ইউজার লগইন

গল্প: কষ্টের রেলগাড়ি

অনেক দিন চিকন চালের ভাত আর মুরগির মাংসের পাতলা ঝোল দিয়ে রাতে খাওয়া হয় না। ভাবতে ভাবতে যেই না মুরগির তাকের দিকে তাকিয়েছেন মুর্শেদ সাহেব, ভিমড়ি খাবার জোগাড় হলো তার।

এমনিতে দোকানটার তাকগুলো খুব সাজানো-গোছানো, যেকোন কিছু যাতে ক্রেতারা সহজে খুঁজে পেতে পারে, সেদিকে পূর্ণ খেয়াল রেখে বিন্যস্ত; সেটা তার জানাই। নিত্যদিন যে আসা-যাওয়া পেনি নামের সেই ছোট্ট ২৪ ঘন্টার স্টোরটায়। যেটা সপ্তাহে সাত দিন আর বছরে ৩৬৫ দিন খোলা থাকে। শুধু যেসব বছর লীপ ইয়ার অর্থাত ৩৬৬ দিনে হয়, সেসব বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি বন্ধ।

কিন্তু এসব কিছুর সঙ্গেই যোগ ছিল না সেদিনের প্রায় ভিমড়ি খাওয়ার কারণের। মুরগির তাকে বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন উপায়ের কতলকৃত মুরগি থরে থরে সুবিন্যস্ত ‌ছিল। মুর্শেদ সাহেবের জানা ছিল কোন তাকে থাকে তার বাসায় যেটা খাওয়া হয় সেই মুরগিটা। তিনি ঠিক সেই তাকের দিকেই দৃষ্টিনিক্ষেপ করেছিলেন। আশা ছিল নধর টাটকা হয়তো সদ্যই হালালকৃত কোন মুরগির উন্মুক্ত বক্ষদেশ উপবৃত হবে দুখানি অক্ষিগোলক।

বিধি বাম! প্রথমেই চোখ পড়লো রাতারাতি বেড়ে দাম পৌনে ছয়শ থেকে বারশো হয়ে গেছে। একেবারে এত বড় লাফ মুরগি গত ১২ মাসে দেয়নি। গরুকে একবার দিতে দেখা গিয়েছিল। পাঁঠাকে দুবার। কিন্তু মুরগি ছিল মধ্যবৃত্তের নয়নমনি আর হাঁতের পাঁচ হয়ে সেই দুর্দিনেও। আজ এ কোন কলির কালছায়া জগত-সংসার গ্রাস করে নিলো ভাবতে ভাবতে মুর্শেদ সাহেব পিছু হটতে বাধ্য হলেন।

মাছের তাকের পানে এবার যখন নয়ন মেললেন, তখন সেখানে উৎসাহের কোন কমতি ছিল না। তবে খানিক হেঁটে যখন তিনি দোকানের মৎস্য সাম্রাজ্যে মোটামুটি পৌছেঁই গেছেন, তখন দুর থেকে চোখে পড়লো বাগদা চিংড়ি বারোশো পোয়া।

ব্যাপারটা হেলুসিনেশন কিনা, তাই নিয়ে খানিক ভেবে দেখা অতীব জরুরি মনে হলো মুর্শেদ সাহেবের। এই বাগদাই তো গেল সপ্তাহেও তিনশ-সাড়ে তিনশ পোয়ায় বিকোচ্ছিল, হঠাৎ এক লাফে চার তলায় উঠে বসবার কি হলো! আর এতখানি মূল্যবৃদ্ধি কি আদৌ সম্ভব? ব্যবসায়ীরা কি পারে? আর সরকারই বা আছে কি করতে? মুর্শেদ সাহেব কষ্টে-সৃষ্টে যা আয় করেন, তার যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বছর বছর কর নামক জোঁকে এসে চুষে চুষে খাচ্ছে- তা কি এই মাৎস্যন্যায় সহ্য করবার জন্য?

ভাবতে ভাবতে শুধু মাছের আইলটা পেরিয়ে গিয়েছিলেন বলে রক্ষা। নাহলে সেদিন কুরু দেশের রাজার গদিতে টান পড়েই গিয়েছিল একদম। তবে কিনা বেশিক্ষণ কুরু দেশের রাজা শান্তিতে থাকার সুযোগ পেলেন না। আর তা পাবেনই বা কি করে? রাতারাতি জিনিসপাতির দাম অমনধারা বেড়ে গেলে মানুষে কি রাজ্যের রাজাকে ছেড়ে কথা কইবে? এমনও হয়?

ভাবতে ভাবতে মুর্শেদ সাহেব মাছের আইল থেকে ততক্ষণে অনেক দুরে চলে গিয়েছেন। এবার ইচ্ছে শাক-সবজি কিনবেন। বাড়িতে শসা নেই। গতকাল লাঞ্চে রমেশ বাবুকে শসা-টমেটোর সালাদ দিয়ে পরোটা আর মাংস খেতে দেখে নোলাটা এমন সকসক করছিল যে, বাড়িতে গিয়ে গিন্নিকে বলেছিলেন শসা-টমেটোর সালাদ বানিয়ে দিতে। তিনি মাংস ছাড়াই সালাদ দিয়ে ডাল আর রুটি খাবেন। গিন্নি কেমন মুখের উপরি খনখনিয়ে বলে গেল, বাপের জন্মে অমন কথা শুনি নি বাপু।

আজ শসা আর টমেটো নিয়ে গিয়ে গিন্নিকে সালাদ বানিয়ে খাইয়ে তবে তিনি ছাড়বেন। বলে মুর্শেদ সাহেব চললেন সেদিকে, যেদিকে দুর থেকে লম্বা, সবুজ, কচি শসাগুলো দেখা যাচ্ছিল। কাছে গিয়ে হঠাৎ যেন ভুত দেখার মতো চমকে উঠলেন তিনি। ৪৯ টাকার শসার দাম লেখা আছে ৩৬৫ টাকা!

এবার মুর্শেদ সাহেব বিস্ফোরিত হলেন। পেয়েছে কি সকলে, অ্যাঁ?

ছোট্ট স্টোরটায় সাধারণত এমন মজার ঘটনা ঘটে না। উচ্চ রক্তচাপের কারণে মুর্শেদ সাহেবের কুখ্যাতি ছিল আগে থেকেই। সেদিনও হঠাৎ রেগে গিয়ে সম্বিত হারিয়ে ফেলেন তিনি। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে মেঝেতে এবং নিজের ওপরে অনেক কৌতুহলী মুখকে উপবৃত অবস্থায় আবিস্কারও করেন।

তবে আশপাশের মানুষেরা মুর্শেদ সাহেবের সহমর্মী ছিলেন। তারা সকলে মিলে দ্রুত মুর্শেদ সাহেবের বাড়িতে খবর দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তারাও দ্রুতই চলে এসেছিলেন অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস সব নিয়ে। সে দু'গাড়ি ভরা মানুষ। এক মুর্শেদ সাহেবকে নিতে অতো মানুষ আসার কি দরকার ছিল তা বুঝতে পারে নি কিন্তু স্টোরে দাঁড়িয়ে থাকা অতগুলো মানুষের কেউই। এমনকি বুঝতে পারেনি স্বয়ং ম্যানেজারও। মানুষের ব্যাপারটি ছাড়াও কেনই বা মুর্শেদ সাহেব অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন তাও বুঝতে পারে নি প্রায় কেউই।

বুঝেছিল শুধু ছোটুটা। নাম ছোটু হলেও ওর বয়স দশ বছর। পাঁচ বছর বয়স থেকে স্টোরে আছে সে। স্টোরের সব কাস্টমারকে তার মুখস্ত। ছোটু জানতো মুর্শেদ সাহেব বছরখানেক আগেও এ স্টোরের নিয়মিত খদ্দের ছিলেন। প্রায়ই ছোটুর সঙ্গে একটা, দুটা কথা হতো তার। ছোটুর সকল কাস্টমারকে মনে রাখার ক্ষমতায় অভিভূত হতে ভালবাসতেন তিনি। যাবার সময় মাঝে মাঝে আদর করে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে যেতেন।

ছোটু জানতো মুর্শেদ সাহেব এক বছর আগে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। তাকে বাড়িতে একটা ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। এমনিতে ভাল থাকেন কিন্তু মাঝে মাঝে ভুল যান তিনি কোথায় কিংবা কোন সময়ে বাস করছেন। মুর্শেদ সাহেবের ছেলে মাঝে-মধ্যে স্টোরটাতে আসতো। ছোটুর কথা মুর্শেদ সাহেব বাসাতেও অনেককে বলেছেন। সেখান থেকে ছেলেটার সঙ্গে ছোটুর পরিচয়।

আজ মুর্শেদ সাহেবকে স্টোরে দেখে অবাক হলেও, কিছু বলে নি ছোটু প্রথমে কারণে ভেবেছিল, হয়তো তিনি সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। যাবার সময় বুঝি আজ আবারও চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে যাবেন? অনেকদিন পর দেখা যেহেতু, ঘটনাটা ঘটতেই পারে। সাবধান থাকতে হবে।

ছোটু যখন এইসব ভাবছিল ঠিক সেই সময়ই বিরাট আর্তচিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মুর্শেদ সাহেব। ছোটু মন খারাপ চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের জীবন সমান কষ্টের। একটা মানুষও নাই, যার কষ্টটা একটু কম। একটাও না!

---

পোস্টটি ৩ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!