ইউজার লগইন

নানা আর নানা'র নাতি

লিখছি। আর ব্যাকস্পেসে মুছে নিচ্ছি। আবার লিখছি। আবার মুছে নিচ্ছি।

আগেই ভাল ছিল হয়ত- কাগজে, কলমে লেখা। একবার লিখে ফেললে মুছে ফেলার উপায় বড় কম, অত কষ্ট করতেও বিরক্ত লাগে। কাটাকুটি ভাল লাগে না দেখতে, আর রবীন্দ্রনাথের কাটাকুটির কারুকার্য তো আর সবার জন্য না। কাজেই কাটাকুটি না করাই শ্রেয় লাগত সে সময়টায়।

২০০২/০৩। কলেজে পড়ি। কী হল হঠাৎ, মনে হল লিখতে হবে। লিখতে হলে জানতে হবে, বুঝতে হবে, প্রকাশভঙ্গি নিয়ে ভাবতে হবে এরপর লিখে প্রকাশ করতে হবে, সেও নিজে বার বার বার বার পড়ে তার পর আরো ঠিকঠাক করতে হবে- অত কিছু বোঝার বোধ হয়নি বোধ হয় তখনো- আমি তখন অনেএএএক বুঝি!

লিখি। নানার মত করে আলগা কাগজে, ভাঁজ করে। শিরোনাম দেয়া হয় না। নাম লেখা হয় না লজ্জায়। সেটা নিয়ে নানা'র কাছে যাই। হাতে দিই না। নানার বসার টেবিলের বাঁদিকে দুটো ড্রয়ার। উপরেরটায় চাবি দেয়া। নীচেরটায় চাবি ছাড়া। উপরের ড্রয়ারের চাবি রাখার নীচের ড্রয়ারের ডানদিকের মাঝামাঝি জায়গায়- সবার উপরে রুমালে কিছু চকলেট, বিস্কিট বা কিছু একটা খাবার জিনিস, তার নীচে নানার কিস্তি টুপি, তার নীচে তাঁর ডায়েরি, তার নীচে আসা-যাওয়া চিঠির খাম, তার ও নীচে সিল, কলম, পঞ্চাশ পয়সা এক টাকা দুটাকার কয়েন, আর হরেক রকমের চাবি। চাবি ধরার দরকার পড়ে না, আলগোছে রেখে দেই সবচেয়ে উপরে। নানা নিজেই দেখে নেবেন।

দেখেন নানা। সন্ধ্যায় নানার সাথে দেখা হলে বলেন - "সুন্দর হইছে নানা! নানুকে দেখাইছ?" না - সূচক মাথা নাড়ানো দেখে বলেন, "নানুকে দাও গিয়ে! নানু যদি বলে ভাল তাইলে ভাল!" নানু পড়েন। পড়ে হাসেন। বলেন ভাল হইছে! নানা যত্ন করে নাম লিখে দেন উপরে। শিরোনাম দিয়ে নীচে লাল হরফে, বড় বড় করে। প্রত্যেকটা আলাদা।

এই হাসিটা দেখার লোভ সামলানো যায় না। আরো দেই। আরো হাসি দেখি! কালো রঙের কার্বন ফ্রেমের চশমা চোখে কানে হিয়ারিং এইডের শব্দ- মান ঠিক করতে করতে নানা লেখার দিকে তাকান- "লেখায় কাটাকুটি নাই কোন! কী সুন্দর! তোমার কাটতে হয় না কিছু- আমার কত কাটতে হয়!" আমি আরো খুশি হই।

ব্লগ আর ফেসবুকে লেখার যুগ নানা দেখেননি- ব্যাকস্পেস দেই আর মনে হয় "নানার নাতি" সেই মুগ্ধতার যোগ্য নেই আর!

নানার সাথে লিখে কথা হত। প্যাডে, ডাইরিতে। একথা, ওকথা। লিখতাম, নানা পড়তেন। প্রশ্ন করতেন, তার জবাবে আবার লিখতে হত। আমার সাথে না কেবল, সবার সাথেই।

ঢাকা থেকে যাই দুই-তিন সপ্তাহ পরপর। একবার গিয়ে আরেকবার না দেখা হওয়া পর্যন্ত নানা কেবল আম্মুকে প্রশ্ন করেন- "মর্ম আসছে?" আম্মু বলে- "না আব্বা! ও তো ঢাকায়!" নানা আবার জিজ্ঞেস করেন- "কবে আসবে?" আম্মু বলেন- "মাত্র তো গেল, আসবে আবার!"

আসলেই আমাদের কথা হয়। কত কিছু নিয়ে নানার জিজ্ঞাসা। কী হচ্ছে? কার সাথে দেখা হচ্ছে? নানার কথা কেউ জিজ্ঞেস করেছে কী না? কেউ চিঠি লিখেছে কি না! কাকে কাকে চিনি? কোথায় যাই? কী করি? কবে পরীক্ষা? বাসার কার কী খবর? - কানে-লিখে কথা হয় আমার আর নানার। বিকালে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার সময় নানা দরোজার দিকে তাকান- ফিরে এলে বন্ধুর পাড়ার মানুষজনের ফিরিস্তি নেন। চেনাজানাদের খবর নেয়ার চেষ্টা করেন। মাথার বালিশের পাশের বিস্কুটের কৌটা এগিয়ে দেন- "খাও খাও!"

২০০৮ সালের নভেম্বরের শেষ বা তার আগের সপ্তাহ। নানার শরীর খারাপ খুব। আমি গেছি। মেজো মামাও গেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া। নতুন চাকরিতে ঢুকেছি, দশ দিন হয়েছে মোটে। বোনাস পেয়েছি ঈদের। জীবনের পয়লা রোজগার। বাসার জন্য ছানামুখী, গুড়ের সন্দেশ নিয়েছি। অসম্ভব খুশি হলেন নানা। "তুমি আমাদেরকে খাওয়াইছো নানা, আমি সুস্থ হয়ে নেই- তোমাকে খাওয়াবো আমি!"

অফিস খোলা। পরেরদিন চলে আসার পালা। একে একে বেরিয়ে আসছি। মামা বিদায় নিলেন- শুয়ে ছিলেন নানা- আমি হাত রাখলাম বুকে- হাত রাখলেন হাতে- কানের কাছে মুখ নিয়ে জানালাম- "নানা, আসি!" ঘোলা চোখে তাকালেন- "তুমিও চলে যাবা!"

এর পরের সপ্তাহে জরুরি ফোন পেয়ে যখন ফিরি- নানা আর আমার দিকে তাকাননি। কারো দিকেই না। নানার সাথে আর কথা হয় নি।

নানা নাকি সবাইকে বলতেন- "মর্মকে আমার সব কথা বলে গেছি- সব কথা!" সব ছাপিয়ে আমার কেবল মনে হয়- "তুমিও চলে যাবা!"

নানা চলে গেছেন দশ বছর হল আজকে। ব্যস্ত এ জীবনে মনে তো পড়ে না কিছু, মাঝে মাঝে কেবল একটা-দুটো 'উছিলা' আসে- আর ভেসে যেতে হয়।

নানার স্মারকগ্রন্থ হাতে পেয়ে আজকে ভাসতে হল- নানার স্মৃতিকে মলাটে বাঁধার ব্যবস্থা করেছেন মেজো খালু প্রফেসর আশরাফুল ইসলাম, অসুস্থ শরীরে অনেক খাটাখাটনি করে।

নানা যখন একেবারেই শেষবেলায়- নিজের বই দিয়ে গেছেন পরিবার-বন্ধু- স্বজনদের- ওখানে লিখে গিয়েছেন- "আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকব না!"

আছেন নানা। কথাসাহিত্যিক মিন্নাত আলী। তাঁর মফস্বল সংবাদ, যাদুঘর, চেনা ও জানা, আমার প্রথম প্রেম, সাহিত্যিকের পত্রালাপ, রক্তের ঋণ, কাফনের লেখা, মেঘনা, আমার হজ্জ্ব পালনঃ স্বপ্নভংগ, আমি দালাল বলছি আর না বলা কথা'য়।

আর আছেন চেনা ও জানা, অচেনা ও অজানা অসংখ্য স্মৃতিতে।

নানাকে আল্লাহ জান্নাতের অপার শান্তি দিন। আমাদের দুঃখ, কষ্ট, অন্যায়, অপরাধের দায় যেন কখনো তাঁকে না ছোঁয়, আমাদের আনন্দের খবর ভালো'র খবর যেন তাঁর কাছে পৌঁছায় বিশেষ বার্তা হয়ে।

47571302_10217740182955073_4392670861316849664_n.jpg

পোস্টটি ১৩ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মর্ম's picture

নিজের সম্পর্কে

লেখালেখি করাটা একটা বড় ধরণের ব্যামো। কথা যখন অনেক জমে যায়, মাথার ভেতরে কুটকুট করতে থাকে ওগুলো। কী করি কী করি করে শেষ পর্যন্ত কী-বোর্ড টেনে বসতে হয়। ভাল হয় না কি মন্দ হয় সে তো পরের কথা, কিন্তু অশান্তি কমে, পেটও আর ভুটভাট করে না।

১২-১২-১২ তে উল্লেখ করার মত কিছু করা হয়নি, এমনকি এমন তারিখগুলোয় গত দশ বছরের অভ্যাস মেনে বই কেনার সময়টুকুও মেলেনি।

এখানে মাঝে মাঝে লেখা হবে হয়ত, ১২-১২-১২ তে এর সূচনা হোক!

তথ্যযোগঃ

সচলায়তন দিয়ে অনলাইন লেখালেখি শুরু হয় আমার, ২০১০-এ। নাই নাই করে সেখানেও কিছু লেখা জমা হয়ে আছে। অতি আগ্রহী পাঠক কেউ থাকলে ওখানেও ঘুরে আসার আমন্ত্রন জানিয়ে রাখি।

http://www.sachalayatan.com/mormo