ফাগুন আসার আগে
শাম্মী আমার ছোট বোন ।মাত্র দু’দিন আগেও যে ছিল রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর। প্রায় সাত বছর পর অনেক কষ্টে আসিফের কথাটা বাবাকে জানিয়েছে এবং সম্মতি আদায় করে নিয়েছিল।গত বছর নভেম্বর মাসে ওদের পান-চিনি হয়েছিল।আর আসছে ফাল্গুনে ওদের বিয়ের দিন ঠিক করেছিল।ওরা দু’জনেই প্রতিদিন অফিস শেষে বিয়ের কেনা কাটা করতে বের হতো।যতক্ষণেই বাসায় ফিরত না কেন শাম্মী রোজ আমার বাসায় এসে কেনাকাটার গল্প করত। শুধু এখন না,আসিফের সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর যেদিন আমাকে প্রথম বলল, সেদিন সব গল্পের সাথে আরো বলল,আপা তোকে বলার পর মনে হচ্ছে বুক থেকে একটা পাষাণ ভাব নেমে গেল।কারণ বাবাকে ম্যানেজ করা এখন তোর কাজ।
বিয়ের কার্ড ছাপাতে দেয়া হয়ে গেছে। বিয়ের ক্লাব বুকিং হয়ে গেছে। কেনাকাটাও প্রায় শেষের দিকে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হঠাৎ করে যে এমন ভয়াবহ হয়ে যাবে আমরা কেউ ভাবতেও পারিনি। শাম্মী শুধু মন খারাপ করে বলত,বুঝলি আপা ,আমার সব কিছুতেই বাঁধা । কোনো কিছু সহজে হয় না।দেখ না, দেশের পরিস্থিতিটা হঠাৎ করে এমন খারাপ হওয়ার কি দরকার ছিল।আমি সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম,টেনশন করিস না,এখনো তো সময় আছে,দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। আর দেশের পরিস্থিতি তো কারো একার জন্য না,সবার জন্যই এখন দুঃসময়।
গত পরশু দিন আসিফের বিয়ের শেরওয়ানীর অর্ডার দেয়ার কথা ছিল।কিন্তু আসিফের অফিসে হঠাৎ একটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়াতে আসিফ আর বের হতে পারে নি ।শাম্মী অফিস শেষে বাসায় ফিরে আমার বাসায় এসে গল্প করছিল আর টিভি দেখছিল।এমন সময় শাম্মীর মোবাইল বেজে উঠল।
আমরা যখন হাসপাতালে্র বার্ণ ইউনিটে পৌঁছালাম আসিফের এক সহকর্মী এসে জানালো ওদের গাড়িতে পেট্রোল বোমা মেরেছে। বার্ণ ইউনিটে রোগীদের যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ আর বার্ণ ইউনিটের বাইরে রোগীর স্বজনদের আহাজারিতে এমন এক কঠিন অবস্থা তৈরি হয়েছে যে কে কাকে কি বলছে,কেন বলছে অনেক দরকারি কথাও বোঝা যাচ্ছিল না ।আসিফের মা ছেলেকে দেখতে এসে নিজেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।আসিফের অবস্থা আশংকাজনক।ওর শরীরের ৭০শতাংশই আগুণে পুড়ে গেছে।
শাম্মীর দিকে তাকানোর সাহস আমার হচ্ছিল না।আমার বোনটার মনের মধ্যে তখন কি ঝড় চলছিল সেটা বোঝার ক্ষমতা আমার নাই। আমার শুধু মনে হচ্ছিল এতদিন এত দুঃখ-কষ্টের পর আমার বোনটা যখন নতুন জীবনের রঙ্গিন স্বপ্নে বিভোর তখন হঠাৎ করে কি অপরাধে তার স্বপ্নের এমন অপমৃত্যু,তার জীবনটা কেন এমন খন্ডিত-বিখন্ডিত। কি দোষ ছিল আসিফ নামের এই শান্ত,ভদ্র,নিরীহ ছেলেটির?কেন তাঁকে জীবন্ত পুড়তে হলো । আসিফের ব্যান্ডেজ করা ডান হাতটা দূর থেকে দেখে আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি এটা একটা মানুষের হাত। আমার মনে হয়েছিল ছোট সাইজের একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আগুনে পুড়ে সারা শরীর এত ফুলেছে যে একটা হাত মনে হচ্ছিল একটা মানুষ।
আমার মনে আছে অনেক আগে একবার ভাতের মাড় গালতে গিয়ে মাড় পড়ে হাত পুড়ে গিয়েছিল।ফোসকা পড়ে হাত ফুলে গিয়েছিল।সেই পোড়া সামলাতেই কি কষ্ট করতে হয়েছিল। এখনো ভাতের মাড় গালতে গেলে আমি ভয় পাই। আর এখানে আস্ত এক একটা মানুষকে পুড়িয়ে কাবাব বানানো হচ্ছে,কি অদ্ভুত!!
ছোট বেলায় কোনো কারণে আমরা ভাই-বোনরা মারামারি করলে বাবা এসে বলতেন,মারামারি,ঝগড়া-ঝাটি করে কখনো সমাধান হবে? হবে না । কিন্তু ভালোবাসায় সব হবে।ভালোবাসায় সব হয়।
আমাদের দেশের এই ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের সময় আমার মনে হচ্ছে বাবার কথাটা খুব একটা ঠিক কথা না ।কারণ এই দেশটার জন্য এই দেশের মানুষের ভালোবাসা সীমাহীন।কিন্তু তারপরও কি হচ্ছে এসব? প্রতিদিনই পুড়ছে মানুষ।পুড়ছে দেশ।পুড়ছে মানবতা।সমাধান কোথায়? এই দেশটার জন্য মানুষের এত ভালোবাসার নমুনা কি এভাবে জীবন্ত কয়লা হওয়া?ভালোবাসায় যদি সব হয় তাহলে আমার বোনের ভালোবাসা এভাবে চোখের সামনে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে কেন?আমার বোনতো শুধুই একটা ভালোবাসার ছোট্ট ঘরের স্বপ্ন দেখেছিল।
লিখতে চেয়েছিলাম ভালোবাসার গল্প।কিন্তু জীবন থেকে যখন কোনো কারণ ছাড়া জীবনই হারিয়ে যায়,ভালোবাসার গল্প সে জীবনের যন্ত্রণা কখনো কি থামায়?ফাগুন আসার আগেই যেন থেমে যায় এই আগুন উৎসব এই প্রার্থনা আজ।
ভালোবাসায় বাঁচুক মানুষ, বাঁচুক আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আর বাঁচুক আমাদের ভেতরের মনুষ্যত্ব বোধ।
খুব কষ্ট লাগলো জেনে। সব শুভ হোক, মংগল হোক। আসিফ আর শাম্মীর জন্যে অনেক অনেক শুভ কামনা থাকলো।
আর জংলীদের ব্রেইন পরিস্কার হোক নইলে তাদের মা-ভাই পুড়ে মরুক
জংলীদের ব্রেইন পরিষ্কার হইলে তো আর কোনো দুঃখই ছিল না।
কিংবা তাদের মা-ভাই পুড়ে মরলে তো হতোই, কিন্তু সেটা তো হবার নয়, আর তাই এভাবে প্রতিদিন পুড়ে অংগার হবে আমাদের স্বপ্নগুলো......
আমাদের স্বপ্নগুলো রাজনৈতিক বলি হচ্ছে
আমরা কিছু করতে পারি না কেন ???????????????
মন্তব্য করুন