ির টিনের চালে বৃষ্টি হয়ে ঝরে।
শীতের পাখিরা যাচ্ছে পশ্চিম থেকে পূবে, ওরা একটি করে পালক ফেলে আসবে
শাপলা পুকুরে, শীতলক্ষ্যায়, বঙ্গোপসাগরে।
ব্রক্ষ্ণপুত্র শোনো, আমি ফিরব।
শোনো শালবন বিহার, মহাস্থানগড়, সীতাকুন্ড পাহাড়- আমি ফিরব।
যদি মানুষ হয়ে না পারি, পাখি হয়েও ফিরব একদিন।
(আমি ভালো নেই তুমি ভালো থেক প্রিয় দেশ, তসলিমা নাসিরন, পৃঃ-২৮৮)
আমি তোমার মানুষ হিসেবে ফেরার অপেক্ষা করি আজো...
চমৎকার লেখনি তে অসাধারণ এক পোস্ট।
ভালো লাগলো
এই কবিতাটা পড়লেই চোখে পানি আসে
অসাধারণ লিখেছো
আমার লেখায় যদি তনার মনের ব্যথা একটু উপশম হতো!
খুব ভালো লেখনী ! এই লেখার বেশ অনেক অংশই দারুণ ভাবে মৌলিক। মানুষ অন্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হোক কিন্তু সে মানুষ বাঁচুক তার নিজস্বতা টুকুতে, নিজের মৌলিকত্বটুকুতে। ঐ অংশটাই অন্যকে অনুপ্রাণিত করবে। এই লেখায় বেশকিছু অংশ এমন আছে যা পড়লে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার রেশ পাওয়া যায়।
চমৎকার লেখা আপি
মন্তব্য করুন