গল্প: আপনাদের বাড়ি থেকে অরোরা দেখা যায়?
পার্ফমেন্স মার্কেটিং যেমন ডিমান্ডিং, তেমনি হেভিওয়েট একটা জব, যেটা ঘুম ছাড়া দিন-রাত সর্বক্ষণ মাথার ভেতর বন্ধুর মতো সঙ্গ জুগিয়ে চলতে পারে। মানুষের আর বেশি কিছু লাগে না। একটা কোম্পানির চাকুরির বিজ্ঞাপন দেখে ভাবছিল তিষি, কি দারুণ করেই না নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনের ছবি আঁকতে পারে তারা!
প্রতিদিন সকালে কোম্পানির ভেতর কফিমেশিন চলে প্রবল গতিতে। এখন সময় এনালাইসিসের। কেপিআই-গুলোর কি অবস্থা? মেটা-ক্যাম্পেইনটা কেমন চলছে? নতুন ল্যান্ডিং পেইজটা কি কনভার্সন আনছে, যেমনটা আশা করা হয়েছিল?
এরই ভেতরে পার্ফমেন্স এজেন্সির লোকজন চলমান ক্যাম্পেইনগুলোর টার্গেট গ্রুপ সোশ্যাল প্রোফাইলগুলোকে চিহ্নিত করে ইমেইল পাঠিয়েছে। তারা নতুন রিমার্কেটিং ক্যাম্পেইন চালু করতে চায়। কোম্পানির কি তাতে কোনো আপত্তি আছে? অপরদিকে, মেসেজ পাঠিয়েছে ফ্রি-ল্যান্সার, সুদূর বাংলাদেশ থেকে। তার নতুন ডিজাইনটা পছন্দ হয়েছে কিনা ফেসবুকের পরবর্তী বিজ্ঞাপনের জন্য, জানতে চেয়ে। দেশের নামকরা এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টপ-র্যাংকিং ছাত্রী। তাকে মেসেজের জবাব যথাসময়ে পাঠাতে হবে। পাশাপাশি অফিসের কলিগদের সঙ্গে সুযোগ পেলেই যোগাযোগ করতে হবে যাতে সবার সব কাজ যথাযথভাবে চলছে কিনা জানা হয়ে যায়, অর্থাৎ যাকে বলে 'ওয়ার্কফ্লো' সেটাকে যতোটা পিচ্ছিল (স্মুথ) রাখা সম্ভব হয়।
এসবের দিকে খোঁজ-খবর করতে করতে দুপুরে খাবার সময় তো হয়ে যাবেই। এক ঘন্টার বিরতিতে দুপুরের খাওয়া সারার পর্ব। পাশাপাশি ময়লা কাপড় থাকলে তা ওয়াশিং মেশিনে চালান করা! চাকুরিটা যে হোম-অফিস।
কাপড় মেশিনে দিয়ে এসে আবার শুরু। সব উত্তর-প্রত্যূত্তর পাঠানো শেষ, আড্ডা-গুলতানিও সম্পন্ন। এবার সত্যিকারের কাজ নিয়ে বসা। প্রথমে ক্যাম্পেইনগুলো দেখা। সেগুলো যেসব প্ল্যাটফর্মে চলছে, সে প্ল্যাটফর্মগুলো দেখা। কোথাও কোন সংকট থাকলে সেটাকে চিহ্নিতকরণ। সেটার কোন সমাধান থাকলে তা প্রয়োগ। না থাকলে পরবর্তী পর্যায়ে জানানো।
এভাবে সবগুলো ক্যাম্পেইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে, তার পরের পর্যায়ের কাজ শুরু করতে হয় কোন একটা সি-আর-এম সিস্টেমে। সে আরও বেশি টেকনিক্যাল কাজ। সেখানে সারাদিন সংখ্যা, সংমিশ্রণ আর স্থানান্তরের খেলা চলে। চাইলে ঘন্টার পর ঘন্টা ডুবে থাকা যায়। তারপর বিকালে সাইন-আউট করার আগে হাতে বাড়তি সময় থাকলে, একটা ফেসবুক পোস্টের টেক্সট কম্পিউটারে লিখে পরের দিনের জন্য সংরক্ষণ করে রেখে দেয়া যায়। এই হলো পার্ফমেন্স মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে তোমার চাকুরি। করবে তিষি?
বিজ্ঞাপনটা যেন ডাকছে একদম। ঠিক এ কাজগুলোই করছেসে, বিগত আটটি বছর ধরে 'গ্লোবাল' এই কোম্পানিটাতে। কোম্পানির গন্ডি ছাড়িয়ে এটি এখন আসলে কনসার্ন-এ রূপান্তরিত হয়েছে। বছরে ১১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নেট আয় তার। বিল গেটস্-এর সর্বমোট নেট সম্পত্তি ১০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বলছে গুগল মামা ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এই 'নেট' শব্দটা মূলত সম্পত্তিটাকে বৈধতা দেয় মাত্র। এর অর্থ হচ্ছে, ওই পরিমাণ সম্পদেরই হিসাব বৈধ কোন কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে। এর বাইরে কি আছে, না আছে সেটা তাদের এখতিয়ারে না। পুলিশ কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কিংবা পানামা ফাইলস্-এর মতো কেইস হলে তার এখতিয়ার আরও বাইরে। কারও কাছেই নেই আসলে।
বিজ্ঞাপনটি তিষি দেখছিল আর ভাবছিল, এরচেয়ে যদি উত্তরে আরো উত্তরে উৎসিওকি ভিলেজে এই কোলাহল থেকে দূরে নিরিবিলি মাছ ধরার একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া যেতো? খুব ঠান্ডা হয়তো লাগতো সেখানে, কিন্তু মাঝে মাঝে রাতের আকাশে ধরা দিতো ঘন সবুজ আলোর নাচন। কিংবা গাঢ় বেগুনি আর কমলার মিশেলে এক দ্যূতিময় আলোর রেখা।
জাপানি 'কোবে' গরুর মাংস খাওয়ার নানান অনন্য উপায় রয়েছে। অনেক জায়গায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে খুব আরামদায়ক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে খাদ্যটি গ্রহণ করা হয়। সে প্রক্রিয়ার শুরুতে সিট্রাস বা লেবুর রস মিশ্রিত শরবত দিয়ে পাকস্থলী তথা খাদ্যতন্ত্রকে পরিকল্পিতভাবে প্রস্তুত করা হয়। যেন-তেন খাদ্যগ্রহণের জন্য নয় কিন্তু। পরিমিত পরিমান ও লক্ষ্যনির্ভর খাদ্যগ্রহণের জন্য, যেখানে খাওয়ার পর মানুষ ভাতঘুম দিতে চায়, নাকি আরও বেশি বেগে কাজে ঝাপিয়ে পড়তে চায়- এমন সব বিপাকীয় প্রভাব-প্রতিপত্তির ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিভেদে মেন্যু কাস্টমাইজ করা থাকে।
উৎসিওকি ভিলেজে তেমন কোবে গরুর মাংস, আর হাতে বানানো রসগোল্লা 'ডেজার্ট' হিসেবে মাঝে মাঝে জুটলেও কিন্তু খারাপ হতো না। আর সঙ্গে একজন নির্ভর করার মতো মানুষ লাগতো। যারও অরোরা দেখতে খুব ভাল লাগে। আর ভাল লাগে কোলাহলশূন্যতা।
ভাবতে ভাবতেই নিজেকে খানিকটা চোখ রাঙানি দিয়ে ফিরিয়ে আনলো সে মর্ত্যের পৃথিবীতে। কি সব আবোল-তাবোল চিন্তাভাবনা!
---
মন্তব্য করুন