দিনলিপিতে দু'হাজার বাইশ - ১
ইয়েন্স গুটোভস্কি নামের এক ব্যাক্তিকে ফেসবুকে পোস্ট দিতে দেখলাম "ভাঙ্গনজনিত কারণে নতুন বাসার প্রয়োজন পড়েছে" লিখে। কারও সন্ধানে ভাড়া পাওয়ার মতো বাসা থাকলে তাকে যেন জানানো হয়।
যে শহরে থাকি সে শহরের বাসিন্দাদের একটা "ফেসবুক পেইজ" রয়েছে। সেখানে বাসিন্দারা নিজেদের মজার ছবি, অভিজ্ঞতা, অভিযোগ ইত্যাদি যেমন প্রকাশ করেন, তেমন ঘরের পুরোনো আসবাবপত্র বিক্রি, ঘর ভাড়া দেয়া ইত্যাদির বিজ্ঞাপনও প্রকাশ করেন। আবার ইয়েন্সের মতো কেউ কেউ ঘর ভাড়া বা আসবাবপত্র ইত্যাদির খোঁজে থাকলে, তারাও সুবিধাটা ব্যাবহার করেন।
সেই পেইজটাতে আমি প্রকৃতির ছবি প্রকাশ করতাম। অফেনবুর্গ নামের যে শহরটায় প্রায় চারটা বছর থাকলাম, সেটাকে প্রকৃতির বরপুত্র বললে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম। চারপাশে পাহাড়, মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া রাইনের ছোট্ট শাখা নদী "কিনজিগ", আর দৃষ্টিসীমার ভেতর বড় বড় ওক আর পাইন গাছের বন। দীর্ঘ বিস্তৃত "ব্ল্যাক ফরেস্ট" অঞ্চলের পাহাড় ও বনবিভাগ এ শহরকেই প্রাকৃতিক ও কংক্রীটের জঙ্গলের মিলনস্থল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এ শহরের এক খোলামেলা প্রান্তরে, পুরোনো ধাঁচের এক পাঁচতলা ভবনের চারতলায়, দুই রুমের একটি ছোট অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে আমি থাকি। আর বেশিদিন নেই যদিও। অচিরেই জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমাতে হবে পশ্চিম জার্মানির শহর এসেন-এ। তার আগে বাসাটির একটি বন্দোবস্ত করে যেতে পারলে ভালই হয়। নাহলে শুধু শুধু ভাড়া গুনতে হবে। বাসা ভাড়া নেয়া কিংবা ছেড়ে দেয়ার বন্দোবস্ত এই দেশে ঠিক আমাদের দেশের মতো সহজ নয়। বিশেষ করে বাসা ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়াকে বেশ জটিলই বলা যায়।
প্রথম সংকট হিসেবে বলা যায়, বাড়িভাড়ার চুক্তি অনুযায়ী যে কয় মাস আগে নোটিশ দেয়ার কথা, সে ব্যাপারে বাড়াবাড়ি রকমের বাধ্যবাধকতার কথা। যে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির বাড়িতে আমি ভাড়া থাকি, তাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আমার অন্তত তিন মাস আগে এ নোটিশ দেয়ার কথা। সেখানে আমি মাত্র এক মাস আগে নোটিশ দিয়েছি। তাই অন্তত দুই মাসের বাড়তি ভাড়া আমার গোণা লাগতে পারে- এমন একটা শঙ্কা তো রয়েছেই।
আশপাশের বন্ধুস্থানীয় সকলেই পরামর্শ দিলো, এখন বাসা খুঁজছে এমন কাউকে খুঁজে বের করে তাকে বাসাটা বুঝিয়ে দিয়ে যাও। তাহলে কোম্পানিকে আর দুই মাসের বাড়তি ভাড়া দিতে হবে না। নতুন ভাড়াটিয়া পেলে কোম্পানিও কোন ঝামেলা করবে না। তাই ইয়েন্সের ফেসবুক পোস্টটি দেখে ভাবলাম লোকটাকে আমার বাসাটা কেমন লাগে জিজ্ঞেস করি।
বাড়িভাড়ার চুক্তি আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করা গেলেও রয়েছে, পানি ও বিদ্যুত সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তি। প্রতি মাসে পানি ও বিদ্যুত বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে চলে যায় ওই সংস্থাগুলোর কাছে। তাদের সঙ্গে বিদ্যমান চুক্তিও যথাসময়ে সমাপ্ত না করলে, যন্ত্রণা চলতেই থাকবে। আরও আছে রেডিও বিল কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি।
জার্মানিতে এই এক হ্যাপা! জাত-ধর্ম-বর্ণ-দেশ নির্বিশেষে এ দেশে বসবাসকারী সকলকে রেডিও বিল দিতে হয় (শুধু অপ্রাপ্তবয়স্করা বাদে)। রেডিও থাকুক আর না থাকুক। সেই বিলের খতিয়ানও আবার নিজ দায়িত্বে ঠিকঠাক করে রাখতে হয়। নাহলে যেকোন দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে "ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট জব্দ হয়ে আছে" দেখা যেতে পারে।
এই এক জ্বালা! এ দেশে কিছু হলেই ব্যাংক-অ্যাকাউন্ট জব্দ হয়ে যায়। আর বেশিরভাগ লেনদেনগুলো ব্যাংকের সঙ্গে সংস্থার ভেতর স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে বিধায়, ব্যাংক-অ্যাকাউন্ট জব্দ হলে সেসব লেনদেনও বাধাগ্রস্থ হয়। যা আবার পরে গিয়ে জরিমানা সৃষ্টি করতে থাকে। সবমিলিয়ে ব্যাংক-অ্যাকাউন্ট জব্দ হয়ে যাওয়াটা একটা হ্যাপাই বটে।
যাই হোক, ইয়েন্স গুটোভস্কি আসবে আগামীকাল বাসা দেখতে। দেখে-শুনে পছন্দ করে গেলে বাসাখানি আগামী সেপ্টেম্বরের শেষে ছেড়ে দেবো। তারপর শুরু হবে নতুন জীবন নতুন জেলায়।
সামনের দিনগুলো বেশ ব্যস্ততা আর উত্তেজনায় পূর্ণ। দেখা যাক কি হয়!
---
মন্তব্য করুন