তোমার জন্যে লাল গোলাপ
এক.
মাসুদ তাঁর বাবার ছবিটির ফ্রেম পাল্টান―প্রতি বছর; মার্চ এলেই। এটি তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে সারা বছর।
আজ আব্বু সকালেই টিভি দেখছেন; সকালের নাশতা সেরেই প্রতিদিন তাড়াহুড়ো করে তিনি বেরিয়ে পড়েন―অফিসে যান।
বাসার টিভি সেটটি ডাইনিং রুমেই। আব্বু ওখানে বসেই খবর শোনেন; রাত জেগে টক শো দেখেন। মাঝে মাঝে আম্মুও বসেন―খবর শোনেন।
―আব্বু , তুমি কী দেখছো? তোমার কী আজ অফিস নেই? এতো কোন খবর নয়―লাইভ অনুষ্ঠান। দীপা বাবার গা ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়।
―না, মা । আজ আমার ছুটি। স্বাধীনতা দিবসের ছুটি।
―আম্মু, আজ তোমারও কি ছুটি ? আজ তো ভাইয়ারও ছুটি, আমারও ছুটি, আব্বুরও ছুটি।
দীপা দৌড়ে গিয়ে ওর ভাইয়ের হাত ধরে গাইতে থাকে―দীপনও গলা মেলায় দীপার সাথে:
মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি,/ কী করি আজ ভেবে না পাই, পথ হারিয়ে কোন বনে যাই / কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই সকল ছেলে জুটি/ আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি।
ভাইবোনের ছড়ার ছন্দে উত্তর দেয়ার সুযোগ পান না সাজিদা চৌধুরী। বাবা একটি সরকারি ব্যাংকে ও মা সরকারি কলেজে চাকুরি করেন। এই চারজনের সঙ্গে গেল পাঁচ বছর ধরে পাশাপাশি আছে এক অনাথ কিশোরী―এই ঘরটি পরম ভালোবাসা আর আদর দিয়ে সে-ই গুছিয়ে রাখে।
মাসুদ কেমন মনমরা হয়ে টিভির পর্দার দিকে তাকিয়ে আছেন। এখন স্বাধীনতা বিষয়টি কেউ কেউ এড়িয়ে চলে―সন্তর্পনে; মুক্তিযুদ্ধ, জয়বাংলা তারা সইতে পারে না। হয়তো ভাবছেন―একজন শফিকুর রহমান সবার অজান্তে আজ তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন। দীপন ও দীপার কথাও ভাবছেন। তারা নিজের দেশের কথা জানার তেমন সুযোগ পাচ্ছে না। তিনি ভালোই বোঝেন আজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোন ছুটি নেই। জেএসসি পরীক্ষার ছুতোয় বিজয় দিবস, এসএসসির ছুতোয় স্বাধীনতা দিবস প্রতি বছর মাঠে মারা যায়। আরজুর ডাকে সে সংবিৎ ফিরে পায়:
―ভাইয়া চা-তো ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। একটু গরম করে আনি।
―হ্যাঁ, আনো।
―আম্মু , এদিকে এস্ োবসো। দীপা দৌড়ে এসে বাবার কাছে বসে পড়ে।
―আব্বু, তুমিও বসো। দীপনও এসে তার বোনের পাশে বসে।
―আব্বু, ওটা কী ? অনেকটা মঞ্চের মতো―হাজার হাজার মানুষ ফুল নিয়ে ফুলের তোড়া নিয়ে ওই খোলা জায়গায় রেখে যাচ্ছে। দীপা আবার প্রশ্ন করে।
―হ্যাঁ মা, ওটা জাতীয় স্মৃতিসৌধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি―তাঁদের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা জানাতে ওঁরা ফুল দিচ্ছে।
―ওখানে আমাদের মতো অনেক বাচ্চাও আছে। সবার হাতে ফুল, লাল লাল ফুলগুলো সবুজ পাতার কোলে যেন হাসছে। আব্বু, চলো আমরাও যাই; আব্বু আমিও ফুল দেব। আজ তো আমাদের ছুটি।
―ঠিক আছে মা, আগে তুমি নাশতা সেরে নাও।
―আব্বু, আমরা কি তাহলে ফুল নিয়ে ওখানে যাবো ? আব্বু, আমাদের সঙ্গে আম্মু ও ভাইয়াও যাবে ?
―হ্যাঁ মা, আমরা সবাই যাবো। আরজুও যাবে। কথাগুলো শুনে আরজুর চোখমুখে এক চিলতে হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
নাশতা শেষে আব্বু আমাদের সবাইকে ডাকলেন। তিনি এবার দাদুর ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আম্মু একটি বড় প্যাকেট এনে আব্বুর সামনে তুলে ধরলেন। আব্বু প্যাকেটটি খুললে আমরা সবাই চমকে ওঠি―প্যাকেটে ভর্তি লাল গোলাপের বেশ কটি বড় বড় মালা। এতক্ষণে আরজুও আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আম্মু এবার আমাদের সবার হাতে একটি একটি মালা দিলেন। আব্বু মালাটি হাতে নিলে তার চোখজোড়া আস্তে আস্তে পানিতে ভরে গেলো। আম্মুর মুখখানিও হঠাৎ মলিন হয়ে গেলো। আম্মুর দেখাদেখি ভাইয়ার ও আমার চোখ পানিতে ভিজে গেলো। প্রথমে আব্বু দাদু ভাইয়ার ছবিতে মালাটি পরিয়ে দিল; তারপর আম্মু, আমি, ভাইয়া ও আরজু দাদুর ছবিতে মালা পরালাম। এর পর আমি আস্তে আস্তে দাদুর ছবির নিচের লেখাটুকু পড়তে চেষ্টা করলাম―জনাব শফিকুর রহমান, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা।
দুই.
৭১ সাল―বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের পর দাদু পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসলেন। সবার মতামত শুনলেন। শফিউর, শহিদুর, শফিকুর, সমিউল একমত হয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বড়মার পা ছুঁয়ে চার ছেলে শপথ নিলেন দেশের মুক্তির জন্যে প্রয়োজনে তাঁরা প্রাণ দেবেন। শফিউর, শহিদুর, সমিউল তিনজন গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন―বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ নিলেন; বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিলেন। একমাত্র শফিকুর স্কুল আর ঘরবাড়ি আঁকড়ে ধরে মায়ের পাশে রয়ে গেলেন- তখন আব্বু দাদু আপুর গর্ভে।
পাকিস্তানপন্থী ও স্বাধীনতাপন্থী দুই ভাগে দেশের মানুষ ভাগ হয়ে গেল। পাকিস্তানপন্থীরা মুসলিম লীগের ছত্রছায়ায় পাকিস্তান রক্ষায় গ্রামে গ্রামে শান্তিবাহিনী গঠন করে। তারা খানসেনাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাঙালিদের হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয়। আর স্বাধীনতাপন্থীরা আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারা একটি সুষম সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন―যেখানে দেশের সকল নাগরিক সমান অধিকার পাবে; ধর্মের কারণে কেউ ছোট কেউ বড় হবে না। কোন ধরনের বৈষম্য, নিপীড়ন ও নির্যাতন থাকবে না। দাদু তখন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের হুজুরস্যার। বাংলার পাশাপাশি ভালো উর্দু বলতে পারতেন। মৌলানা সাহেব হিসেবে সবাই আলাদা চোখে দেখতেন। গ্রামের হিন্দু মুসলমান সবাই তাঁকে ভালোবাসতেন―পছন্দ করতেন। তিনি মনে করেছিলেন গ্রামের মানুষ তার কোন ক্ষতি করবে না। যুদ্ধ শুরু হলে তার কাছে বিভিন্ন সময় স্বাধীনতাপন্থী লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যায়। আর পরিবারেরর অন্য সবাই যে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তা তো এলাকার সবারই জানা। এতে খানসেনাদের দোসররা তার উপর নাখোশ হয়েই আছে। বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ ও সহযোগিতা করার বিষয়টি তাদের চোখে ধরা পড়ে। হানাদার বাহিনীর আগমনের পূর্বেই রাজাকাররা মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ শুরু করে। তারা গ্রামের হিন্দুদের মুসলমান হতে বাধ্য করে―নইলে নির্বিচারে গুলি করে খুন করে।
শত শত হিন্দু নরনারী প্রাণের ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়; নিরুপায় কেউ কেউ আগেই পাহাড়জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। সকালে ঠিকই পাঞ্জাবি সেনারা গ্রামে এলো, সঙ্গে সঙ্গে পেছনে পেছনে ছুটছে রইসুদ্দি ও আমির আলি। আমির আলি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, রইসুদ্দি খতিব বাড়ি মসজিদের মুয়াজ্জিন। পাঞ্জাবিরা দাদুর সঙ্গে কথা বলে খুশি মনে বাঁশখালির দিকে ফিরে গেল। এটি আমির আলি আর রইসুদ্দির ভালো লাগেনি। তারা যাবার সময় হরিয়ার ছড়া, পুঁইছড়া, কেরুনতলির হিন্দু পাড়াগুলোর বাড়িঘর জ্বলিয়ে দিলো। যোগেশ বাবুর মেয়ে বন্দনা দেবীকে ও যতীনবাবুর পুত্রবধূ শেফালিকে উঠিয়ে নিয়ে গেল হানাদার ক্যাম্পে।
সেদিনই ফেরার পথে খানসেনারা গেরিলা কমান্ডার শফিউরের হাতে আক্রান্ত হয়। পাহাড়ি পথ, দুপুর থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি―ঝোঁপের আড়াল থেকে অতর্কিত আক্রমণের মুখে তারা প্রাণ ভয়ে পালাতে বাধ্য হয়। আমির আলি বুঝতে পারে এটা শফিউর বাহিনীর কাজ। এই পাহাড়ে শফিউর তার দল বল নিয়ে আজ বিশ ত্রিশ দিন ধরে চৌকি বসিয়েছে―এ রকম একটি রিপোর্টকে সে গুরুত্ব না দেয়ার খেসারত এটা। এই গেরিলা অপারেশনে দুইজন খানসেনা গুরুতর আহত হয়েছে। রইসুদ্দির ডান পা উড়ে গেছে। সে ডান পা হারানোর যন্ত্রণা ভুলতে পারে না।
‘শফিক ভাই, শফিক ভাই’ বলে দরজার কড়া নাড়ে কলিম মোল্লা। রাত একটা প্রায়। তিনি প্রতি রাতের মতো ঘুমিয়ে পড়েছেন।
একটু সংশয় নিয়ে দরজা খুলেন। তারপর মুখোশপরা দুর্বৃত্তের দল খাঁচার মুরগির মত খপ করে ধরে তাঁকে নিয়ে পালায়।
সকালে কমিউনিটি সেন্টারের ছাদে রক্তাক্ত শফিকুরের মৃতদেহ পড়ে থাকে―গলাকাটা।
তিন.
তাঁরা যখন জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে পৌঁছোয় দুপুরের রোদ একটু ফিকে হয়ে এসেছে।
সবাই এক একটি লাল গোলাপ হাতে―ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন।
০৯.০৩.২০১৩ ইং; চট্টগ্রাম।
৬ এপ্রিল দৈনিক জনকণ্ঠ
মন্তব্য করুন