অন্য প্রাণীরা
ফ্রাঙ্কফুর্টের দূরপাল্লার ট্রেনস্টেশনে নামার সময় কেন যেন বিরক্তি ভন ভন করছিল মাথার মাঝে মাছির মতো। কিসের ওপর যে বিরক্তি তা বুঝতে পারছিলাম না। দুই দিনের জন্য বান্ধবীর সাথে দেখা করতে তার শহরে যাচ্ছি। সাড়ে তিন ঘন্টার মাত্র জার্নি। টিকেটও পেয়েছি দারুণ সাশ্রয়ী মূল্যে। সারাদিনে যা কিছু ঘটেছে আমার সাথে তাতেও খুব একটা খারাপ কিছু ছিল না। তারপরও আজাইরা বিরক্তি মাথাটাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল।
ফ্রাঙ্কফুর্টের ছিল ট্রেন বদলের পালা। তার আগে দেড় ঘন্টার মতো জার্নি করেছি। এখন মিনিট বিশেকে বিরতি এবং তারপর আরও দেড় ঘন্টা কি তার একটু বেশি। স্টেশনে দাঁড়িয়ে ধূমপানের কোনো উপায় নেই। স্টেশন থেকে বের হয়ে ধূমপান করতে হয়। ভাবলাম হাতে সময় আছে যেহেতু কাজটা করেই ফেলি।
সারাদিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে চিন্তা করছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মেজাজ খারাপ ছিল আগের দিনের একটা ঘটনা নিয়ে। গত সালের অক্টোবরে জিমের সদস্যপদ থেকে বহু চেষ্টা-চরিত্র করে মুক্তি পেয়েছি। সাধারণ জিমের চুক্তিগুলোতে এত লুকানো কাহিনী থাকে যে একবার কোনো চুক্তিতে ঢুকলে তা থেকে বের হওয়া যেন পাহাড় ঠেলা সত্যি সত্যি তার জায়গা থেকে সরানোর মতো কঠিন। তাও করেছিলাম। যথাযথভাবে চুক্তি শেষ হয়ে গিয়েছিল। নভেম্বরে আর ডিসেম্বরে সদস্য ফি-ও দিতে হয় নি। এই জানুয়ারিতে এসে জিম থেকে আবার ই-মেইল পাঠানো হয়েছে টাকা চেয়ে। কি যে হয়েছে কে জানে। কিন্তু ই-মেইলটা দেখেই মেজাজ গেল খারাপ হয়ে।
অফিসে গিয়ে জিমে ফোন করে জানতে পারলাম করোনাকালে জিম বন্ধ ছিল বিধায় সকল সদস্যকে কয়েক মাস মুফতে ডন-বৈঠকের সুযোগ দেয়া হয়েছে। নতুন ফি-টা তারই জন্য। অথচ করোনাকালে বন্ধ থাকার পরও প্রতি জিম আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত টাকা কেটেছে। এখন ফাও কয়েক মাস আগে গছিয়ে দিয়ে পরে তার জন্যও টাকা চাওয়া হচ্ছে! মগের রাজ্যেও এমন অমূলক কর্মকাণ্ড চলে কিনা জানি না। জিমের মেয়েটা বললো মঙ্গলবার বিকালে তার ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাকে পাওয়া যাবে। সে সময় আবার ফোন করতে। সমস্যাটা সমাধান না হলেও কোনো রকম চাপা দিলাম। কাজে মনোযোগ দিলাম।
সামনে বহুরকম পরিকল্পনা আছে তাই কোনকিছু নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করে নষ্ট করার মতো সময় নেই। দিনের কাজকর্ম ভালভাবেই হলো। তবে সব যেভাবে ভেবেছিলাম সেভাবে হলো না। এই যেমন আমার অফিসের বাইরে একটা কাজ ছিল যেটা মনে মনে আশা করেছিলাম হয়তো কোনভাবে কাটানো যাবে। কিন্তু গেল না। উল্টো কাটানোর আশায় ঘন্টাখানেক সময় শুধু শুধু বসে কাটিয়ে দেয়ার ফলে এক ঘন্টা সময় হাত থেকে কমে গেল। এখন এর ভেতরে সবকিছু সেরে যথাসময়ে আমায় ট্রেন ধরতে হবে।
অফিস থেকে বাসায় ফিরলাম পূর্ব পরিকল্পিত সময়ের একঘন্টা পর। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গুছিয়ে দৌড়ালাম কাছের বাসস্ট্যান্ডের দিকে। ওখান থেকে বাস নিয়ে আমার যে কাজটা রয়েছে, সেটা যেখানে- সেখানে যেতে হবে আগে। তারপর সেখান থেকে কাজ সেরে ভেবেছিলাম ট্রেনে ওঠার আগে স্টেশনের কুর্দিশ ডোনারশপ থেকে একটা গরুর মাংসের সালামি-পিজ্জা খেয়ে উঠবো। এক ঘন্টা দেরি হওয়ায় সে পিজ্জার আশা আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। জোর পা চালিয়ে হাঁটছিলাম বাসটা ধরার উদ্দেশ্যে।
তাও হলো না। চোখের সামনে দিয়ে বাসটাও বেরিয়ে গেল। এই ঠান্ডায় শুকিয়ে আমসত্ত্ব হয়ে যাওয়া দেশে মাঝে মাঝে সবকিছু শুধু সময়মতো না, বরং সময়েরও এক/দুই মিনিট আগে ঘটে যায় কি না! আজও যেমন বাসটা মিনিটখানেক আগেই চলে গেল। আমি কয়েক মিটার পেছন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলাম বাসের। তার বেশি পারলাম না। উসাইন বোল্টের মতো একটা দৌঁড় দিয়েও হলো না।
বাসটা চলে যাওয়ায় কি করা, জোর গতিতে পা চালিয়ে কোনমতে কাজ সেরে ট্রেনটা ধরবো কিছুদূর হেঁটেও ফেললাম। তারপর আস্তে আস্তে মনে পড়া শুরু হলো তাড়াহুড়ায় কি কি নিত্যদিনের জরুরি জিনিস সঙ্গে আনতে ভুলে গিয়েছি তার ফিরস্তি। প্রথমে মনে পড়লো হেডফোনের কথা। ভাবলাম লাগবে না। বান্ধবীরটা দিয়ে চালিয়ে দেবো দুটো দিন। কি আর হবে। তারপর মনে পড়লো ইউএসবি টু এইচডিএমআই অ্যাডাপ্টারের কথা। যারা জিনিসটা চেনেন তারা জানেন এটা কতো উপকারী। বিশেষ করে ল্যাপটপ থেকে টিভিতে সিনেমা দেখার জন্য। ভাবলাম, আচ্ছা দুটো দিন নাহয় সিনেমা ছাড়াই চলুক। কি আছে জীবনে?
ভাবছি আর হাঁটছি, মনে পড়ে গেল ল্যাপটপের মাউসও আনা হয় নি। যাক্ বিল্ট-ইন মাউসপ্যাডটায় আঙ্গুল ঘষে ঘষে নাহয় কাজ চালাই। কিন্তু তারপর যখন মনে পড়লো প্রতিদিনের ওষুধও নেই সাথে, তখন আর সামনে আগানো গেল না।
হাতে সময় কম। তারমধ্যেই উল্টা ঘুরে দৌড় দিলাম। পিঠের ব্যাগ ঝক্কর ঝক্কর করে একবার মাথায় বাড়ি খাচ্ছে, আরেকবার লাম্বারস্পাইন ৪ ও ৫-এর মাঝখানের নরম জায়গাটায় খোঁচা দিচ্ছে। কোনকিছু পাত্তা না দিয়ে দৌঁড়ে বাসায় গেলাম। যা যা ভুলেছিলাম নিলাম। তারপর আবার বের হয়ে পড়লাম।
এবার বের হয়ে দেখি হাতে কাঁটায় কাঁটায় সময় রয়েছে। এক মিনিট এদিক-ওদিক হওয়ার উপায় নেই। সব কাজই সম্ভব। কিন্তু সবকিছু করতে হবে বাতাসের আগে। নাহলে ট্রেন ধরতে ব্যর্থ হবো নির্ঘাত।
এবার পথে নেমে মনে হলো, আগেরবার যদি মুহূর্তের ব্যাবধানে বাসটি না মিস্ হতো, তাহলে আবার বাসায় ফিরে আসার মতো সময় হাতে থাকতো না কোনভাবেই। শাপে বর দেখা দিলো নাকি ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতে যে কাজটি ছিল সেখানে পৌঁছে গেলাম। কাজ যথাসময় হয়েও গেল। এরপর ট্রেন স্টেশনের উদ্দেশ্যে জোর কদমে হাঁটার সময় একবার ফোন বের করে ট্রেনের সময়সূচির অ্যাপটা খুললাম। দেখি ট্রেন প্রায় দশ মিনিট বিলম্বে আসবে বলে নোটিশ জারি করেছে। মনটা খানিক খুশি হলো। কুর্দিশ দোকানে গিয়ে বসে পিজ্জা খাওয়ার সময় না থাকলেও, ডোনার নিয়ে হাঁটা দেয়ার সময় আছে এখন। তাই বা কম কিসে!
ডোনার নিয়ে শুধু হাঁটা না, তারপর ট্রেন আসার পূর্বে স্টেশনে বসে সেটির নব্বুই ভাগ শেষও করে দিয়েছিলাম। তারমধ্যেই ট্রেন চলে আসায় বাকিটা পলিথিনে মুড়ে ট্রেনে উঠে বসলাম। উঠে আয়েশ করে বাকিটা শেষ করলাম। এর ভেতর চেকার একবার টিকেট দেখে গেল। খাওয়া শেষ করে যেন মুখের মেডিক্যাল-মুখোশটি যথাযথভাবে পড়ে চুপটি করে লক্ষী ছেলেটির মতো বসে থাকি সে কথাও পই পই করে বলে গেল। আমি ভালমানুষের মতো তার কথায় সায় দিলাম এবং পরে পালনও করলাম। দেড় ঘন্টার মধ্যে ট্রেনটা ফ্রাঙ্কফুর্টেও পৌছে গেল। তারপর তো সিগারেট খেতে বাইরে এসে- সারাদিন কি কি ঘটলো তাই ভাবলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
হাঁড়কাপুনি শীত চলছে। মাইনাস দুই ডিগ্রী তাপমাত্রা। কিন্তু অনুভূতি হয় মাইনাস পাঁচের। তার মধ্যে বেশিক্ষণ বাইরে থাকা গেল না। আধখাওয়া সিগারেট নিভিয়ে স্টেশনের ভেতর ঢুকে পড়লাম। পরের ট্রেনটা যথাসময়ে পৌঁছালো। লম্বা একটা ট্রেন। মাঝখানে আবার চুম্বক দিয়ে জোড়া দেয়া।
আমি চুম্বকের জোড়ার পরের বগিটাতে উঠে বসেছি তখন মাত্র। হঠাত বগির ভেতরকার তথ্য-মনিটরে ভেসে উঠলো অমুক শহরের উদ্দেশ্যে শুরু হওয়া এ যাত্রায় আপনাকে স্বাগতম। কিন্তু আমার বান্ধবী তো সেই শহরে থাকে না। তাহলে কি ভুল ট্রেনে উঠলাম? তা তো হওয়ার কথা না। টিকেটে এই ট্রেনের কথাই লেখা আছে। প্ল্যাটফর্ম নাম্বার ঠিক আছে। ট্রেন ছাড়ার সময় ঠিক আছে। তাহলে? গন্তব্যস্থল অন্যকিছু দেখায় কেন?
বেশ খানিকটা সময় বগিটায় ঘোরাঘুরি করলাম। এক বুড়ি দেখলাম মনিটরটার সামনে খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছে। তার সাথে কথা বলে কোনো তথ্য পেলাম না। বুড়ির গন্তব্যেই ট্রেনটা যাচ্ছে। কিন্তু বুড়ি কেন তারপরও চিন্তা করছে বা কি চিন্তা করছে, বুঝতে পারলাম না। আমি আরও খানিক খুঁজে একজন রেলের লোক পেলাম। টিকেট চেকার হবে হয়তো। কিংবা ট্রেনের ভেতর যে রেস্টুরেন্ট থাকে তার কর্মী। তাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো, না এই ট্রেনতো তোমার গন্তব্যে যাবে না। এটা ছিল দুইটা ট্রেন, চুম্বক দিয়ে লাগানো। চুম্বকের সামনের ট্রেনটা যাচ্ছিল তোমার গন্তব্যে। তখন আমার মনে পড়ে গেল আমি ঠান্ডার অজুহাতে ট্রেনটা যখন স্টেশনে ঢুকছিল তখন ইচ্ছে করেই নড়ছিলাম না। তারপর চোখের সামনে যে দরজাটা এসে থেমেছে সেটাতেই উঠে পড়েছি। চুম্বকের সামনের অংশের ট্রেনে উঠি নি। পেছনের অংশের ট্রেনে উঠেছি। শুনে মনে হলো, আমার নিজেকেই এখন অন্য একজন মানুষের রুপ দিয়ে- তার সঙ্গে জোরপূর্বক সহবাস করি, উপর্যুপরি।
সেই ভুল ট্রেনে করে গিয়ে পরের স্টেশনে নামলাম। খানিক পূর্বে মনে মনে যে ঠান্ডার মা-বাপ তুলছিলাম, এবার সেই ঠান্ডাতেই কুই কুই করতে করতে উল্টো পথের ট্রেনে গিয়ে উঠলাম। আমাকে আবার ফ্রাঙ্কফুর্টে ফিরতে হবে। তারপর আবার সঠিক গন্তব্যের ট্রেনের টিকেট কেটে তাতে উঠতে হবে। নিজের মেজাজটাকে দেখে মনে হচ্ছিলো, তখন ওটাতে চাকা চাকা বেগুন হলুদ, মরিচ আর লবণ মিশিয়ে ছেড়ে দিলে সেটা চিড়বিড় করে ভেজে উঠবে।
সমস্যা তো শুধু একমুখী ছিল না। নতুন করে টিকেট কাটতে হাজার পাঁচেক টাকা বেরিয়ে যাবে কম করে হলেও, তা একটা বিষয়। কিন্তু তারচেয়েও বড় বিষয় পরের ট্রেনটা আরও প্রায় ঘন্টাখানেক পরে। তারমানে ঠান্ডায় আমাকে আরও এক ঘন্টা বাড়তি জমতে হবে। কোনো বিকল্প নেই। কপালের নাম গোপাল।
ফ্রাঙ্কফুর্টে পৌঁছে দেখলাম আগের একটা একই লাইনের ট্রেন দেরি হয়ে যাওয়ার দরুণ এখনও এসে পৌঁছায় নি। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে। আমি ভাবলাম সেটার টিকেট চেকারকে গিয়ে বলবো, যদি আমায় সাথে নেয়। নাহলে তারপর পরের ট্রেনের টিকেট কাটবো। যাবে কিছু টাকা গচ্চা। কি আর করা।
দেরি হয়ে যাওয়া ট্রেনটা কিছুক্ষণের ভেতরেই চলে আসলো। টিকেট চেকারকে বুঝিয়ে বলতেই তিনিও আমায় নিতে রাজি হয়ে গেলেন। আমি তাকে শতমুখে প্রণাম করে ট্রেনে উঠে পড়লাম। উঠে ভাবছিলাম, এই ট্রেনটা দেরি করেছে বলেই আমি প্রায় ঘন্টাখানেক ঠান্ডায় জমার হাত থেকে রেহাই পেয়েছি। এর টিকেট চেকারটা ভাল বলে কোনো বাড়তি টিকেটও কাটতে হয় নি। পরেরটার চেকার এমন না-ও হতে পারতো। কখনও কখনও কারো পৌষ মাস যে কারো সর্বনাশের উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ায় সেটাও একই দিনে দেখা হয়ে গেল।
মাছির মতো সেই ভন ভন করা বিরক্তিটা এখন আর নেই। হঠাত মনে হচ্ছে আমাদের জীবনটাও তো আসলে এমনই। আমরা যা ভাবি, তার বেশিরভাগই হয় না। যা হয়, তা মেনে নেয়ার প্রস্তুতি আমাদের থাকে না। একটা ছোট জীবন, যা একবারের জন্যই কেবল পাওয়া হয়, সেটা হারিয়ে যায় এই চাওয়া আর পাওয়ার হিসেব মেলাতে মেলাতে। এই সবকিছু পাশে সরিয়ে রেখে কখনো জীবনের সৌন্দর্যটা এক মুহূর্তের জন্য চোখ মেলে দেখা হয় না। কৃতজ্ঞতা জানানো হয় না কাউকে এ জীবনটার জন্য। এটাও আরেক অবিশ্বাস্য ঘটনা! হয়তো আমরা মানুষ বলেই হয়তো এমন ঘটনা ঘটাতে পারি। অন্য প্রাণীরা পারে কিনা জানি না।
---
মন্তব্য করুন