শিখিয়ে কথন - পর্ব ১
[প্রাক-কথনঃ
বন্ধু Reajul Alam Chowdhury'র সাথে কথা হচ্ছিল 'অভিজ্ঞতা' নিয়ে। তার মতামত হল, শুধু 'অভিজ্ঞতা' অর্জন করলেই হয় না, কখনো কখনো একটু দূর থেকে চড়ে-আসা-সময়ে নজর দেয়াটাও জরুরি, তাতে অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার আরো ঋদ্ধ হয়।
সময় মিলেছে এখন, কাজেই করছি সে কাজ। নিজের এবং আরো অনেকের কর্মযজ্ঞ মনে করছি, কী-হলে-কী-হতে-পারত'র হিসাব নিকাশ করার চেষ্টা করছি- ক্রিকেটের "হক-আই" পদ্ধতিতে! যা হয় তা তো হয়ই, সে 'হয়ে যাওয়া'টুকু থেকে 'শেখা'র কিছু আছে কি না সেটা দেখতে পাওয়াটাও 'অভিজ্ঞতা' বৈকি!
পেশাজীবনে প্রায় চার হাজার দিন কেটে গেছে, 'শেখা' কিছু কম হয়নি। ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়, চেষ্টায়, শেষটায় কিছু না কিছু শেখা তো হয়েইছে কারো না কারো হাত ধরে; কখনো আলাদা করে বলা হয়নি, করা হয়নি সে গল্প। জানানো হয়নি কৃতজ্ঞতা। কেউ হয়ত জানেনও না যে তিনি শ্রদ্ধাভাজন হয়ে আছেন, কিছু একটা শিখিয়ে।
এবার সেই গল্পগুলোই বলার চেষ্টা করব, 'সিন্ধু' হবে কি না বলা মুশকিল, তবে 'বিন্দু' দিয়ে শুরু করি।
পেশাজীবনের কথাই হচ্ছে যখন, তার শুরু দিয়েই গল্প শুরু হোক।
প্রথম পর্বে যাঁর কথা বলব তিনি শামসুল আলম স্যার। আমাদের খুব পরিচিত এস এ স্যার। রহিমআফরোজ আইপিএস আক্ষরিক অর্থেই দাঁড়িয়েছিল এ মানুষটার ঘাড়ে করে, প্রায়ই গল্প শুনতাম, সেই নব্বইয়ের দশকে যখন রহিমআফরোজ প্রথমবারের মত বাংলাদেশের বাজারে আসে, তখন তিনি ঘাড়ে করে নিয়ে গেছেন আইপিএস ডেলিভারি করার জন্য। ]
দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দশকের একেবারেই লেজের দিকের গল্প। সবে গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়েছে, ইন্টার্নশিপ দরকার- মেলেনি তখনো; একটু চিন্তিত- বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টের জন্য হুড়ো দিতে শুরু করেছে। ইন্টারভিউ এর জন্য অপেক্ষা করছি, লম্বা 'কিউ'। প্রায় বিশ-পঁচিশজন হবে। জানা গেল, কী এক 'কল সেন্টার' এর জন্য ইন্টারভিউ চলছে- ইন্টার্নশিপের ইন্টারভিউ একই সময় ফেলে, এরা কেমন- ইতং বিতং ভাবা চলছে আর দেখছি অপেক্ষমানদের আসা যাওয়া।
প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর সুযোগ মিলল- আলাদা একটা ঘরে চেয়ার টেবিল পাতা- এধারে এক চেয়ার, নিশ্চয়ই আমার জন্য হবে, অন্যধারে তিনজন বসে-
মধ্যিখানে যিনি তিনিই আলাপ বেশি করলেন। "কেমন আছেন?", " বসেন", "কোথায় পড়াশোনা", " ক্যারিয়ার অব্জেক্টিভ-এ যা লিখেছেন তা দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন", ইত্যাদি প্রশ্নসমগ্রের পরে মোটামোটি শেষপ্রান্তের প্রশ্ন-
"এই যে লিখেছেন 'লেখালেখি' করেন, সেটা কী?"
"এই ত অল্প স্বল্প লিখি আর কি"- আমতা আমতা করে জবাব দিলাম- "গল্প, ছড়া, এমনি যা হয়"!
"তাই নাকি? পড়ে শোনান তো দেখি আপনার ছড়া!"
আকাশ থেকে পড়লাম। ইন্টারভিউ বোর্ডে এহেন প্রশ্ন আসবে কে জানত!
"আসলে সাথে তো নেই কিছু- তবে ছোট্ট দুয়েকলাইন লিখে এস এম এস করার অভ্যাস আছে- আজকেও এরকম পাঠাইছি কয়েকজনকে-"
"আজকে মানে কখন?"
"এই ত বসেছিলাম যখন বাইরে-"
"তাহলে পাঠিয়ে দিন আমাকে"- পাশের জন মুখ খুললেন, " নাহ! থাক! আপনি উনাকেই পাঠান! নাম্বার দিয়ে দেন এস এ"
"তো, চাকরি করতে চান?" ঘুরে প্রশ্ন করলেন আমাকে।
"নাহ! তা কেন! এখন চাকরি করব না! এম বি এ করব!"
"তাহলে আপনি এখানে কেন?"- অবাক উনি।
" ইন্টার্নশিপ চাই। সিভি তো সেই জন্য দেয়া!"
"তাই নাকি!"- এইবার প্রশ্নবিদ্ধ করলেন এইচ আর- কে!
এইবার এইচ আর ও চিন্তিত।
যাহোক, বেশ একটু দোদুল্যমানতার পর এখানেই জয়েন করেছিলাম। শামসুল আলম স্যার বা রহিমআফরোজ সংস্কৃতি অনুসারে এস এ স্যারের সাথে সেই প্রথম দেখা।
তাঁর কথা এরপর প্রায়ই শুনতে হত। নিজে সরাসরি যগাযোগ রাখতেন 'কনসিউমারে'র সাথে। কাজেই 'কাস্টমার সার্ভিস' ডিপার্টমেন্টে আসা কলগুলো'র অধিকাংশতে উনার নাম ব্যবহার হত 'বিশেষ রেফারেন্স' হিসেবে।
আর তাঁকে আরো একটু বিশেষ করে দেখেছি আরো এক বছর পর- বিভাগ বদলে 'মার্কেটিং' এ গেছি যখন।
'মার্কেটিং ফ্লোর' আদতে ছিল 'ম্যানেজমেন্ট ফ্লোর'। এক 'ম্যানেজিং ডিরেক্টর' ছাড়া সবাই বসেন অফিসের এ তলাতেই। কাজেই অন্যান্য তলা থেকে যারা আসেন তাঁরা একটু রয়ে সয়ে থাকেন, টের পাওয়া যায় সেটা।
সেখানে মধ্যমনি হয়ে থাকেন এস এ স্যার। সারাদিনে তাঁর ফোনে আসে শতাধিক কল, দিন গড়াতে গড়াতে তাঁর আঁচ ছড়ায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, বগুড়া, সিলেট, যশোর, আরো কত শহর আর শহরতলীতে। কোথায় কী হয়েছে আর কী হয়নি'র টানাপোড়েন। অথচ এ মানুষটার কাছে এলেই সব ঠিকঠাক। সেটায় বিভাগীয় প্রধানের "আমি-জানি-না-আপনি-কী-করবেন-করেন" থেকে নাদান আমাদের "স্যার-এইটা-কী-করা-যায়-একটু-বলেন-না"- সবকিছুতেই।
প্রন্ড ব্যস্ত মানুষটাই আবার সকালবেলায় তরতাজা। ভান্ডারে তাঁর সকালবেলায় চট করে তাজা শাকসব্জী কিনে আনার গল্প (যা আবার দুপুরবেলায় আমাদের চেখে দেখার সুযোগ), রাস্তায় যা দেখে এলেন তার গল্প, কী খবর পেয়েছেন তার গল্প- হাস্যোজ্জ্বল মুখ। সে হাসি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে আর সবার মুখে। উনার বসার জায়গাটা প্রায় মধ্যিখানে। কাজেই হয় তাঁর 'কিউবিকল'-এর চারধারে আমরা দাঁড়িয়ে কথা শুনছি অথবা যে যার বসার জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে- প্রাত্যাহিক দৃশ্য একেবারে। আবার দুপুরে খাওয়ার সময়- সবাই একসাথে- বাসার মতই। সেখানে খুনসুটি করে যাচ্ছেন- বড়দের যেমন বলছেন, ছাড় নেই 'ছোট'দেরও। সবার সাথেই একরকম।
সুস্থ মানুষ। নিয়মিত অফিস করেন। হঠাৎ একদিন খবর পেলাম চলে গেছেন তিনি- অফিস থেকে বাসায় ফিরে অসুস্থ। হাসপাতালে নিতে নিতে চলে গেলেন।
অনেকদিন তো হল- এখনো তাঁর কথা মনে পড়ে- সবার প্রবল 'নির্ভরতা' হয়ে থাকা মানুষটাকে মনে পড়ে- আর মনে পড়ে তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখ।
আল্লাহ তাঁকে ভাল রাখুন। তাঁর হাসি অমলিন থাকুক জীবনের ওপারেও
ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২০
#শিখিয়েকথন #শামসুলআলম #এসএস্যার #রহিমআফরোজ
মন্তব্য করুন