গল্প: রাজকুমারীর যে কথাটা আসলেই হৃদয় অচল করে দিয়েছিলো
সেদিন বাসে করে ফিরছিলাম এয়ারপোর্ট থেকে। গন্তব্য শাহবাগ। ভায়া কাকলী-বনানী-ফার্মগেট। মাঝে হঠাৎ করে খুব অদ্ভুত একটা মেসেজ এলো মোবাইল ফোনে।
এয়ারপোর্টের ওদিকের রাস্তাঘাটগুলো ইদানীং বেশ সুন্দর এবং সাজানো-গোছানো হয়ে উঠেছে। গোটা দুয়েক জরুরি ফ্লাইওভার রাস্তাটাকে আগের চেয়ে অনেক সহজও করে দিয়েছে। কয়েক বছর আগে বনানী থেকে এয়ারপোর্ট যাওয়ার বিভীষিকাময় স্মৃতি মনে পড়লে এখনও ভয় লাগে। নৌ-বাহিনী সদর দপ্তর পার হওয়ার পর থেকে শুরু হতো জ্যাম। ঠেলতে ঠেলতে কুড়িল-বিশ্বরোড পর্যন্ত যাওয়া। গাড়ি এগোয় পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে। মন্থর লয়ে। ভেতরে বসে সেদ্ধ হয় মানুষ। সেই নিত্যদিনের ভোগান্তিভরা চেহারা প্রায় পাল্টে গেছে এখন। আগে মানুষ রাস্তাটা এড়িয়ে চলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। অবশ্য সেটার তেমন কোনো কার্যকর বিকল্প ছিলো না। যে কারণে বাধ্য হয়ে যাদের ওই রাস্তায় যাতায়াত করতে হতো, তারা ভোগান্তিটা এক প্রকার মেনেই নিয়েছিলো। আর এখন মানুষ অন্য রাস্তা রেখে কাকলী-বনানীর রাস্তা ব্যবহার করে। এটাকে শহরের যাতায়াত ব্যবস্থার একটা উন্নতি হিসাবে অবশ্যই উল্লেখ করা যায়। ধন্যবাদ দেয়া যায় এর নেপথ্যের পরিকল্পনাকারী থেকে শুরু করে এর বাস্তবায়নে জড়িত ক্ষুদ্র নির্মাণশ্রমিক পর্যন্ত সকলকে।
আজকাল গরমটা পড়ছে বেশ! এমন তরতাজা গরম অনেক বছর টের পাই নি। রোদের তাপই শরীরকে চনমনে করে দেয়। শহরটাকে মনে হয় একটা দীর্ঘ ব্যবহারে জীর্ণ তেল চিটচিটে বালিশ। যেটাকে রোদে শুকোতে দেয়া হয়েছে। আমি খুব আনন্দ নিয়ে এই গরম অনুভব করি। আবহাওয়া এমনই হওয়া উচিত। গরমের সময় কাঠফাটা গরম, শীতের সময় হাড় ছোটানো শীত আর বৃষ্টির সময় দুই মাস পর্যন্ত একটানা বৃষ্টি। একবারের জন্যও না থেমে সেই বৃষ্টি ঝরবে। আমি এমনই চাই। নাতিশীতোষ্ণ নামক মধ্যপন্থী আবহাওয়ায় থাকতে থাকতে এ অঞ্চলের মানুষ-জন কেমন যেন মিইয়ে গেছে। তাদের তেজ হয়ে উঠেছে ওই আবহাওয়া মতোই নাতিশীতোষ্ণ।
বাসের মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো ভাবছিলাম। বাইরের মোটামুটি সাজানো ফুটপাথ, মানুষের শৃঙ্খলিত চলাচল আর গতিময় জীবনের প্রতিচ্ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম। বাঁধ সাধলো মোবাইল ফোনটা। একটা টেক্সট মেসেজ আসলো। শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম। একবার মনে হলো মেসেজই যেহেতু, পরে দেখি। জরুরি হলে তো কলই আসতো। মোবাইলটা আর বের করলাম না। থাকুক পকেটের নির্জন অন্ধকারে ওটা। পকেটটা ওর বাসা।
আবার মেসেজ আসার শব্দ হলো। এবার মোবাইল বের করলাম। অচেনা একটা নাম্বার থেকে প্রথমে লেখা হয়েছে- আপনার শার্টটা চমৎকার। সবুজ আমার প্রিয় রঙ। দ্বিতীয় মেসেজটায় লেখা হয়েছে- কি হলো পকেট থেকে মোবাইল বের করেন না কেন?
আমি একটু চমকে উঠলাম। পকেট থেকে মোবাইল বের করি নি ইচ্ছে করে। সেটা অচেনা নাম্বারধারী বার্তাপ্রেরক জানলো কিভাবে? সহজাত তাড়নায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এদিক-ওদিক চোখ বুলালাম। বাসের সবগুলো সিটে মানুষ বসে আছে। দাঁড়িয়ে আছি আমিসহ তিনজন। দাঁড়ানো ব্যক্তিদের বাদ দেয়া যায় হিসাব থেকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কারও সঙ্গে এ ধরনের মজা করার ইচ্ছে তৈরি হওয়া কঠিন। বসে থাকাদের মধ্যে পরিচিত কাউকেই দেখলাম না। যাদের কাছে আমার মোবাইলের নাম্বার থাকতে পারে। তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়ালো?
বুঝতে পারলাম না। না বুঝতে পারার ওই তিলপরিমাণ হতাশা মেনেই মোবাইলটিকে পকেটে চালান করে দিলাম। বার্তাপ্রেরককে কোনো উত্তর দিলাম না। মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় নাকে এসে ধাক্কা দিলো তামাক পাতা পোড়ানোর ঘ্রাণ। ওই ঘ্রাণটা আমি খুব ভালো করে চিনি। লেখালেখি সংক্রান্ত কাজে বৃটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর সঙ্গে অনেকটা সময় ধরে আমাকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরতে হয়েছে।
তামাক পাতা পোড়ানো ঘ্রাণ সম্পর্কে ভাবতে ভালো লাগছিলো। ঘ্রাণটা সবসময়ই আশপাশের বাতাসকে একটু ভারী করে দেয়। যে এলাকায় তামাক পাতা পোড়ানো হয়, সেখানে নিঃশ্বাস টানতে একটু বাড়তি কষ্ট করতে হয় ফুসফুসকে। এ কারণেই হয়তো ঘ্রাণটা আমার পছন্দের। নিজের ফুসফুসকে নির্যাতন করতে আমার সবসময়ই ভালো লাগে। তা সে যেকোন উপায়েই হোক না কেন। সেই ভাবনটাতেও ছেদ ঘটালো একটা মেসেজ টোন।
আবার অচেনা নাম্বারধারী বার্তা পাঠিয়েছেন। এবার জানতে চেয়েছেন, তামাক পাতা পোড়ানোর ঘ্রাণ টের পেয়েছি কিনা। উত্তর লিখলাম, হ্যাঁ পেয়েছি। আমার পছন্দ ঘ্রাণ এটা। সাথে সাথে পাল্টা উত্তর আসলো, আমি জানি। ইদানীং আমারও ভালো লাগে।
আমি দুই মাত্রায় অবাক হলাম। বার্তাপ্রেরক কিভাবে জানতে পারলো আমি ওই ঘ্রাণটা পছন্দ করি- এটা ভেবে এবং সে কিভাবে জানছে আমি কখন কোথায় কি করছি- এটা ভেবে। অবাক হলে আমার স্বভাব হচ্ছে, সেটা চেপে যাওয়া। আমি তাই অচেনা বার্তাপ্রেরককে লিখে পাঠালাম, আরেকটা ঘ্রাণকেও আমি একই রকম পছন্দ করি। বলেন তো সেটা কি?
এবার অপরপক্ষ নিশ্চুপ হয়ে গেল। আমি খানিকটা সময় মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থেকে সেটাকে আবার পকেটে চালান করে দিলাম। বাস অনেকক্ষণ ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশের ট্রাস্ট ফিলিং স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে নিশ্চল যানবাহনের সারি। এই জায়গাটায় একটা ফ্লাইওভার হলে খারাপ হয় না। আশপাশে বেশ কয়েকটা বড় রুট আছে। একটা সুপরিকল্পিত যুৎসই ফ্লাইওভার হলে সব রুটের যানজটই কমে যাবে।
অবশ্য মানুষের অভ্যাস পরিবর্তিত না হলে ফ্লাইওভারে পুরো সমস্যা কখনোই মিটবে না। মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে পাঁচ পা হাঁটতে চায় না। তার আগেই রিকশা খোঁজা শুরু করে। একটু পয়সার মুখ দেখলেই মধ্যবিত্তের একটা প্রাইভেট কার না কিনলে চলে না। এসব সংকট আগে মজ্জা থেকে দূর করতে হবে। ভাবতে ভাবতে বাস থেকে নেমে পড়লাম। নিজেকে দিয়ে হোক মজ্জাগত বদঅভ্যাস দূর করার প্রক্রিয়া শুরু। হেঁটে হেঁটে চলে যাই ফার্মগেট পর্যন্ত। তারপর কি হয় দেখা যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বার্তা এলো। এবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে, কি হলো বাস থেকে নেমে গেলেন যে?
আমি ধরে নিলাম, বার্তাপ্রেরক বাসেই ছিলেন। কে হতে পারে ভাবছিলাম। বাসের জানালায় গাল ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকা যুবতী? যার দিকে আমি নিজেই মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম। নাহ, তাকে একবারও মোবাইল হাতে দেখি নি। আপনমনে ডুবে ছিলো সে। পেছনের শেষ লাইনে কয়েকটা ছেলে বসে ছিলো। তারা উচ্চস্বরে কথা বলছিলো আর হাসাহাসি করছিলো। তারা কি? হতেও পারে। যদিও ছেলেদের পক্ষে সবুজ শার্টের সৌন্দর্য উদ্ধার করাটা একটু কঠিন। এমনকি আমি নিজেও শার্টটার সৌন্দর্য কখনো আলাদা করে চেয়ে দেখি নি। শার্ট একটা কেনা দরকার পড়েছিলো। আজিজে গিয়ে কিনে এনেছিলাম। সেটার সৌন্দর্য সম্পর্কে হাতে গোণা যে কয়টা প্রশংসা আমি পেয়েছি সবই মেয়েদের কাছ থেকে। বন্ধু মৌসুমী একদিন ছবির হাটে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, আপনার শার্টটা দারুণ তো, মারিযুয়ানার পাতার কালার। শুনে আমি খানিকটা হকচকিয়ে যাই। একই রঙয়ের আরও কতকিছুই তো আছে। অথচ মেয়েটি কিনা উদাহরণ দেয়ার জন্য একটা নিষিদ্ধ জিনিসকেই টেনে আনলো!
এরই মধ্যে আরেকটা মেসেজ আসলো মোবাইলে। লেখা হয়েছে, আপনে গেলেন কই? আমার কথাটা আজকেই আপনাকে বলতে হবে। আমি মনে মনে খানিকক্ষণ প্রমাদ গুণলাম। বার্তাপ্রেরক তো সহজ লোক না। আমাকে বলার জন্য কথা জমিয়ে রেখেছে। দিলো না একটা গ্যাঞ্জাম লাগিয়ে? কি কথা সে বলবে, সেই কথা শোনার পর আমার কি প্রতিক্রিয়া হবে, সে প্রতিক্রিয়া আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে কিনা ইত্যাদি ভাবনা হঠাৎ আমাকে গ্রাস করে ফেললো। হয়তো এমন কোনো কথা সে বলবে, যেটা মস্তিষ্ককে অচল করে রাখবে কয়েকদিনের জন্য। হয়তো এমন কোনো কথা যা শুনে টগবগিয়ে ফুটে উঠবে হৃৎপিন্ডছাঁকা রক্তকণা। কিংবা হয়তো এমন কোনো কথা যা শুনে মুষড়ে পড়বো আমি আপনমনে।
এসবের কোনোকিছুই না জেনে এবং না বুঝে, একজন অচেনা বার্তাপ্রেরক আমায় জানিয়ে দিয়েছে, তার নাকি আমাকে একটা কথা বলতে হবে। এটা কিছু হলো? এখন কথাটা না শোনা পর্যন্তও শান্তি পাবো না। মনের ভেতর একবার কোনোকিছু খচখচাতে শুরু করলে সেটা কি আর সহজে থামে? লিখলাম তাকে। আসুন, আমি সোনারগাঁ হোটেলের সামনের যে তিনটা রঙিন ডাকবাক্স আছে সেগুলোর সাথে দাঁড়ালাম।
ঝটপট উত্তর এলো, আমি তো শাহবাগে চলে এসেছি। আপনে না শাহবাগের টিকেট কেটেছিলেন? আমি বললাম, আচ্ছা তাহলে শাহবাগের কোথায় আছেন বলেন, আমি আসছি। বার্তাপ্রেরক বললো, ছবির হাটে। দাঁড়িয়ে আছি। আপনি এলে আপনাকে নিয়ে পার্কে ঢুকবো এবং হাঁটতে হাঁটতে কথাটা বলবো। ও ভালো কথা, ছাতিমের গন্ধ হচ্ছে আপনার আরেকটা পছন্দের ঘ্রাণ, হয়েছে?
আমি বিস্মিত হলাম। বার্তাপ্রেরক যেই হোক, সে আমার আদ্যোপান্ত জানে। ছাতিমের গন্ধের কথা আমি কোথাও লিখি নি। কাউকে বলিও নি। কেবল অনুভব করেছি। মাঝে মাঝে গভীর রাতে ক্যাম্পাসের নির্জন রাস্তায় হাঁটার সময় ছাতিমের গন্ধরা আমার উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। আমি সেই গন্ধের তোড়ে ভেসে গিয়েছি। আবার হয়তো কখনো আমাদের গোপন আস্তানায় বসে কাটানো নিশ্চল সময়ে তক্ষকের ডাক শুনতে শুনতে সেই গন্ধকে দেখেছি বাতাসে ভেসে বেড়াতে। আমার সঙ্গের সাথীরাও দেখেছে। সবাই মিলে উপভোগ করেছি কিন্তু কখনো কাউকে বলি নি, গন্ধটা আমার কতটা প্রিয়। বার্তাপ্রেরক সেটা জেনে ফেলেছে। আমি বেশ উঁচু দরের চিন্তায় পড়ে গেলাম।
ছবির হাটে পৌঁছুতে বিশ-পচিশ মিনিট সময় লাগলো এবং পৌঁছানোর সাথে সাথেই বুকে ভীষণ ধাক্কামতো খেলাম। গেটের কাছাকাছি ছায়াঘন একটি জায়গা পৃথিবীর সব রূপ একজায়গায় জড়ো করে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অসামান্য সুন্দরী একটি মেয়ে। এ ধরনের সৌন্দর্যের বিশেষত্ব হচ্ছে, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। মেয়েটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলাম। কারো গার্লফ্রেন্ড হবে হয়তো। বয়ফ্রেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আস্তে আস্তে মেয়েটির পাশ দিয়ে হেঁটে গেটের ভেতর ঢুকে পড়লাম। মেয়েটিকে দেখে ভেতরে শূন্যতার মতো কিছু একটা সৃষ্টি হয়েছে। সেটা কাটানোর জন্য একটা ধূম্রশলাকায় অগ্নিসংযোগ ঘটানো জরুরি।
মাথা থেকে মেয়েটির চিন্তা যাচ্ছিলো না কোনভাবেই। এক ঝলকের দৃষ্টি বিনিময়ে মেয়েটি অন্তর পুড়িয়ে দিয়েছে। মানুষ এত সুন্দরও হয়? একটা নরম তুলিতে আঁকা মুখ যেন শতদলের মতো ফুটে আছে দুপুরের ওই রৌদকরোজ্জল আঙিনায়। প্রচন্ত গরমের কারণেই সম্ভবত একটু লাল হয়ে উঠেছে গাল দু’টো। যেন জামরুলের স্বচ্ছতায় ধরেছে গোলাপি আভা। আহা! প্রিয় পূর্ণেন্দু পত্রী এখানে থাকলে অবশ্যই কথোপকথন সিরিজের একটা নতুন পর্ব নামতো আজ। আমার মাথাতেই তো কবিতারা ঠেলাঠেলি শুরু করে দিয়েছে ওই মেয়েটিকে দেখে। জীবনানন্দের কবিতা মনে পড়ে গেল,
"পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো?
কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!"
এসব যখন ভাবছি তখন হাঁটতে হাঁটতে একটা ধূম্রশলাকার দোকানের সামনে পৌঁছে গেছি। দোকানদারকে টাকা দিয়ে সিগারেটটা নিয়ে ধরিয়ে পেছনে ঘুরতেই দেখি মেয়েটি দূর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চল হয়ে গেলাম। বিষয়টা কি? ইনিই কি বার্তাপ্রেরক নাকি?
পকেট থেকে মোবাইল বের করে মেসেজ অপশনে চলে গেলাম। লিখলাম, আপনে কই? লিখে একটু ছায়ামতো জায়গা দেখে একটা বেঞ্চি খুঁজে নিয়ে বসলাম। মেয়েটির দৃষ্টিসীমা থেকে আড়াল হয়ে। কি লাভ বারবার অমন সৌন্দর্য্যের মুখোমুখি হয়ে? খারাপ লাগা ছাড়া আর কিছু তো বাড়ছে না।
তৎক্ষণাত উত্তর এলো- পৃথিবীতে প্রথম কাউকে দেখলাম যে আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলো। আপনার সমস্যাটা কি?
উত্তরটা পড়ে বিষয়টা আমার কাছে আরও খানিক ঘোলাটে হয়ে উঠলো। ব্যাপার কি? কাকে দেখেও না দেখার ভান করেছি? ছবির হাটে ঢোকা থেকে এ পর্যন্ত একজন বাদে আর কাউকেই আমার চোখে পড়ে নি। এমনকি যে দোকানদারের কাছ থেকে সিগারেট কিনেছি তাকেও খেয়াল করি নি। গেটের ওই মেয়েটি সাময়িকভাবে সব মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। বার্তাপ্রেরক যদি সেই হয়ে থাকে, তাহলেও তো কথা মেলে না। তাকে দেখে না দেখার ভান তো করি নি। তার সঙ্গে একটা পূর্ণ দৃষ্টির বিনিময় হয়েছে।
আমি মেসেজ লিখলাম, আপনে তো আমাকে চেনেন মনে হচ্ছে। এগিয়ে আসুন। আমি যেখানে বসেছি তার পাশে একটা বসার জায়গা আছে।
মিনিট দু’য়েক পরে অবাক হয়ে খেয়াল করলাম জীবনানন্দ দাশের রাজকন্যাই ধীরপায়ে হেঁটে হেঁটে আমার পাশে এসে বসলো। ওর ঝাঁঝালো পারফিউমটা পরিচিত মনে হচ্ছিলো। জানতে চাইলাম, কিউবান ড্রীম? সে স্মিত হেসে উপর-নিচে মাথা দোলালো। আমি বললাম, আমার খুবই প্রিয়। সে বললো, আমি জানি। আমি আপনার সম্পর্কে প্রায় সবকিছুই জানি। আপনার লেখা প্রতিটি বই-ই আমি পড়েছি। একেকটা বই অসংখ্যবার পড়া হয়েছে এবং তারচেয়ে বড় কথা হলো আমি এখন আপনার বই ছাড়া আর কারও বই পড়তে পারি না।
আমার মনে পড়ে গেল, ‘যখন আরও কয়েকশ বছর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে অকারণে’ গল্পটায় আমি লিখেছিলাম আমার একটা পছন্দের পারফিউমের কম্বিনেশন হলো কিউবা আর কিউবান ড্রীম। মেয়েটি আমার সব লেখা পড়েছে জেনে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করলাম। একটু আগে যার দিকে অগ্রসর হওয়ার ইচ্ছাকে বহু কষ্টে দমন করে হৃৎপিন্ডে সৃষ্ট শূন্যতাকে ভরাট করতে হচ্ছিলো নিকোটিনের ধোঁয়া দিয়ে, সে এখন আমার পাশে বসে আছে এবং বলে বসেছে আমার লেখা ছাড়া নাকি আর কারও লেখা সে পড়তে পারে না। এই পুরো ঘটনাপ্রবাহটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য এবং অগ্রহণযোগ্যই লাগছিলো। আবার চোখের সামনে ঘটমান বাস্তবকে অস্বীকারও করতে পারছিলাম না। এ ধরনের অবস্থায় আমি সাধারণত নিজের বিহ্বলতা লুকিয়ে ফেলি এবং বুঝি-না বুঝি, সবকিছুকে খুব স্বাভাবিক হিসাবে নেয়ার চেষ্টা করি।
মেয়েটিকে বললাম, অন্যদের বই পড়তে না পারলে তো সমস্যা। আমারগুলো যখন একঘেঁয়ে লাগা শুরু হবে তখন কি করবেন? মেয়েটিকে এ কথায় খানিকটা বিষণ্ন হয়ে পড়তে দেখা গেল। কোনো কথা না বলে সে কিছুক্ষণ উদাসভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমার কখনোই আপনার কোনো লেখা একঘেঁয়ে লাগবে না।
আমি জানতে চাইলাম, কিভাবে এত নিশ্চিত হচ্ছেন?
-আমি নিজেকে চিনি তাই।
-হুম কিন্তু আমার তো নিজের লেখাকে রদ্দি ছাড়া আর কিছু মনে হয় না।
-সেটাও আমি জানি। নিজের সম্পর্কে আপনি খুব একটা উচ্চ ধারণা পোষণ করেন না। তাতে পাঠকের কিছুই যায় আসে না।
-খুশি খুশি লাগছে আপনার কথা শুনে। এখন সেই কথাটা বলেন। যেটা বলার জন্য আমাকে ডেকেছেন। আর তার আগে আপনার নামটা বলেন। আমরা পরিচিত হই।
-আমার নাম অবন্তী।
শুনে চমকে গেলাম। আমার গল্পগুলোতে আমি অবন্তীকে যেভাবে আঁকার চেষ্টা করি এ মেয়েটি ঠিক তেমনই কিন্তু এর নামও যে অবন্তী তা আমি কল্পনা করি নি। অনেক কাকতালীয় মনে হলো ব্যাপারটাকে। আমার চমকানো মেয়েটির চোখ এড়ালো না। সে জানতে চাইলো,
-অবাক হয়েছেন, তাই না?
-তাতো খানিকটা হয়েছিই। সবকিছু কেমন যেন মিলে যাচ্ছে আজকে।
-আচ্ছা অবাক হওয়া বাদ দেন। চলেন হাঁটি।
প্রখর রোদে চামড়া পুড়িয়ে হাঁটতে আমার সবসময়ই ভালো লাগে। মেয়েদের সেটা ভালো লাগার তেমন কোনো কারণ নেই। অবন্তীকে দেখে মনে হলো তার ভালো লাগে। আমরা পুরো সোহরাওয়ার্দী পার্কটা একবার চক্কর দিয়ে ফেললাম। অবন্তী মাঝে মাঝে ওর কথাগুলো বললো। মেয়েটির কথা শুনতে ভালো লাগছিলো। সে মনের ভেতর ভীষণ একটা অস্থিরতা পুষে রেখেছে। যে অস্থিরতার জন্মদাতা আমি। আমার লেখাগুলো পড়ে তার ভেতর অস্থিরতা জন্ম নেয়। তারপর আমাকে খুঁজে বের করা, নিয়মিত অনুসরণ করা, ভুত-ভবিষ্যতের খোঁজ-খবর নেয়া সবই সে করেছে। কারণ সে তার নিজের জীবনটা আমার সাথে জড়াতে চায়। এর বাইরে সে আর কিছুই ভাবতে পারে না এখন।
আমি অবশ্য সেদিন ওর বুদ্ধিতে সায় দিই নি। আমার মতো একটা জবরজং, চালচুলোহীন, নরাধমের সঙ্গে সংসারের কারো পক্ষেই বেশিদিন টেকা সম্ভব না। আজ আমার লেখা ভালো লাগছে, তার কারণও ওই একটাই। সে আমাকে লেখার মধ্য দিয়ে চেনে। বাস্তবে আমার ছাল-বাকল গায়ে জড়িয়ে যে মানুষটি মহানগরীর পথে-ঘাটে চড়ে বেড়ায়, সে মোটেও আকর্ষণীয় নয়। মেয়েটিকে বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করতেই সে অন্যরকম হয়ে গেলো। দেখে বুঝলাম, কষ্ট পাচ্ছে। তারপরও সেদিন ওকে অনাগত দিনের বৃহত্তর কষ্ট মুক্তি দেয়ার দরকার ছিলো। কারণ আমি জানতাম, সংসারে তেলে-ঝোলে একবার মিশে যাওয়ার পর ভালোবাসাকে আর আলাদা করে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
পৃথিবীর সব দেশের রূপকথায় ঘোড়ায় চড়া টগবগে রাজকুমারেরা এসে নায়িকার সামনে দাঁড়ায়। নায়িকা ঘোড়ায় উঠে পড়ে আর তারপর দু’জনে সাত সমুদ্র এবং তের নদীর ওপারে হারিয়ে যায়। সুখে-শান্তিতে জীবন যাপন করে। আমার ক্ষেত্রে একটু উল্টোভাবে ঘটনাটা ঘটেছিলো। অবন্তী নামের এক স্বপ্নের রাজকুমারীই একদিন সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। অথচ আমার ওর ঘোড়ায় উঠে বসার উপায় ছিল না।
---
মন্তব্য করুন