কালো কার্বন ফাইবার ফ্রেমের চশমা
কালো কার্বন ফাইবার ফ্রেমের চশমাটার গায়ে আলো পড়ে না সহজে। কালো গায়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার চেপে থাকে কখনো, কখনো এক চিলতে আলো ছুঁয়ে যায় ধুলো জমা কাঁচে। কখনো মানে যখন যেখানে চশমাটার বাস- ড্রয়ারটা খোলে।
নিজে থেকে তো আর হয় না- কেউ খোলে যখন, তখন। আলো আসে, ধুলোজমা কাঁচে আবছা প্রতিচ্ছবি ভাসে। কখনো কোন হাত, কখনো কপাল, কখনো দুটো চোখ- কখনো কাছাকাছি আসতে থাকা হাত।
শেষবারের হাতের স্পর্শে চশমাটা সরে গেছিল একটু, ওর নিয়মের জায়গা থেকে। মাঝারি আকারের খাতা একটা, বাঁধাই করা, পেপারব্যাক বাঁধাই- অত শক্ত কিছু না, আবার চট করে ছিঁড়ে যায় অমনও না।
উপরে সুন্দর করে লেখা- “লেখার খাতা”। সেটা লেখা না অবশ্য- ছাপা। কিন্তু ছাপাটা আবার লেখার মত দেখতে, কী একটা ঝঞ্ঝাট, বোঝানোও তো মুশকিল।
এ খাতাটার মাঝ বরাবর আড়াআড়ি থাকার কথা চশমাটার। কিন্তু এখন নেই। শেষবার যে হাতটা এলো- চশমাটাকে সরিয়ে রেখেছিল পাশে, কাজেই এখন ওর বাস আপাততঃ ‘লেখার খাতা’র পাশে, আদ্দেক তার ‘লেখার খাতা’র ঠিক নীচে যে কালচে মত মোটা ডায়েরিটা আছে, ওর উপরে।
আর বাকি আদ্দেক ছুঁয়ে আছে ড্রয়ারের তলা, তলা না ঠিক- ওখানে ক’খানা কলম আছে- ইকোনো বলপেন, ইকোনো ডি এক্স- সাড়ে তিনটাকা দাম, তাদেরই উপরে।
চশমাটার গায়ে কিছু আঁচড়ের দাগ, কালো’র ভেতর থেকে রুপোলী উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কিছু। না, ইদানিং হয়নি কিছু। অনেক দিনের দশমা, অনেক তার বয়েস। অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার তার কম নয় কিছু।
চেনা হাত থেকে ফসকে গিয়ে টেবিলের নীচে গিয়ে পড়েছে, অর্ডার দিয়ে বানানো জুতোয়। মেঝেতে পড়েছে, আবার একটু পরেই দারুন যত্নের ছোঁয়া পেয়েছে গায়ে- কয়েক কনা ধুলো সরে কাঁচে পড়েছে দাড়িশোভিত সৌম্য একটা মুখ।
কখনো হাতে হাতে ঠাঁই হয়েছে টেবিলের উপরটায়- লিখতে থাকা কোন একটা চিঠি বা আর কিছুর উপর। কখনো ডাঁটিতে ভর করে দাঁড়াতে হয়েছে বইয়ের ছোট্ট আলমিরাটার উপরে, পাশেই সাদা কিস্তি টুপি। দেয়ালের ওপারে ঘড়িটায় কয়টা বাজল দেখা গেছে পরিস্কার।
কম তো কিছু না, অনেক দিন। অনেক স্মৃতি মাখানো, গায়ে। কালচে ডায়েরিটাকে দেখে বোঝা যায় না- কিন্তু রত্ন ভান্ডার একটা। “যেখানে মিলিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই- পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।“ সেই রত্ন ভান্ডার।
ওতে স্কুলের শিক্ষকের উপহার দেয়া জাতীয় জন্মদিনে বাসায় কে কী করল’র খতিয়ান আছে, ধোয়ার পর সমান করার জন্য রাখা সাদা কিস্তি টুপি আছে, জবাব-হয়ে-আসা-চিঠি আছে, চিঠি পাঠানোর হলদে খাম আছে, বাজারের ফর্দ আছে, ঈদের কার্ডে যাওয়া শুভেচ্ছা বার্তার ফটোকপি- সব আছে।
আর আছে টাকা। এক টাকা। দুই টাকা। পাঁচ টাকা। এমনকি একশ টাকা। আর ইতিহাসও। কোন কোন টাকা চলার উপায় নাই- অনেক আগে রাখা, বাজারে চলার দিন চলে গেছে। কাজেই ডায়েরির পাতায় বন্দী জীবন।
কিন্তু ডায়েরিটায় হাত পড়ে না অত। একদম উপরের দিকটায় ধুলো তো আছেই, হাতে ছুঁতে গেলে আসবে আশ- মাকড়শা বাসা বেঁধেছিল কখনো। ভ্যাপসা গন্ধ ওদিকটায়- আলোবাতাসের অভাব হতে পারে আবার তেলাপোকা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে- ওখান থেকেও হতে পারে।
অবশ্য দেখা যায় না ওদের- ঠিক লুকিয়ে পড়ে আলোর অভাস পেলেই- কালো ডায়েরির ঠিক নীচেই আছে সবুজ আরেকটা পেটমোটা ডায়েরি- কিন্তু আকারে ছোট। কাজেই ফাঁকা জায়গাটা লুকোতে কাজে লাগে ওদের।
চশমাটায় আসলে হাত পড়ে না অত, পড়ে কালো ডায়রিটার নীচের দিকে- চাবি আছে ক’টা। তাতেও সবকখানা’য় না। কতগুলোয় গায়ে মরিচা পড়ে রুপোলি রঙ তো গেছেই, এখন লালচে হয়ে গেছে প্রায়। গায়ে গায়ে লাগলে ঝন ঝন শব্দও হবে না হয়ত, ভোঁতা শব্দ হবে হয়ত।
আর আছে একটা পুরো বিশ্ব। সাদা একটা কম্পাস, ওর সাথে চাবি। এগুলোও পুরোন, কিন্তু মরিচা পড়েনি। মাঝে মাঝে হয়ত ওদের এখনো ডাক পড়ে বাইরের ঘরে- ওঘরের বইয়ের আলমিরা’র তালা তো ওদের ছাড়া খোলে না। বড় শখের, বড় আদরের বইগুলো। ওগুলোতেও ধুলো পড়ল কি? দেখা হয়নি তো।
চশমাটা অনেক দিন ধরেই তো ড্রয়ারে- ‘লেখার খাতা’র উপরে হোক, বা আশেপাশে। কাঁচের ধুলো পরিস্কার হয় না, পড়ে না সেই চেহারার প্রতিচ্ছবি। দেখা হয় না সে চোখে চেপে দুনিয়া দেখা।
আলো না আসা ড্রয়ারে হঠাৎ আলো’র ঝলকানি পরিস্কার করে দেয় ভেতরটা- দেখা যায় সেই লেখার খাতা, ডায়েরি, কলম, চাবির রিং।
একটা মুখের ছায়া পড়ে চশমার কাঁচে- সেই মুখ, মুখভর্তি দাড়ি। আরো কাছে আসতে থাকে। চশমাটা অপেক্ষা করতে থাকে- ধুলোটা সরে গেলে হত, ঠিক মিলিয়ে নেয়া যেত চেহারাটা।
চশমাটা অপেক্ষা করতে থাকে।
ধ্যাত, বাজে কথা। চশমার প্রাণ নেই, ওরা অপেক্ষা করতে জানে না।
মন্তব্য করুন