পত্রিকার স্মৃতি :: সাপ্তাহিক বিচিত্রা
আমার বর্ণশিক্ষার বয়স আর পত্রিকা পড়ার বয়স মোটামুটি কাছাকাছি।
সময়টা তাহলে ৮৮ কি ৮৯ ই হবে। বাংলা পত্রিকা নামক জিনিসটা দুর্লভই ছিল বৈকি।ইরানে বাংলাদেশের পত্রিকা যেত না, আর না যাওয়াটাই স্বাভাবিক।ইরাক সীমান্তবর্তী ইরানের ঐ অংশে সব মিলিয়ে বাংলাদেশী ১০/১২ জন ডাক্তার ছিলেন। বছরে গড়ে তিন/চারজন দেশ ঘুরে যেতেন, যাবার সময় লাগেজে ভরে কিছু পত্রিকা নিতেন। সেই পত্রিকা এরপর হাতে হাতে বদল হত হাজার হাজার বর্গ কিলোমিটার। কতবার করে পড়া হত তার ইয়ত্তা নেই। ছয় মাস কি এক বছরের পুরনোর পত্রিকারও আবেদন কমত না এতটুকু।
পত্রিকা বলতে তখন একটা পত্রিকাই চিনতাম- বিচিত্রা। সম্ভবত সে সময়কার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক। অন্তত ডাক্তার আংকেলরা বিচিত্রাই সাথে নিতেন। পত্রিকার সব পড়ার বয়স আমার তখন হয়নি, তবুও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যতটা পারি পড়তাম। কাভার পেজ উল্টালেই চোখে পড়ত রনবী'র টোকাই। টোকাইয়ের দু'টো ডায়ালগ পড়ার জন্য কখনও বা অপেক্ষা করতে হত মাসের পর মাস। সেসব ডায়ালগের মর্মার্থ বুঝতাম যে তা না , তার চেয়ে বরং কার্টুনটাই দেখতাম। টোকাই ছিল মূলত স্যাটায়ার বেইজড কার্টুন, সমাজের অসংগতিগুলো তীক্ষ্ণ ফলায় বিদ্ধ করত সে একটা বাক্যে। সেই টোকাইয়ের দেখা পাই না অনেকদিন , টোকাই কি বেঁচে আছে?
আরেকটা কার্টুন থাকত শেষ পাতার পুরোটা জুড়ে , ভীষণ মজার কার্টুন। এ কার্টুনের চরিত্রগুলো টোকাইয়ের মত ভারী ভারী কথা বলত না। মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভরা থাকত। হ্যাঁ, আসলেই মিষ্টি , আলাউদ্দিন সুইটসের মিষ্টান্ন। এখন বুঝতে পারি , পাতা জুড়ে কার্টুন ছিল আসলে আলাউদ্দিন সুইটমিটসের বিজ্ঞাপন। দেশে যখন ফিরেছি আলাউদ্দিন সুইটমিটসের জৌলুস নিভতে শুরু করেছে , কিন্তু সেই কার্টুনগুলোর স্মৃতিতে ভর করে একটা সময়কার তাদের তোলা ঝড় অনুভর করি। বেঁচে আছে আলাউদ্দিন সুইটমিটস? শেষ কবে কে কে গিয়েছেন?
টোকাইয়ের সাথে একই পাতায় থাকত সম্পাদকীয়। সে পাতা উল্টালে শিরোনামে থাকত "প্রেসিডেন্ট"। সপ্তাহের প্রেসিডেন্টের প্রধান কর্মকান্ড সম্বলিত সংরক্ষিত রিপোর্ট বা ফিচার। রাজনীতির খটোমটো কথা বুঝার বয়স তখন আমার হয়নি, আমি শুধু প্রেসিডেন্ট এরশাদের ছবি দেখেই সে পাতা থেকে বিদায় নিতাম। যতটা মনে পড়ে, প্রেসিডেন্টের জনসভার ছবিই বেশির ভাগ সপ্তাহে থাকত সেখানে।
বিচিত্রার একটু গভীরে ঢুকলে সাক্ষাৎকার চোখে পড়ত। সেসব বুঝার মত বয়সও হয়নি, তাই পড়তাম না কখনোই। রাজনীতি নামে সম্ভবত আলাদা একটা পাতাও ছিল, সংঘাত কিংবা হরতালের খবরের কথা আবছাভাবে মনে পড়ে।
পত্রিকা তো দূরের কথা, ইন্টারনেটবিহীন, টেলিফোনবিহীন সে সময়ে বাংলাদেশী পরিবারগুলোর একমাত্র ভরসা তখন বিবিসি বাংলা সার্ভিস। আমার আব্বাকে দেখতাম তুমুল সংগ্রাম করে হাজার চ্যানেলের কিচিরমিচির থেকে বিবিসি খুঁজতে। এমন অনেকদিন গেছে , চ্যানেল ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি , খবরও জানা হয়নি।
শেখ হাসিনার ছবি বিচিত্রার পাতা জুড়ে খুব বেশি করে দেখতাম। ৯১ এ নির্বাচন হবে , সবার কাছে শুনলাম শেখ হাসিনা জয়ী হতে চলেছে, ডঃ কামাল হোসেন হবেন প্রেসিডেন্ট। আমিও তাই জানি , হঠাৎ করে বিবিসি শুনে আমার আব্বা বললেন -- "খালেদা জিয়া জিতে গেছে"। কথাটা এখনও কানে বাজে।
খালেদা জিয়ার নামও ততদিনে কম শুনিনি।ইরানীদের কাছে প্রেসিডেন্ট জিয়া বেশ পরিচিত ছিলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে দু'টো কথাই মনে হতে তারা জানে , এক, বাংলাদেশ ডাক্তারে ভর্তি , দুই, জিয়া বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমার কাছে খালেদা জিয়া তখনও জিয়ার বউ, এর চেয়ে বেশি কিছু ছিল না। তবে সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হল, খালেদার কোন চেহারাই আমি মনে করতে পারলাম না। কখনও কোথাও , এমনকি বিচিত্রার পাতায় তার ছবি দেখেছি এমনটাও মনে পড়ল না।
সেই খালেদা জিয়াকে প্রথম দেখলাম ৯৩ এর জানুয়ারীতে , এক ডাক্তার আংকেলের নিয়ে যাওয়া বিচিত্রার কাভার পেজে। পত্রিকার শিরোনাম ছিল -- গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান। ব্যাকগ্রাউন্ডে সবুজ মাঠ, মাঝে সাদা শাড়ি পড়া খালেদা জিয়া। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর বৃক্ষরোপন অভিযানকে নিয়েই কাভার স্টোরি ছিল।
বিচিত্রার খুব জনপ্রিয় একটি অংশ ছিল প্রবাসীদের পাঠানো চিঠি বা লেখা। বলতে গেলে ঐ অংশটুকুই ভীষণ মনযোগ দিয়ে পড়তাম। বেশিরভাগ চিঠি যেত মধ্যপ্রাচ্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্র/যুক্তরাজ্য/জাপান থেকে। খুব মনযোগ দিয়ে খেয়াল করতাম কে কোথা থেকে লিখেছে। প্রবাসী মানুষগুলোর দুঃখ-কষ্ট-আনন্দের পরিস্কার একটা ছবি দেখতাম লেখার মাঝে। অনেকে প্রবাসীদের সংস্কৃতি , জীবন-যাপনের স্বাচ্ছন্দ্য, প্রযুক্তি নিয়েও লিখতেন।
খেলার খবরের জন্য বরাদ্দ থাকত সাধারণত দু'পৃষ্ঠা। অবধারিতভাবেই সেটা দখল করে রাখত ঢাকার ফুটবল মাঠ, আরও স্পষ্ট করে বললে- মোহামেডান আবাহনী। এর ব্যতিক্রম দেখেছিলাম বিশ্বকাপের সময়, আর্জেন্টিনা কিংবা ক্যামেরুনকে নিয়ে উন্মাদনা নিয়ে।
চলচ্চিত্র নিয়ে যে দু'টো পাতা থাকত , সে অংশ নিয়ে রয়েছে মজার স্মৃতি। আপ্রাণ চেষ্টা করতাম , সে পাতাগুলোর দিকে চোখ না দিতে। নায়ক-নায়িকা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আছে, এমন খারাপ কাজের কথা ভাবতেই পারতাম না। অবাক হচ্ছেন? আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইরানের কুর্দিস্তানে যে সমাজ-ব্যবস্থায় বড় হয়েছি সেখানে এমন কিছু আসলেই ছিল কল্পনাতীত। তবুও দু'একজন নায়ক নায়িকার নাম মনে করতে পারি যারা একটু বেশিই আমাকে বিব্রত করত - নতুন, রাণী, সুনেত্রা, অঞ্জু ঘোষ, রুবেল , মান্না।
বিচিত্রার পেছনের পাতায় একটা বিজ্ঞাপনের কথা খুব বেশি মনে পড়ে। ভাঁজ করে রাখা হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে পেছনে তাকিয়ে আছে ভারী অলংকার পড়া একটি মেয়ে। সম্ভবত আমিন জুয়েলার্সের বিজ্ঞাপন ছিল সেটি। যতটা মনে পড়ে আমার শৈশবের বিচিত্রা-পর্বের পুরোটা সময় জুড়েই সে বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হত। এর বাইরে মনে পড়ে ব্যাক কাভারে ম্যানোলা ক্রিমের বিজ্ঞাপনের কথা ।
"পত্রিকা" শব্দটা আমি তখন জানতাম কিনা মনে পড়ে না, সম্ভবত পত্রিকাকে আমি "বিচিত্রা" নামেই প্রথম চিনেছি। বিচিত্রাও হারিয়ে গেছে , হারিয়ে গেছে ছোটবেলার বিচিত্র সেসব দিন। শুকনো পাতার মত কয়েকটা স্মৃতি কেবল রয়ে গেছে
আপনি মানুষটা খুব খারাপ, কালরাতে একবার নস্টালজিক করেছেন আবার এখন করলেন। পেপার পত্রিকা পড়ার অভ্যাস খুব ছোটবেলা থেকে। অনেক কিছু মনে করে দিলেন। আমার খুব প্রিয় একটা পত্রিকা ছিলো ''ক্রীড়াজগত'' ফুটবলার মুন্না-রুমি খুব প্রিয় খেলোয়াড় ছিলো। মুন্নাতো মারা গেছে ''রুমি'' কোথায় আছে বলতে পারেন?
রাসেল আশরাফ ভাই , দেশে যাচ্ছি কয়েকদিন পরেই । তাই আমার নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক সময়, বেশিদিন মন খারাপ করে থাকতে হবে না। ক্রীড়াজগতের কথা পরে কোন পর্বে বলব ভেবেছিলাম, দেশে ফেরার পর ৯৪ এ প্রথম দেখেছিলাম ক্রীড়াজগত। আপনি আবাহনীর সমর্থক বুঝতে পারছি , আমার এন্টি
বিচিত্রারই আরেকটা স্মৃতি শেয়ার করি। ৯১ এর সাফ গেমস চলাকালীন ছাপা হওয়া বিচিত্রার একটি সংখ্যার কথা মনে পড়ে , সেটাও অনেক পরে পড়েছি। একটা ছবি ছিল , রুমী বল নিয়ে একজন ডিফেন্ডারকে ফাঁকি দিয়ে দৌড়াচ্ছে। নিচে ক্যাপশনে লেখা ছিল -- রুমীর গোলে বাংলাদেশ প্রথম বারের মত ভারতকে পরাজিত করে ২-১ গোলে। পত্রিকা ছাপা হওয়ার বছরখানেক পরেও সে ক্যাপশন পড়ে কি যে ভাল লেগেছিল বুঝাতে পারব না। ফুটবল তো তখন আমাদের রক্তে মিশে ছিল।
রুমী কোথায় আছে , সেটা জানিনা। জানতে পারলে জানাবো
আলাউদ্দিনের মিষ্টি, অপুর্ব সৃষ্টি।
আলাউদ্দিনের মিষ্টির দোকান এখন শুধু মগবাজার ওয়্যারলেসের কাছের একটা দোকানেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে, অন্তত গতবছর পর্যন্তও দেখেছিলাম। সেদিনই কাকে যেনো বলছিলাম, আগে ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় আসলে যার বাড়িতে যাচ্ছি সেই বাড়ির জন্য আলাউদ্দিনের মিষ্টি নেয়া অবশ্য কর্তব্য ছিলো, আর এখন?
মৌচাক মোড়েও একটা আলাউদ্দিন ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে ছিল । ২০০২/২০০৩ সালের দিকে ভার্সিটি অ্যাডমিশন কোচিং করার সময় আমি ঐ দোকানের রেগুলার কাস্টমার ছিলাম। ফাস্টফুড বিক্রি করত কিছু কিছু , কোয়ালিটি বেশ ভাল ছিল
এক সময়ে আমার কাছে বিচিত্রার শতাধিক বিচিত্রার বিশাল এক সংগ্রহ ছিল। প্রতি বৃহস্পতিবারের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম।
ফেলে দিসেন নাকী সব ? আপনার ইত্তেফাক নিয়েও লিখব , কোন নিউজ থাকত না , মেজাজ বিলা হয়ে যাইত
ছোটবেলায় পত্রিকা পড়ার তেমন সুযোগ ছিলো না
পত্রিকা জিনিসটা আসলেই একটা সৌখিন জিনিস ছিল , এখনও সম্ভবত তাই রয়ে গেছে অনেকাংশেই । ১৬ কোটি মানুষের দেশে শীর্ষ দৈনিকের সার্কুলেশন সাড়ে চার লাখ মাত্র!!
ওই আলাউদ্দিন আর বাইচা নাই.........
আলাউদ্দিন-এর এখন সন্ধি বিচ্ছেদ হয়ে গেছে...
কেন বাঁচতে পারল না ভাবি । এমন না যে ঢাকায় অনেক ভাল মিষ্টির দোকান এসে গেছে, সব মিলিয়ে মিষ্টির মান পড়ে গেছে মারাত্মক ভাবে । দু'একটা দোকান ভাল মিষ্টির নিশ্চয়তা দেয় , কিন্তু তাদের দাম বেশিরভাগ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে
আমাদের সময় ছিল আনন্দ বিচিত্রা। ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতা। পাক্ষিক ছিল বোধহয়। অপেক্ষা করে থাকতাম আর মুখস্থ করতাম
আপনার সময় কি তাহলে আমার পরে ?
দেশে আসার পর আনন্দ-বিচিত্রা দেখলাম , মেয়ে মহলে তুমুল জনপ্রিয়। বিদেশে দেশী চ্যানেল দেখা যেত না বলে তারকাসংক্রান্ত পত্রিকা ভাত পেত না।
আচ্ছা , এসব ম্যাগাজিন আকর্ষণ কি হারিয়ে ফেলেছে ? নাকি আমিই খেয়াল করে দেখিনা
আমার সময়টা ছিল ৯০ এর দশক
বিচিত্রা বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত পড়েছি... নিয়ম করে... বৃহষ্পতিবারের জন্য হুলস্থুল অপেক্ষা ছিল। বছরের আলোচিত চরিত্র নিয়ে একটা সংখ্যা বের করতো। ঈদ সংখ্যায় ফ্যাশন এড করে কিন্তু ব্যাপক সারা জাগায়। প্রথমবার পিয়ারসন্স হিট হয়
... অনেক ইতিহাস :)। কিন্তু এখন আর সেই উন্মাদনা দেখি না। এমন কোন সাপ্তাহিকের নাম সামনে আসেনা যেটা বিচিত্রার সময়ে ছিল।
এই একটা পত্রিকা বোনকে না দিলে কি হইতো
সাপ্তাহিক বিচিত্রা ছিল আমার প্রিয় পত্রিকা | পাঠকের পাতা, জীবন যেখানে যেমন, ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন, প্রচ্ছদ কাহিনি, প্রবাস থেকে, কুরুক্ষেত্র ছিল আমার খুবই প্রিয় | ছিয়াত্তর/সাতাত্তর সালে মাল্যেশিয়ার মারদেকা কাপে অংশগ্রহনকারী বাংলাদেশ টিমের বিচিত্রায় প্রকাশিত একটি ছবি এখনো আমার চোখে ভাসে | ছবিতে ছিলেন সালাউদ্দিন, অমলেশ, এনায়েত ও গোলকিপার সান্টু |
মন্তব্য করুন