ইউজার লগইন

গল্প: তুমি আমার কাছে তুমি যা বলবা তাই (পর্ব-২)

মিসিসিপি নামটা শুনে এক লহমায় অনেক কথা মনে পড়ে গেল। কিশোর বেলায় একটি বিশেষ-বাহিনী পরিচালিত কলেজে এক বছর পড়েছিলাম। সেই কলেজের নিয়ম-নীতির বাড়াবাড়ির সঙ্গে তাল মিলাতে পারি নি বলে, পরে আমায় অন্যত্র ভর্তি হতে হয়। তবে যে এক বছর ওখানে ছিলাম, সেখানেই দেখা হয়েছিল মিসিসিপির সাথে।

আমাদের ক্লাসের প্রতিটা ছেলে পছন্দ করতো ওকে। কলেজে ভর্তির প্রথম কয়েক সপ্তাহ ছেলেমহলে মেয়েটাকে নিয়ে খুব চর্চা হতে দেখতাম আমি চারিদিকে। ক্যান্টিনে বা কমনরুমে প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসছে মেয়েটার কোন একটা খবর নিয়ে। হয় ওর বাসার ঠিকানা, কিংবা কোথায় প্রাইভেট পড়ে কিংবা স্রেফ কোন একটা গুজব ওর সম্পর্কে- লেগে থাকতোই! একদিন একজন এসে জানাল, মিসিসিপির নাকি তার নিজের এলাকারই গুন্ডামতো একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। কথাটা শুনে মুষড়ে পড়লো অনেকেই। তাদের জন্য মায়াও হচ্ছিল আমার। তবে যে বিষয়ে আমার কোন হাত নেই, সে বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোও আমার বেশি একটা ধাতে নেই। হতাশ হওয়া বাদ দিয়ে কতকিছু করার আছে!

এই তো কলেজের সামনের বড় রাস্তা পেরিয়ে উল্টো দিকের মেঠোপথ ধরে কিছুদূর হাঁটলেই গ্রাম। মায়াভরা ধানক্ষেতেরা সবুজ রংয়ের একটা নিবিড় চাদর হয়ে যেন শুয়ে আছে মাটির ওপর। মাইলের পর মাইল জুড়ে। ধান কাটা হয়ে গেলে সেই দীর্ঘবিস্তৃত সবুজ চাদর হয়ে যায় ন্যাড়া-ক্ষেত। তাও তার সৌন্দর্য কোথাও একটুও কমে না! তখন দেখা যায়, হলদে মাটিতে সোনালী ধানের গোড়া মাথা তুলে রেখেছে একটু পর পর। আর মাঝে মাঝে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবিতার চরিত্রের মতো গ্রামীণ বালকেরা সেই ন্যাড়া মাঠে হাডুডু, ডাংগুলি কিংবা ফুটবল খেলছে।

গ্রামের মেঠোপথ ধরে সেই চষাক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আমি আরো দেখি, একটা শীর্ণ পানির ধারাও এগিয়ে চলছে পথের পাশ দিয়েই। কাছে-পিঠের কোন নদীর শুকনো একটা ধারা হয়তো বেরিয়ে এসে এই লম্বা মেঠোপথ আর ধানের জমিনগুলোর মধ্যে বিভাজন রেখা সৃষ্টি করেছে। আসলেই কি বিভাজন রেখা সৃষ্টি হয়েছে? কে জানে? আমার তো মনে হয় উল্টো।

আশপাশের সব গ্রামের মানুষের কত রকম চাহিদা মেটায় এই ছোট্ট চিকন জলের ধারাটি। কয়েক ফুট পরপরই দেখা যায় নানান রকম জাল বিছানো রয়েছে। তাতে দিনভর টাকি, পুঁটি, খলসে, মলা, ঢেলা, চেলা, বাঁশপাতা, কাঁচকি, বেলে, গুঁচি, চ্যাং, কই- কত রকমের মাছ যে ধরা পড়ছে!

আবার এ জলধারা থেকে জল নিয়ে সেচ দেয়া হচ্ছে পাশের জমিগুলোতে। তাই দিয়ে ফলছে ফসল। তাছাড়া ওই জলাধার নানাবিধ জলজ প্রাণেরও আধার। নানা রকমের মাছতো আছেই; ব্যাং, জলজ উদ্ভিদ, শ্যাঁওলা, প্ল্যাঙ্কটন-ও রয়েছে ভুড়ি ভুড়ি। সবাই মিলে ওদের একটা নিজস্ব খাদ্যচক্র তৈরি হয়েছে। মাথার ভেতর প্রশ্নটা ওই জন্যই এসেছিল, যে জলে মানুষ আর প্রকৃতির এত কাজ হয়, সে কি আসলেই বিভাজন সৃষ্টি করে?

আসলে আমার ভাবনার রোগ আছে। ছেলেবেলা থেকে আমি দৃশ্যকল্প ভাবতে ভালবাসি। এই রোগের উৎপত্তি ঘটেছিল আমার প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের একটা লেখা থেকে। লেখাটার নাম আজ আর মনে নেই। হুমায়ুন আহমেদ কোন একটা কনটেক্সট-এ লিখেছিলেন, 'লেখার জন্য লেখকের বিশ্বভ্রমণ জরুরি নয়। কল্পনাই যথেষ্ট।' একদম উনার শব্দে শব্দে কথাটা আমার আর মনে নেই। কিন্তু যা লিখেছিলেন তার সারবস্তু হিসেবে অতোটুকু মনের ভেতর রয়ে গেছে আজও।

লেখাটা যখন আমি পড়েছিলাম তখন কতইবা আর বয়স ছিল? ১২ বা ১৩ হবে হয়তো! লেখাটা পড়ার পর থেকে আমি সুযোগ পেলেই মনে মনে বিভিন্নরকম কল্পনার রাজ্যে ঘুরতে চলে যেতাম। বাস্তবে হয়তো ক্লাসেই বসে আছি, কিংবা কলেজের সামনে বড় রাস্তাটা পেরিয়ে ঢুকেছি উল্টোদিকের গ্রামীন জনপদে। আর কল্পনায় হয়তো ক্লাসশিক্ষকের লেকচারের ভেতরে কিংবা গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কত যে অলীক কল্পনার রাজ্যে আমি ফড়িং-এর মতো মনে মনে নেচে বেড়াচ্ছি- তার আজ আর কোন ইয়ত্তা নেই।

তবে সবসময় কল্পনাই যে আমার চলার পথের সঙ্গী হতো এমন নয়। মাঝে মাঝে অবাক করে বাস্তব জীবনের মানুষেরাও সঙ্গী হয়ে পড়তো। এই যেমন, একবার কলেজের সামনের বড় রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকের মেঠোপথে কিছুদূর হাঁটতেই দেখি মিসিসিপি একা বসে আছে পথের ধারে। মাথাটা নিচু। দুর থেকে দেখে ওকে কোন কারণে ব্যাথিত লাগছে।

আমার ভাবনার রোগের পাশাপাশি আরও একটি বিশেষ রোগ রয়েছে, তাও আবার সেই ছেলেবেলা থেকেই। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় লাগে। স্কুলের সমবয়সীদের সাথে, পাড়ার ছোট-বড়দের সাথে, কিংবা কোচিং-এ আসা সুন্দরী ক্লাসমেটের সাথে; কারো সাথেই আমি সহজ হতে পারি না।

মিসিসিপিকে দেখেও অবধারিতভাবে সেই একই সংকট জন্ম নিলো। আমি ওকে প্রায় ৩০-৪০ মিটার দূর থেকেই চিনে ফেললাম এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাস্তার যে পাশে ও বসে ছিল, তার উল্টোপাশে চলে গেলাম। হাঁটার গতিও কমে গেল, যাতে কোন শব্দ না হয়। ওর পেছন দিয়ে যখন পার হয়ে যাচ্ছিলাম, তখন প্রায় বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে পার হচ্ছিলাম আর মনে মনে খুব নিজেকে নিয়ে হাসছিলাম, রে সীমিতক্ষমতার মন্দবুদ্ধি মানবসন্তান, তোকে তো সে চেনেও না! এভাবে না গিয়ে যদি হল্লা করতে করতে এখান দিয়ে যাস, তাও ওর ভ্রুক্ষেপ হবে না।

যদিও নিজেকে আমি ওসব বলছিলাম, তথাপি কোনমতেই সাবধানী হাঁটা বন্ধ করতে পার‍ছিলাম না। এরমধ্যেই হুট করে মিসিসিপি আমাকে ডাক দিয়ে বসেছিল, এই ছেলে! এই সিদ্ধার্থ! কই যাও?

প্রিয় পাঠক, মাঝে মাঝে একটা-দুইটা হৃৎকম্পন আমাদের সবারই মিস্ হয়ে যায়, অনেক কারণে। আমি যেমন চমকে গেলে, ভয় পেলে, হঠাৎ খুব আনন্দের মুখোমুখি হয়ে গেলে কিংবা কোন কারণে মঞ্চে ভাষণ দিতে উঠলে- এমনটা অনুভব করি। সেদিন মিসিসিপির মুখে আমার নামটা শুনে হৃৎকম্পন প্রায় মিনিটখানেকের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার। অবাক হয়ে শুধু একটা কথাই ভাবতে পারছিলাম, মেয়েটি আমার নাম জানে!

মাথার ভেতরের সবক'টি নিউরণ সেসময় তাদের নৈমিত্তিক প্রতি মুহূর্তের কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। গালে হাত দিয়ে মিসিসিপির দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ।

সম্বিত ফিরলো সেই মিসিসিপির ধমক খেয়েই। আমাকে ওভাবে স্থানুর মতো অচল দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তি বোধ করে থাকবে হয়তো। তাই খানিকটা অধৈর্য হয়েই আবার আমায় ডাক দিলো সে, অ্যাই সিদ্ধার্থ, কি হয়েছে তোমার?

এবার আমি ধড়মড় করে ঘুম ভেঙ্গে খাটে উঠে বসলাম। কী ভীষণ জীবন্ত আর রঙিন একটা স্বপ্ন দেখলাম! আহা কি আনন্দ এমন একটা স্বপ্ন দেখতে পারার!

সেদিন আমি মনে মনে ঠিক করলাম, মিসিসিপি'কে গিয়ে নিজের নামটা বলে আসবো। পরিচিত হয়ে নেবো ওর সাথে। শহর থেকে একটু বাইরে অবস্থিত ছিল আমাদের কলেজটা। কলেজের বাসেই যেতে হতো আমাদেরকে। নিয়ম-কানুনের কড়াকড়িটা একটু বেশিই ছিল ওখানে। যে কারণে আমার সঙ্গে কলেজের শিক্ষকদের বনিবনা ছিল না খুব একটা। তারপরও ভেবেছিলাম, দুই বছরই তো। চোখের পলকে পার হয়ে যাবে।

তবে সেদিন কলেজে গিয়ে আমি মিসিসিপি'কে খুঁজে বের করার আগে, কলেজের দপ্তরী কাকা আমাকে খুঁজে বের করে। জানায়, প্রিন্সিপাল স্যার দেখা করতে বলেছে। ওই কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারটি শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পেলেই, তাকে দেখা করতে ডাকতেন। আমি তাই খানিকটা শঙ্কা মনে নিয়েই তার কক্ষে গেলাম। কেননা অনেক কিছুই অভিযোগ করা সম্ভব আমার বিরুদ্ধে। কে যে কোনটা করেছে, সেটাই তো জানা নেই। দেখা যাক কি হয়। এসব ভাবতে ভাবেত সেদিন প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকেছিলাম আমি। আর যখন বের হয়েছিলাম, তখন আমার হাতে ধরা ছিল একটা টিসি'র কাগজ। টিসি মানে হলো ট্রান্সফার সার্টিফিকেট, যা সাধারণত কোন শিক্ষার্থীকে প্রতিষ্ঠান থেকে শাস্তিমূলকভাবে বের করে দেয়ার সময় দেয়া হয়।

আমাকে ওই কলেজ থেকে টিসি দেয়া হয়েছিল সেই স্বপ্ন দেখার দিনটিতে।

---

(চলবে)

পোস্টটি ২ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!