ইউজার লগইন

খেয়াতরী খেলাঘর

কিভাবে যেন ঠিক ঠিক চলে গেলাম। খুব সম্ভবত বান্ধবী সোনামনি, জান্নাত আর বেবির কাছ থেকেই খবর পেয়েছিলাম। রোদের তেজ তখন অনেকটাই মরে এসেছিল। পাঠানটুলী বালিকা বিদ্যালয়ে হতো রিহার্সেল। তখন কি প্রোগ্রাম ছিল সেটা আর মনে করতে পারছি না। প্রথম দিনের কয়েকটি গান -আমি শিখছি পড়া, এদেশ গড়া, ধিতাং ধিতাং বলে, সূর্য মোদের মাথার উপরে বাতাস সদায় দেয় দোলা, আনন্দ মেলা এই আনন্দ মেলা...আরো অনেক গান ছিল, কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
বিষয়টা আমার কাছে খুব অদ্ভুত ভালো লেগেছিল। আশ্চর্য কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো জিজ্ঞাসা নেই। ইচ্ছে হলেই সুরে বেসুরে চিৎকার করে গান করতে পারছি। আর আসল শিল্পীদের কন্ঠের যাদুতে আমার এবং আমার মতো অন্যদের সেই বেসুরো গান কেমন করে যেন ঠিকই তাল মিলিয়ে নিচ্ছিল।
রিপন ভাই, অপু ভাই, মুক্তি আপা, ময়না আপা, প্রীতি আপা সহ আরো বেশ কজন ছিলেন, যারা পুরো বিষয়টা তদারকি করতেন। হারমোনিয়াম আর তবলার সংমিশ্রণে গানের এমন মন মাতানো ঢেঊ সেই প্রথম আমার মনেও দোলা দিয়েছিল দারূণভাবে।
বিকাল বেলা মিলি আপার কাছে পড়তে যেতাম। সে ক’দিন রোজ দেরি হয়ে যেত। একদিন, দু’দিন এরপর তিনদিনের দিন মিলি আপা হুংকার দিয়ে উঠল। সামনে বার্ষিক পরীক্ষা, বৃত্তি পরীক্ষা। আর তিনি যাচ্ছেন এখন নাচ গান করতে। শুনে মনটা একটু খারাপ হয়েছিল বটে। কিন্তু কথায় কথায় মন খারাপ ভাবকে তো আর পাত্তা দিলে চলে না। তাই এরপরও আমি নিয়মিত যেতাম খেয়াতরী খেলাঘর আসরে।
আমার চেয়ে বড়, ছোট আবার আমারই সমবয়সী অনেকেই আসত। এখন আর সেভাবে কারো নাম মনে করতে পারছি না। পারবই বা কি করে আমার সেই ভালোবাসার সুতা যে অনেক আগেই কেটে গেছে।
কি এক দুর্বার আকর্ষন কাজ করত মনের মধ্যে! স্কুলের শেষ ঘন্টাটা বেজে উঠলে মনের ভেতরটাতে ময়ূর নেচে উঠত। আর ঢং ঢং করে যখন ছুটির ঘন্টা বাজত মনে হতো কে যেন অনেক দূর থেকে ডাকছে -আয় ছুটে সকলে এই মাটির ধরা তলে....।সেই মাটির ধরা আজও কেমন স্বপ্নীল হয়ে আছে আমার মনের মধ্যে। কারণ সেই নরম রোদের আলোর বিকাল গুলোই তো আমার অজান্তে আমার মনেই এক অব্যক্ত ভালোবাসার ঠাসবুনোট বেঁধেছিল।
খেয়াতরী খেলাঘরই তো ছিল নাম!
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার শেষে খুব সম্ভবত বিজয় দিবসের কোনো অনুষ্ঠান ছিল। টানা রিহার্সেল হতো। আমিও সব উপেক্ষা করে ছুটে যেতাম। তখনও তো আমার দুটি ডানা ছিল। আমি পাখির মতো উড়তাম।
খেলাঘরের আবার ড্রেসও ছিল। সাদা জামা। কালো বেল্ট। আমার স্কুলের ড্রেস ছিল সাদা। আর বড় ভাই সুমনের একটা কালো বেল্ট ছিল। ব্যস দারুণ সমাধান। আমাকে আর থামায় কে?
যেদিন অনুষ্ঠান , সেদিন বিকাল থেকেই আমি তৈরি। অনুষ্ঠান স্থলে গিয়ে দেখি কি সুন্দর করে একটা মঞ্চ সাজানো হয়েছে! কিছুক্ষণ পর দেখি রিপন ভাই হাতের মধ্যে একটা কাগজ নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। তারপর একটা সময় বুবলি(বুবলির বড় বোনের নাম ছিল খুব সম্ভবত কান্তা) নামের একটা মেয়েকে বারবার তাগাদা দিচ্ছিল ওনার হাতে থাকা কাগজটা একটু দেখে দেখে রিডিং পড়তে। ও কিছুতেই টানা রিডিং পড়তে পারছিল না। একটু পর পর থেমে যাচ্ছিল। একটু দূর থেকেই বিষয়টা আমি খেয়াল করলাম। এরপর রিপন ভাইয়ার কাছে গিয়ে বললাম, ভাইয়া আমি পড়ি?
রিপন ভাই কিছুটা ইতস্ত করে বললেন, পারবে তুমি? (ওনার তাকানোর ভাবটা যেন ছিল হাতি ঘোড়া গেল তল, পিঁপড়ায় বলে কত জল!!)
খুব সাহস করেই বললাম, কেন পারব না? তখনও ভয় নামক অসুখটা আমাকে কাবু করতে পারেনি।তখনও আমার ডানা ছিল। আমি ছিলাম মুক্ত পাখি।সারাদিন টই টই করতে আমার ভয়ও লাগত না , বিরক্তিও লাগত না।
তারপর কাগজটা হাতে নিয়ে রিডিং পড়ে শোনালাম।রিপন ভাইয়া একটু আশ্বস্ত হয়ে প্রীতি আপুর কাছে আমাকে নিয়ে বলল, ওকে একটু দেখো। উদ্বোধনী বক্তৃতাটা ওই দিবে।
প্রীতি আপুও যথারীতি অবাক হলো। তারপর বলল, পড়।
আমি পড়লাম।
প্রীতি আপু বলল, সবার শেষে কি বলবে?
আমি শেষ লাইনটা আবার পড়লাম।
প্রীতি আপু বলল, আরে শেষ লাইন তো বলবেই। সব শেষে বলবে ধন্যবাদ।
আমি বললাম, জ্বি, ধইন্যবাদ।
প্রীতি আপু একটা ধমক দিয়ে বলল, ধইন্যবাদ না , বলো ধন্যবাদ।
আমি বললাম ধন্যবাদ।সেদিন আমি ধন্যবাদ বলা শিখেছি। হা হা হা।
সেদিনের অনুষ্ঠানে প্রথম আমি ডায়াসে দাঁড়িয়ে একটা অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তব্য পাঠ করেছিলাম কোনো রকম জড়তা ছাড়াই। (এত বছর পর এখন ভাবতেই কেমন জড়সড় হয়ে পড়ছি!!)

এরপর আরো একটা অনুষ্ঠান পেয়েছিলাম খেলাঘরের। দু’দিন ব্যাপী জমকালো অনুষ্ঠান। আমি প্রথম মঞ্চ নাটক দেখেছি খেলাঘরের সেই অনুষ্ঠানে।
তারপর ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম আগ্রাবাদ স্কুলে। মর্নিং শিফটের স্কুল ছিল। বিকাল বেলা বাসায় প্রাইভেট টিচার আসত। আমার খেলাঘরে যাওয়ার সময় হয় না। একদিন অপু ভাই আর রিপন ভাই বাসায় এসে আব্বাকে বললেন, ও যদি নিয়মিত খেলাঘর করত ভালো হতো।
আব্বা বিকাল বেলা প্রাইভেট পড়ার প্রতিই বেশি গুরুত্ব দিলেন। হয়তো সব বাবা-মাই তাই করতেন।
তবে আজ এবেলায় এসে প্রায় ২৫ বছর আগের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে সেদিন যদি আমার খেলাঘরে যাওয়া বন্ধ না হতো হয়তো আমার স্বপ্নগুলো অন্যরকম হতো। হয়তো ইনসমনিয়া আমাকে কখনোই আক্রান্ত করতে পারত না। হয়তো ভয় নামক অসুখটা আমার মধ্যে এত তীব্রভাবে বাসা বাঁধতে পারত না। হয়তো আমার পাখির মতো ডানা গুলো আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত না।হয়তো গুমরে গুমরে কেঁদে কেঁদে আমার একটা সম্পূর্ণ কৈশোর পাথর চাপায় নিষ্পেষিত হয়ে যেত না। হয়তো......।
কি জানি হয়তো নাও হতে পারত.......................

পোস্টটি ১৮ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


সুন্দর লেখাগুলা শেষে এসে মন খারাপ করে দিলে কেমন জানি অসহায় লাগে। Sad

মোহছেনা ঝর্ণা's picture


মন খারাপ করেছেন মানে আপনি এই লেখার অনুভব টুকু অনুভব করেছেন।
সেজন্য কৃতজ্ঞতা।
ভালো থাকবেন। Smile

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মোহছেনা ঝর্ণা's picture

নিজের সম্পর্কে

আমি খুব সাধারণ একজন।জীবন নিয়ে আমার তেমন কোনো অতৃপ্তি নেই।সেদিক দিয়ে সুখী মানুষ আমাকে বলা যায়। জীবনে আমি যা চেয়ছি ,তাই পেয়েছি।তীব্রভাবে চেয়েছিলাম ভালোবাসার মানুষটিকে।সৃষ্টিকর্তা যেদিন সত্যি তাকে শুধুই আমার করে দিয়েছে সেদিন আমি রবীন্দ্রনাথের মতোই মনে মনে বলেছিলাম,আমি পাইলাম,ইহাকে আমি পাইলাম।'বন্ধু ' শব্দটি ভীষণ প্রিয় আমার।আছে কিছু প্রাণের বন্ধুও।বই পড়তে ভালো লাগে।বেড়াতে ভালো লাগে।মাঝে মাঝে মনে হয় যদি ইবনে বতুতার মতো পর্যটক হতে পারতাম! লেখালেখির প্রতি বেশ দুর্বলতা আমার।লিখিও প্রচুর।যা মনে আসে।ওগুলো আদৌ লেখা হয়ে উঠে কি না ,তা আমি জানি না। আমি যখন লিখি নিজেকে আমার মুক্ত মানুষ মনে হয়।আমার মনে হয় আমার একটা উদার আকাশ আছে।লেখালেখিটা হচ্ছে সেই উদার আকাশে নিজের ইচ্ছে মতো ডানা মেলে উড়ে যাওয়া।উড়ে যাওয়া।এবং উড়ে যাওয়া।