ইউজার লগইন

গল্প: তুমি আমার কাছে তুমি যা বলবা তাই (পর্ব- ১)

মনে আছে, প্রথমবার যখন মেয়েটি আমার সাথে যোগাযোগ করে, তখন আমি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলাম। যোগাযোগ করে মানে মেসেজ দেয় আরকি। মেসেজের শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছিল এমন না। এমনিতেই ভেঙ্গে গিয়েছিল আর ওই সময়েই মেসেজটা এসেছিল।

ঘুম ভাঙ্গা চোখ মেলে বাইরের দিকে তাকিয়ে আমি একটা জোড়া শালিক দেখতে পেয়েছিলাম। ঠিক শালিক নয়, ওদের মতোই দেখতে একটা ভিনদেশি পাখি। খানিকটা বড়। কখনও এরা মুখ দিয়ে কোন শব্দ করে তা শুনি নি। কিংবা করলেও কেবল এক ধরনের চিড়িৎ চিড়িৎ আওয়াজ শুধু। সঙ্গীকে কোন কোডেড মেসেজ পাঠায় মনে হয়। এমনভাবে যাতে অন্য কেউ বুঝতে না পারে।

জোড়া শালিক চোখে পড়লে আমাদের দেশে হয়তো অনেক মানুষের মনে কোন একটা কিছু 'অকারণ' দোলা দিয়ে যায়। আমি যে দেশে থাকি, সেখানে ওসব সংস্কারের কোন বালাই নেই। তাই বাইরের দিকে বেশিক্ষণ না তাকিয়ে থেকে বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা টেনে নিলাম। আর তাকিয়ে থাকবোই বা কোনদিকে? সামনে একটা পাড়ার ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা, আর অপরপাশে সারিবদ্ধ বাসভবন। উপরের দিকে জানালার কোনায় সামান্য আকাশ ধরা পড়ে। সামান্য আকাশ দিয়ে কি আর আমার কাজ চলে?

চাকুরির সুবাদে জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট এলাকায় একবার একটা বাসা নিয়েছিলাম। সেই বাসার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে মাইলের পর মাইল জুড়ে বিছিয়ে রাখা উচুঁ-নিচু সবুজ পাহাড়ের চাদর দেখা যেত। কে যে ওই সবুজ পাহাড়ের চাদর ওখানে বিছিয়ে ছিল, তা জানা নেই। কিন্তু যখনি আমি জানালা দিয়ে ওই দিকে তাকাতাম, চোখ দু'টো ছলছল করে উঠতো। কোন একদিন ওই পাহাড় আমায় ডেকে নিয়ে যাবে, তাই ভেবে ভেবে। আমি ওই পাহাড়ের কোলঘেঁষে দূরে দূরে দাঁড়ানো একেকটা একলা বাড়ি দেখে ভাবতাম, আমিও একদিন ওখানে অমন একটি ওঠাবো!

সেই পাহাড় যে আমিই মনের ভুলে হারিয়েছিলাম, তা আমায় যারা চেনে তাদের জন্য অতি সহজে অনুমেয়। যারা চেনে না, কিংবা শুধু সোশ্যাল মিডিয়া আর ব্লগের লেখার মাধ্যমে আমায় চেনে, তাদের জন্য অবশ্য না। অনলাইন জীবনের সঙ্গে আমাদের সবারই- বাস্তব জীবনের অনেক তফাত, তাই না?

বলছিলাম আমার হারানোর কথা। শুধু কি সেই পাহাড়কে হারিয়েছিলাম সেবার? সঙ্গে হারিয়েছিলাম যার সঙ্গে ওই পাহাড়ের কোলে গিয়ে ঘর ওঠানোর স্বপ্ন দেখতাম, তাকেও।

সে এক কালসময় এসেছিল জীবনে। সবকিছু এখন আর ঠিকঠাক মনে নেই। কখনও সবকিছু ঠিকঠাকভাবে মনে রাখতে চেয়েছিলাম কিনা, তাও জানি না। কেননা তখন সব হারানোর ব্যাথায় নীলাম্বু হয়ে আমি পাহাড় থেকে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতাম সারাদিন। ছুয়ে দেখতাম ওদের মাটি, গাছপালা আর সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস লুকাতাম। বুকে ভরে নিতাম ওদের বাতাস- যেন চুরি করে ওসব আমি ফুসফুসে ভরে নিয়ে যাবো কোন এক অজানার পানে!

যখন ওইখানে থাকতাম তখন সত্যিই আমি আমার ঘুম ভাঙা চোখগুলো খুলেই টান টান করে মেলে দিতাম বাইরে। চোখেরা সবুজ পাহাড়, খোলা আকাশ আর মুক্ত বাতাসে নিজেদের জুড়িয়ে নিতো সকালবেলাতেই। মনটা সারাদিনের জন্য ভরে থাকতো অনাবিল আনন্দে।

আর আজকাল চোখ মেলে রাস্তার অপর পাশের বাসভবন দেখতে হয় বলে, চোখ মেলতেও ইচ্ছে করে না ঠিকঠাকমতো। তারপরও কখনো মনের ভুলে বাইরে চোখ চলে গেলে, তাড়াতাড়ি মোবাইল টেনে নিই চোখের সামনে। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম খুলে কিছুদূর স্ক্রল করতে পারলেই অর্ধনগ্না ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশালবক্ষা, নৃত্যরত দৃষ্টিনন্দন অচেনা নারীদের দেখা মেলে। ওইতে ডুবে থাকাই উত্তর।

তাই করতে গিয়েছিলাম সেদিনও। দেখি কি একজন অচেনা মানুষ মেসেজ দিয়েছেন। সাধারণত অচেনা মানুষেরা হোয়াটস্অ্যাপের প্রাপ্তবয়স্কদের দলে যোগ দেয়ার আহ্বান কিংবা আফ্রিকায় আটকাপড়া কোন সাত রাজার ধনের প্রলোভন দেখানোর উদ্দেশ্যেই মেসেজ দেন। তাই তেনাদের মেসেজ আজকাল আর দুই নং কিংবা তিন নং মেসেজ-বক্সের বাধা পেরিয়ে এক নং মেসেজ-বক্সে আসতে পারে না। সেদিন একটিকে একদম সব বাধা পেরিয়ে এক নং মেসেজ-বক্স ইস্তক চলে আসতে দেখে তাই খানিক অবাকই হয়েছিলাম। সে কারণেই অচেনা হাই-এর উত্তরে একটি অজানা হেলো পাঠিয়ে অন্য কাজে মনোযোগ দিয়েছিলাম।

যদিও বেশিক্ষণ মনোযোগ রাখা সম্ভব হলো না। অচেনা মানুষটি জানতে চেয়েছেন, আমি তাকে চিনেছি কিনা?

আমার কোন ধারণা ছিল না। প্রোফাইলের যে ছবি দেয়া তাতে মুখের অর্ধেক কালো রংয়ের মাস্কে ঢাকা। মনে হলো, প্রোফাইল ছবিটা বলতে চাচ্ছে, না না না তুই একে চিনিস না। চিনতে যাসও না। তোর কিন্তু খুব ফাটা রাশি। কি বিপদে জড়াবি কে জানে। অমনতর কথাবার্তা মাথায় চলছিল বলেই কিনা কে জানে, দুম করে বলে দিলাম, না তো চিনি নি।

আগেও একবার একজন আমায় এভাবে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি তাকে চিনেছি কি না। না চিনেও বলেছিলাম, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করেছিল, বলতো আমি কে? আমি গানের সুরে উত্তর দিয়েছিলাম, তুমি থাকো সিন্ধুপাড়ে ওগো বিদেশিনী।

প্রত্যূত্তরে শুনতে হয়েছিল, মিনসে আমি তোর গার্লফ্রেন্ড। আজ পাই খালি তোকে একবার। ছিন্ধুপাড়ের অচেনা মায়াগো লিয়া গান গাও? যেই গলা দিয়া ওই গান বাইরৈছে, হেই গলা যুদি আইজ্কা আমি কাইট্টা বাড়িত না নিছি, তো আমার নামভি নিছি না।

বান্ধবীর নাম ছিল নিশি। বাড়ি পুরান ঢাকা। এমনিতে শুদ্ধ বাংলায় ঝরঝর করে কথা বলতে পারে। খালি বেশি রেগে গেলে শুদ্ধ বাংলা একসময় কুট্টি ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। ওর অজান্তেই।

অথচ ওর মুখের কুট্টি ভাষা শুনবো সারাদিন- এই অভিসন্ধিতেই জুটি বেঁধেছিলাম আমরা। পরে বুঝতে পারি, শুধু রেগে গেলেই তিনি হেরে যান। নাহলে আর কোনভাবেই উনাকে দিয়ে ঢাকার আদিম, আসল, একান্ত-আপন নিজস্ব ভাষাটিতে কথা বলানো যায় না।

তাও হয়তো চলতো, দেখতে তো ডানাকাটা পরিটির মতো ছিল। কিন্তু চললো না কারণ উনার ওই এক বদঅভ্যাস! কাউকে ভাল লাগলেই তার গলা টিপে ধরেন। তারপর আর স্বকীয়তা বলে কিছু রাখতে দেন না। কথা একটাই, সারাদিন উনার সঙ্গে লেগে থাকতে হবে ধাওরা গাছের আঠার মতো। আর চোখ রাখতে হবে মাটির দিকে। কেননা মাথা উঠিয়ে সামনে তাকালে যদি চোখে অন্য কেউ পড়ে যায়!

আমি যতোই বলি, অন্য কেউ পড়লে চোখ কচলে বের করে দেবো- উনি শুনতে রাজি না। শেষমেষ তাই পুরান ঢাকার পাট অনেক রক্তক্ষরণের বিনিময়েও চুকিয়ে দিতে হয়েছিল। নিশি রাগারাগি, অভিমান, অনুনয়, ভয়-ভীতি প্রদর্শন সবই করেছিল। কিন্তু যখনই বলেছিলাম আমার কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি আমার গলা টিপে ধরে রাখতে পারবে না আর- তখন সে ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিল, আমরা দু'জন দুই দুনিয়ার মানুষ।

সেবার অচেনা একজন মানুষকে সিন্ধুপাড়ের বিদেশিনী বলে ডেকে যে বিড়ম্বনায় পড়েছিলাম এবং শিক্ষা আমি নিয়েছিলাম (নিশির কল্যাণেই- কেননা ভুয়া প্রোফাইলটা তো ওরই ছিল)- সে শিক্ষা ভোলা সহজ ছিল না বলেই, এবার অচেনা নাম্বারের "আমি তাকে চিনেছি কিনা?" প্রশ্নের জবাবে বলেছিলাম, না তো চিনতে পারছি না। কিংবা ঠিক কাছাকাছি কিছু একটা।

শুনে মেয়েটি বলেছিল, আমি মিসিসিপি, সিদ্ধার্থ। আমরা একসঙ্গে কলেজে গিয়েছিলাম। মনে পড়ে?

---

পোস্টটি ২ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!