গল্প: হয়তো ক্যারিবিয়ান অঞ্চলেই আমাদের দুজনের কোন একদিন দেখা হবে
১.
ঝরা পাতা নাম ছিল মেয়েটির- খুব প্রচলিত একটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ছবি, নিজস্ব এক্সপ্রেশনের ভিডিও, মাঝে মাঝে মনের খেয়ালে গেয়ে ফেলা কোন রবীন্দ্র সঙ্গীত এসবই বেশি ভাগাভাগি করে নিতো সে নিজের অনুসারীদের সাথে। আবার কখনো-সখনো সমাজ, প্রচলিত কুসংস্কার, ব্যবস্থাপনা, পুরোনো নিয়ম-নীতির যেসব অগ্রযাত্রার চেয়ে পশ্চাদপদতায় বেশি করে জ্বালানি যোগায়- তার বিরুদ্ধে লিখতো। মেয়েটিকে আমি মাঝে মাঝে ওই সামাজিক মাধ্যমেই দেখতাম।
ওর পোস্ট দেখলে সবসময়ই আমার ভেতর কেমন যেন একটা আগ্রহ তৈরি হতো। কোনো কারণ কিন্তু দৃশ্যত থাকার কথা নেই। তাও হতো। দুজনের কোন পূর্বপরিচয় নেই আমাদের। নেই ভবিষ্যতে পরিচিত হবারও সহজ কোনো সম্ভাবন। তারপরও ভালই লাগতো মেয়েটির কার্যকলাপ অনুসরণ করতে।
ব্যক্তি আমার যেটা আজীবনের সমালোচনা সেটা হলো, আমি খুব একটা সামাজিক না। ছেলেবেলা থেকেই তাই আমার বড় কোন বন্ধুদল নেই। রয়েছে একক বন্ধুদের সাথে এক, দুই কিংবা তিন বছরের ফ্রেন্ডশিপ-ব্লক। স্কুলজীবনে একাধিকবার শহর বদল, বন্ধুবান্ধবের টেস্ট বদল ইত্যাদি নানান কারণে ওই সময়-ব্লকগুলোর দৈর্ঘ্য তিনের চেয়ে বেশি বড়ও হয় নি সেভাবে কখনোই। যার আরেকটি অর্থ হচ্ছে আমার তেমন গভীর কোন বন্ধুত্বও কখনও কারও সাথে হয় নি, যা স্কুল বা রুচিবোধ পরিবর্তনের সাথেও খাপ খাইয়ে টিকে যেতে পেরেছে। যেসব বন্ধুত্ব এসব মাত্রার বাইরে ছিল তারা টিকে গেছে। নানাবাড়িতে কিংবা দাদাবাড়িতে সে বন্ধুরা আজও বন্ধুর মতোই রয়ে গেছে। কিন্তু স্কুল, কলেজ, কালচার কিংবা পলিটিক্সের কেন্দ্র কিংবা আড্ডাস্থল থেকে বের হওয়া বন্ধুগুলো সময়ের সাথে এসেছে ও গিয়েছে জীবনে।
সেবার কি করে যেন ভুল করে একটা মেসেজ চলে গিয়েছিল ঝরা পাতার কাছে। পাঠাতে চেয়েছিলাম অন্য আরেকজনকে। কিন্তু তাড়াহুড়ায় চলে যায় অন্যত্র। যাহোক মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়েই বুঝতে পারি ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু ততক্ষণে করার বলতে বাকি রয়েছে শুধু বার্তাটি ডিলিট করে দেয়া। তারপরও আসলে দেখা যায় যে, একজন অপরিচিত একটি বার্তা পাঠিয়েছিল এবং তারপর মুছে দিয়েছে। কাজটা করা আর না করা অনেকাংশেই সমার্থক যখন বার্তাটি নির্দোষ হয়। আমার বার্তাটিও নির্দোষই ছিল। তাই বুঝতে পারছিলাম না বার্তা মুছবো নাকি দুঃখ প্রকাশ করবো। ইতোমধ্যেই মেয়েটি বার্তাটি দেখে ফেললো এবং লিখলো,
"জ্বি?"
আমি সরাসরিই স্বীকার করে নিলাম ভুল করে বার্তাটি চলে গিয়েছে। মেয়েটিও খুব বেশি কিছু না বলে সেদিনের মতো অফলাইনে চলে গেল। ব্যাপারটি সেখানেই শেষ হয়ে গেলে খারাপ কিছু হতো না। কিন্তু মানুষ সবসময় ভাবে একরকম, কিন্তু তারপর মানুষের মনের ভেতর বেশিরভাগ সময় সেই ভাবনা নিয়ে থাকে শংকা ও সংশয়, তারপর মানুষের সাথে ঘটে অন্যরকম, এবং সবশেষে মানুষ তার প্রথম ভাবনাটাকেই সবকিছুর জন্য দায়ী করে ভবিষ্যতের জন্য একটি ভুল শিক্ষা গ্রহণ করে বসে থাকে।
সেসব কিছু যেন না হয়, সেজন্য আমি মেয়েটিকে কয়েক সপ্তাহ পর, তারই এক পোস্টে 'কমপ্লিমেন্ট' দেয়ার জন্য হালকা চালে নক করলাম। দু'চার কথায় আমার সে উদ্যোগও ভেসে গেল। আজীবনের অসামাজিক আমি। সেই আমাকে দিয়ে হবে ইন্টারনেটে মানুষকে পটিয়ে ফেলা! তাহলে তো হতোই।
এরপর দীর্ঘ অনেকটা সময় মেয়েটির নানান পোস্ট আমার চোখের সামনে আসতো আর আমি সেসব না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে যেতাম। এমন করতে করতে একসময় সেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটিও আমায় ওর পোস্ট দেখানো প্রথমে কমিয়ে দিল এবং পরে একসময় বন্ধই করে দিলো। মনোজগত থেকে এভাবেই মুছে গিয়েছিল মুখটি, যেটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে একসময় আমার অজান্তেই হৃৎপিন্ড খানিকটা বেশি রক্ত পাম্প করে ফেলতো। বাড়তি রক্তের প্রবাহটা অনেকটা ক্যাফেইনের মতো কাজ করতো শরীরে। দ্রুতই খানিকটা নিকোটিনের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হতো দেহ-মনে।
সামান্যই ছিল ব্যাপারটা। জীবনে এমন কত ছোট ছোট ঘটনা ঘটে রয়েছে। তাই সেটা যে একসময় পুরোপুরি ভুলে গিয়েছি, তা টেরও পাই নি সেভাবে।
২.
আমার ছেলেবেলার ১৩ টি বছর কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে। আমার প্রথম ভাললাগার শহর। নব্বুইয়ের দশকের চট্টগ্রাম। সে সময় শহরে এত যানজট ছিল না কিংবা ছিল না উন্নয়নের নামে এত বিশাল বিশাল নির্মাণযজ্ঞ। শহরটা অনেক ছিমছাম, কোলাহলমুক্ত আর স্বাভাবিক ছিল। রাস্তাঘাট তখনও ভাঙাচোরা ছিল ঠিকই, কিন্তু শিশুকালে আমি বড় রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করতাম কমই। যত গলি, মহল্লার শর্টকাট রয়েছে- সেসব ছিল আমার আপন পথ।
শৈশবে খুব বেশি না বুঝলেও, শহরটাকে কিভাবে যেন মন দিয়ে ফেলেছিলাম। আমার চলাফেরার পরিধি যে খুব বেশি ছিল, তা না। অনেকদিন সিডিএ আবাসিক এলাকার ১২ নং রোডে থাকার কারণে ওই দিকের সব রাস্তাগুলো চিনতাম। খাল-বিল চিনতাম। মাঠ-ঘাট বলতে যা কিছু ছিল চিনতাম। তারপর সেখান থেকে আমরা চলে আসি সিএন্ডবি কলোনীতে। সেখানে আসার পর পুরোনো জাম্বুরি ফিল্ড, আগ্রাবাদ এলাকা ইত্যাদি ভালভাবে চেনা হয়। আর একদম কেজি ক্লাস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনী হাই স্কুলে পড়াশোনার সুবাদে সেই দিকটা খুব ভালভাবে চেনা আমার শিশুকাল থেকেই। এছাড়া আর বেশি কিছু চিনতাম-টিনতাম না।
সেবার মধ্যত্রিশে পাওয়া এক চিলতে ছুটির অবকাশে কক্সবাজার-বান্দরবান যাওয়ার পথে একদিনের জন্য থাকা হয়েছিল চট্টগ্রামে। ঢাকা থেকেই আমরা একদল বন্ধু যাচ্ছিলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। সেখানে ক'টা দিন কাটিয়ে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা বান্দরবানে। মাঝে চট্টগ্রামে একদিনের বিরতি। সেখান থেকে একজন বন্ধু যোগ দেবে দলে।
আমি ভাবলাম এই সুযোগে ছেলেবেলায় যে শহরের প্রেমে পড়েছিলাম সেটিকে খানিক ঘুরে-ফিরে দেখার সুযোগ মিলবে। এ কারণে আমি অন্যদের বলে সেদিন একাই বের হয়ে পড়ি খানিকটা নিজে নিজে ঘুরেফিরে দেখবো বলে।
নির্মম ট্রাফিক জ্যামের বদৌলতে আমার পুরোনো প্রেম অচিরেই আংশকাজনক হারে কমতে শুরু করলো। তার ওপর ছিল শব্দদূষণ! আমি আগ্রাবাদের লাকি প্লাজার দিকে যাবো বলে রিকশায় উঠেছিলাম। রাস্তায় বাস, ট্রাক, টেম্পু, বেবী, সিএনজি, রিকশা, সাইকেল, মটরসাইকেল, ই-বাইক, ই-স্কুটার কি নেই! আর সবগুলো বাহন থেকেই ভেসে আসছে কোন না কোন মাত্রার ভেপুঁ। বাস আর ট্রাকগুলো বাজাচ্ছে হাইড্রোলিক হর্ন।
আমার ছেলেবেলায় এত যানবাহন যে চট্টগ্রামে ছিল না তা আমি নিশ্চিত। না হলে কোনমতেই এ শহরের প্রেমে আমি পড়তাম না। যাহোক এখন যা হয়ে গেছে তা নিয়ে তো আর ভাবলে চলবে না। আমি একসময় রিকশা মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে নেমে পড়লাম।
কিছুদুর হাঁটতেই পাশের একটি চলমান বাস থেকে একজন এক দলা থুথু রাস্তায় নিক্ষেপ করলো। আমার পায়ের বুড়ো আঙুলের ঠিক এক ইঞ্চি দুরেই পড়লো থুথুটি। মাথা উঠিয়ে দেখি বাস ততক্ষণে বহুদূর চলে গেছে। যে থুথুটি ফেলেছে, সে খুব নিখুঁত নিশানাবাজ আর নয়তো জলজ্যন্ত একটি মানুষকেই খেয়াল করতে ভুলে গেছে।
এরপর থেকে খুব দেখেশুনে হাঁটছিলাম। হঠাৎ কয়েক মিটার দূরেই ঝরা পাতা নামের সেই মেয়েটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। শেয়ারে উবার ঠিক করার চেষ্টা করছে সে।
আমি ভাবলাম, আমার তো যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। আমিই তার সহযাত্রী হয়ে যাই না কেন? দেখলাম মেয়েটি তখন একটি গাড়ি ঠিক করে ফেলেছে প্রায়। একই দিকে যাওয়ার মতো আরেকজন যাত্রী পেলেই রওনা হবে। আমি গিয়ে গাড়ির চালককে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবেন?
তিনি যে এলাকার কথা বললেন, তা আমি চিনতাম না স্বাভাবিকভাবেই। তারপরও উঠে পড়লাম। উঠে বসার সময় চালক বলছিলেন ভাড়ার কথা। শুনে বুঝলাম অনেকটা লম্বা পথ।
৩.
আমরা দুজন বসেছি গাড়ির পেছনের সীটে। প্রথমে বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর আমিই প্রথম কথা শুরু করি মেয়েটির সাথে। তিন বছর আগে তার জীবনের অনেক খবরই আমি জানতাম। এখন মেয়েটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আর আছে কিনা, তাই জানি না। কি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে ভাবতে ভাবতে আনমনেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেমন জ্যাম পড়েছে দেখেছেন?
তিনি সাথে সাথেই বললেন, এ আর নতুন কি! এই রাস্তায় মানুষকে কখনো কখনো ছয় ঘন্টাও বসে থাকতে হয়। আজকে মনে হচ্ছে এক-দেড় ঘন্টা, কিংবা হা-ই-য়ে-স্ট দুই ঘন্টায় চলে যেতে পারবো।
বললাম, তাই? অনেকদিন চিটাগাং আসা হয় নি কিন্তু আমি আগে এখানেই থাকতাম। এখন এত জ্যাম পড়ে?
মেয়েটি যে মিশুক প্রকৃতির সে সম্পর্কে বোধহয় আমার আগে থেকেই ধারণা ছিল। কিংবা সেদিনের সেই গাড়ির ভেতরের ঠান্ডা পরিবেশের ছিল কোন একটা ভূমিকা। কিংবা মহাকাল দুটি মানুষকে তিন বছর পর ঘন্টাখানেকেরও বেশি সময়ের জন্য একটা জায়গায় পাশাপাশি বসিয়ে দিয়ে মজা দেখছিল। আর নাহয়, হয়তো আমাদের দুজনেরই দুজনের সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছিল। জানি না কেন, কিন্তু আমি কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম আমরা দুজন তন্ময় হয়ে একে অপরের সাথে গল্প করছি।
শহরের জ্যাম থেকে উন্নয়ন, সেখান থেকে রাজনীতিবিদদের লোভ, সেখান থেকে দেশের নিয়মনীতির বিরুদ্ধে আমাদের যেসব ক্ষোভ- সব উগরে আমরা খেয়াল করলাম, উল্লিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে আমার দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি হুবহু এক।
এরপর সেখান থেকে হলো চাকুরি, ক্যারিয়ার, স্বপ্ন ইত্যাদির কথা। মেয়েটি জানালো, সে বছর তিনেক হলো একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকের বাংলাদেশি শাখায় যোগদান করেছে। তার ক্যারিয়ার সম্পর্কে আরও অনেক কথা বললো। বুঝলাম ক্যারিয়ার নিয়ে খুব উচ্চাশা পোষণ করে মনে। সে যে একদিন বড় ব্যাংকার হতে চায় তা জানলাম ওর কথা থেকে। আমিও বড় ভবঘুরে হতে চাই সেটা জানালাম কথায় কথায়।
মেয়েটি যে একসময় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতো, তা জানতাম। মাঝে মাঝে গান গাওয়ার সময় ভিডিও-ও করতো সে। ওর গানের পরিবেশনটা ছিল খুব সুন্দর। সেজেগুজে বসে ক্যামেরার সামনে গভীর আবেগ দিয়ে গান গাইতো সে। কিছুক্ষণ মন দিয়ে শুনলে সে আবেগ মনে মনে ছোঁয়া যেতো। জানতে চাইলাম, আপনি গান করেন?
শুনে বললো, একসময় খুব ইচ্ছা ছিল, জানেন? আজকাল কতদিন রেওয়াজ করা হয় না। উম...কত দিন না, কত বছর যে রেওয়াজ করা হয় না!
আমি বললাম, তিন বছর?
মেয়েটি খানিক অবাক হয়ে বললো, সেরকমই হবে। আপনি কি করে অনুমান করলেন?
বললাম, ওই যে বললেন না, তিন বছর হলো ব্যাংকে জয়েন করেছেন। ওখান থেকেই অনুমান করে নিলাম আরকি!
মেয়েটি একটি পূর্ণদৃষ্টি দিয়ে বললো, ঠিকই অনুমান করেছেন আপনি। ব্যাংকে জয়েন করার পর আস্তে আস্তে তানপুরাটার তারগুলায় ধুলার আস্তর জমতে শুরু করেছে। আবার শুরু করতে হবে কোন একদিন।
কথা-বার্তার সুবাদে মেয়েটির জীবনের ব্যক্তিগত কিছু কথাও জানা হয়ে গেল। তিন বছর আগের সদ্য গ্রাজুয়েট, যাকে দেখলে মনের ভেতর এক ধরনের তোলপাড় সৃষ্টি হতো, তিনি ততদিনে ব্যাংকে 'সিনিয়র' হচ্ছি-হবো অবস্থায় পৌঁছেছেন। বাসায় বিয়ের জন্য তোড়জোড় প্রতিনিয়ত পূর্বের রেকর্ড ভাঙছে। তবে কোনমতেই ব্যাটে-বলে হয়ে মালাবদল ঘটে যাচ্ছে না। এসবও জানলাম।
আমি নিজেও মালা বদলের সঙ্গী পাই নি বলে কাণ্ডটি ঘটাতে পারি নি আজও। সেজন্য আক্ষেপ নেই কোন। তবে মাঝে মাঝে আমিও, মধ্য আমেরিকার ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে, কলাপাতার রঙয়ের শিফনের শাড়ি পরা কোন একটি মেয়েকে মালাবদলের মাধ্যমে নিজের করে নিয়ে গিয়ে; দুজনে একসঙ্গে পরিবাজ্রক, কাম জেলে, কাম বার-টেন্ডার, কাম ক্লাব-সিঙ্গার, কাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঞ্চালক, কাম স্থানীয় পাচক ইত্যাদি অনেককিছু হয়ে গিয়েছি- এমন একটা ধূসর, অস্পষ্ট স্বপ্ন দেখি।
আমার কথাগুলো যখন বলছিলাম, তখন মেয়েটি অনেক মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। সবশেষে বললো, অল্প খানিকটা সময় দেখেছি যদিও আপনাকে, তারপরও মনে হচ্ছে আপনি একদিন ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলতেও পারেন।
তার কথা শুনে আমি বললাম, আমারও কেন যেন মনে হচ্ছে আপনিও খুব দ্রুত খুঁজে পাবেন, যেটা খুঁজছেন।
আমার কথা শুনে মেয়েটি শুধু হেসেছিল একগাল প্রাণখুলে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা আউড়ে উত্তর দিয়েছিল, "যে জীবন দোয়েলের ফড়িঙয়ের, মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।"
রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত মেয়ের মুখে জীবনানন্দের লাইন শুনতে পাবো- তাতে আর অবাক হবার কি আছে? কিন্তু তার উত্তরটা কেন যেন অন্যরকম লাগলো খানিকটা। কিছু আগে নিজের কাজ, স্বপ্ন সব নিয়ে তো বেশ উচ্ছ্বসিতই ছিল মেয়েটি। হঠাৎ কাজের উন্নতির আশাবাদ অমন নির্মোহভাবে উড়িয়ে দেয়া কেন তাহলে? জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে কিনা ভাবছিলাম, তখনই মেয়েটি বললো,
মানুষ সবসময় ভাবে একরকম, কিন্তু তার মনের ভেতর বেশিরভাগ সময় সেই ভাবনা নিয়ে শঙ্কা ও সংশয় চলতে থাকে। আমার ভেতরেও একসময় গান গাওয়ার স্বপ্ন ছিল। গান নিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে ছিল। শঙ্কা ও সংশয় সেসব স্বপ্নের পালে হাওয়া লাগতে দেয় নি। আজ যখন দেখি জীবনে সবকিছু অন্যরকমভাবে হচ্ছে, তখন মাঝে মাঝে আমার সেই তিন বছর আগের স্বপ্নগুলোকে ভুলই মনে হয়, জানেন? কিন্তু স্বপ্নগুলো যে আমার কতোটা প্রিয় ছিল তা কাকে বুঝাই! সবাই আমার এগিয়ে যাওয়ায় খুশি আজ, কেউ জানে না আমি মনে মনে একদম অন্যরকম একটা মানুষ ছিলাম। সেভাবেই বড় হতে চেয়েছিলাম।
একটানা অনেকগুলো কথা বলে ঝরা পাতা একটু থামলো নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য। তারপর বললো, উল্টাপাল্টা কথা বলে ফেলেছি। আপনার সাথে গল্প করতে করতে কি যে হলো! যাক আপনি আবার এসবে কিছু মনে করবেন না কিন্তু।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না না কি যে বলেন! আমি মনে করার কে! আপনার মনের কথা আপনি বলেছেন। কথাগুলো কাউকে না কাউকে তো বলতে হতো, তাই না? মনের কথা জমিয়ে রাখা ভাল না।
শুনে মেয়েটি বললো, ঠিকই।
আমি বললাম, তারপরও শুভকামনা আপনার জন্য। হয়তো কোন একদিন গান নিয়ে দেশ-বিদেশ ঘোরার স্বপ্নটাই সত্যি হয়ে যাবে আপনার, কে জানে!
ততক্ষণে আমাদের উবার চলে এসেছে গন্তব্যের পানে। মেয়েটি নামার সময় আমি ইচ্ছে করেই সঙ্গে নামি নি। তবে কথায় কথায় জানিয়ে রেখেছিলাম যে, আরও একশ মিটার সামনে আমার গন্তব্য, তাই একসাথে নামি নি আমি।
এরপর মেয়েটির সাথে আমার আর কখনো দেখা কিংবা কথা হয় নি কোথাও। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমিই ছিলাম না তখন আর। মেয়েটি ছিল কিনা জানা হয় নি।
আমার অবশ্য মনে মনে ভাবতে ভাল লাগে যে, আমাদের সেদিনের দেখা হওয়ার পর হয়তো গান নিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্নটাকেই কোন না কোনভাবে বাস্তবে রূপ দিয়ে ফেলেছে সে। আর আমি কোথায় গিয়ে ঠাঁই নিতে চাই সেটাও তো তার জানা!
মহাকালের পরিকল্পনা খুব বিচিত্র, মানুষ তার কতটুকুই বা আর বুঝতে পারে? পারলে কি আর নিজের ভাবনা নিয়ে শংকা ও সংশয় থাকতো কখনো মানুষের মনে? তাই স্বপ্ন তো দেখাই যায়, তাই না?
হয়তো ক্যারিবিয়ান অঞ্চলেই আমাদের দুজনের কোন একদিন দেখা হবে।
---
মন্তব্য করুন