ইউজার লগইন

সম্ভাব্য মৃত্যুরকোল থেকে ফিরে এসে....

ঠিক মৃত্যুটা হয়তো নয়; তবে মৃত্যুর করূণ সম্ভাবনাই প্রত্যক্ষ করেছি। গতকাল। খুব কাছ থেকে। পরিবার-পরিজন-প্রতিবেশীদের নিয়ে। আগুনের ধোয়া কুন্ডলী পাকিয়ে যখন অদম্যতাড়নায় সিড়িঁ বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে আসছিল, আর আমরা কিছুতেই এগুতে পারছিলাম না, আমাদের সাথে থাকা একমাত্র সম্ভাবনা-প্রাণটাকে নিয়ে, তখন ধোঁয়ার একএকটি কুন্ডলীকে অসংখ্য মৃতুদ্যুতই মনে হচ্ছিল আমাদের কাছে। আমরা যতই দূরে সরে যেতে চাইছি, ধোয়ার কুন্ডলীগুলো ততই আমাদের তাড়া করছিল। শেষ পর্যন্ত ছাদে গিয়েই আমরা অপেক্ষা করতে থাকলাম, সম্ভাব্য মৃত্যুর অথবা উদ্ধার পাবার জন্য। যেকোন সময়। বলা যায় কোন এক সময় উদ্ধার পাবো-সে স্বপ্নেই বিভোর ছিলাম আমরা। কারণ শেষপর্যন্ত আমরা আস্থা হারায়নি আমাদের সামাজিক পুঁজির ওপর। যেকোন দুর্যোগে অতিসাধারণ সামাজিক মানুষরাই হয়ে ওঠে আমাদের সবচেয়ে আপনজন। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক পুঁজি। সচরাচর এ-সব মানুষগুলোর সাথে হয়তো আমাদের কথা হয় না। কথা বলার প্রয়োজনও অনুভব করি না। কিন্তু বিপদের সময় তারাই ছুটে আসেন। বিপদগ্রস্তকে উদ্ধার করাকে আপনকর্তব্য বিবেচনায় যারা তাড়িত হন। জীবনের ঝুকি নেন। অন্যদের জীবনের গান, বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে জারি রাখবেন বলে। সবসময়। গতকালও সে মানুষগুলোই ছুটে এসেছিলেন। আমাদের জন্য। না হয় আজকের পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম অন্যরকম হতে পারতো! আমরা কেউ কেউ না হতে পারতাম কোন না কোন পত্রিকার প্রধান অথবা দ্বিতীয় সংবাদ শিরোনাম।

নিচতলায় বৈদ্যুতিক শটসার্কিটে আগুন ধরে তখন দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ছে। যতটা না আগুনের তীব্রতা, তার চেয়ে ভয়াবহ ধোয়ার কুন্ডলী। ধোয়ারা কুন্ডলী পাকিয়ে যেভাবে উপরে ছুটে আসছিল, তাতে মনে হচ্ছিল, ওরা আমাদেরই খুঁজছে এবং ইতোমধ্যে জেনে গেছে যে, আমরা সবাই ছাদে আশ্রয় নিয়েছি। সে রকম বিহবল অবস্থায়ও যে নামগুলো ভেসে আসছিল, তারমধ্যে তাজরিন ফ্যাশন উল্লেখযোগ্য। না, তাজরিনের ঘটনার সাথে এটা কোনভাবে তুলনাযোগ্য নয়, না ভয়বহতার দিক থেকে, না ব্যাপ্তির দিক থেকে। তবু গতকাল নিজ অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পেরেছি, আগুনের তীব্রতা ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ার আগেও মানুষ মারা যেতে পারে, শুধু ধোঁয়ার তীব্রতার জন্য। ধোঁয়ার কুন্ডলী নিমিষেই মানুষের নি:শ্বাস বন্ধ করে দিতে পারে। মানুষকে আটকে দিতে পারে। শেষ করে দিতে পারে উদ্ধার পাবার সম্ভাবনা। এবং বেশিরভাগ সময় ধোঁয়ার কুন্ডলিতে নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে মানুষের মৃত্যু হয়, এ সব ঘটনায়, এ রকম ধারণাই তৈরি হয়েছে আমার। গতকাল।

গতকালের আগুন লাগার ঘটনা থেকে এটাও বুঝতে পেরেছি, তিলোত্তমা রাজধানীর অতিনগরায়িত জীবনে এপার্টমেন্ট অথবা একক বাড়িগুলোতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাসহ দূর্যোগব্যবস্থাপনাজনিত সচেতনতা, প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কত ভঙ্গুর। মানুষ কত অসহায় গৃহায়ন ব্যবস্থাপনার সুশাসনের দুর্বলতার কাছে। আমাদের ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত দায়িত্বহীনতার কাছে। দূর্যোগ প্রতিরোধ, প্রতিরক্ষার ন্যুনতম ব্যবস্থা না করেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গৃহায়নবেনিয়াদের দুর্বল, বিকৃত-বিচ্যুত নকশা কীভাবে অনুমোদন করে! আর সে অনুমোদিত নকশায় গড়ে উঠা বাড়িতে মানুষ বাস করে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান জীবনের ঝুকি নিয়ে। প্রায় পুরোটা সময়।

আমি সবসময় গনমানুষের যৌথ উদ্যোগ এবং গণজ্ঞানের প্রতি আস্থাশীল। অতীতের ছোটবড় সব দূর্যোগেই ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই আমরা দেখেছি কোন নির্দেশনার অপেক্ষা না করেই সাধারণ মানুষই ছুটে আসে। নিজেদের অভিজ্ঞতা নির্ভর উদ্যোগ গ্রহণ করে। মানুষের জন্য ঝাপিয়ে পড়ে। সামাজিক পুজিঁ আর অভিজ্ঞতা নির্ভর গণজ্ঞানের উৎকর্ষতার এ রকম উদহারণ গতকালও সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হল। ছাদে পুরুষ, নারী, শিশু, আমরা যখন আটকা পড়ে চিৎকার করে বলছিলাম, ফায়ার সার্ভিসে খবর দিতে, আমাদের উদ্ধারের সম্ভাব্য উপায়গুলো যে যার মতো করে আওড়াচ্ছিলাম, এলোমেলোভাবে, অনুরোধ করছিলাম, যাকে দেখছিলাম তাকেই, চিৎকার করে করে, ঠিক সেসময় একদল সাধারণ মানুষ ছুটে এল বালির বস্তা নিয়ে। পরে জেনেছি, তাদের মধ্যে থেকে একজন বলেছিল, বিদ্যূতের আগুন-এ পানি দিতে নেই। এটা নেভাতে মাটি, বালি ব্যবহার করতে হবে। চারপাশ থেকে বালি আসতে থাকলো। হাতে হাতে। বস্তায় বস্তায়। বালিগুলোর মালিকানা কার সেটাও কেউ বিবেচনায় নিল না। কারণ, বালির মালিকানার চেয়ে, বালির মূল্যের চেয়ে জীবনের দাম অনেক মূল্যবান হয়ে উঠেছিল গতকাল। এবং আমরা এও প্রত্যক্ষ করলাম, অগ্নিনির্বাপনে বিশেষায়িত বাহিনী আসার আগেই, এ সাধারণ মানুষগুলোই তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ খুবই সাধারণ জ্ঞান দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। যদিও ধোঁয়ার কারণে আমরা তখনো আটকা পড়ে আছি। ডেসার প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই, তারা সময়মতো এসে বিদ্যূতের লাইন বিচ্ছিন্ন করেছিল। ন হয় আগুন আরো ছড়িয়ে পড়তে পারতো। হাউজিং কমিটির একজন সদস্য এসে গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। সবশেষে এসেছেন, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। বোধকরি, তাঁরাও খবর পাওয়া মাত্র এসেছেন। হয়তো সংবাদটি পরে পেয়েছেন। না, তাদের তেমন কিছু করতে হয় নি। তারপরও তারা পুরা বাড়ি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই সম্ভাব্য নির্দেশনা দিয়েছেন। ভয়কাতুরে আমাদের শিশুদের জন্য, আমাদের পরিবার-পরিজন এর জন্য, ফ্লাটের অধিবাসীদের জন্য আস্থার জায়গা তৈরি করেছেন। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে খাটো করা হবে বলে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই না। তবে এ কথা তো বলতে পারি, সবার স্বত:স্ফুর্ত সহযোগিতায়, ছোট্রছোট্র গুরুত্বপূর্ণ চেষ্টায়, আমরা যে অনেকটা দ্বিতীয় জীবনপেয়েছি, জানি না কতদিনের জন্য, সে সহযোগিতা আর ভালবাসার কথাতো কোন দিনই ভুলতে পারবো না। আর আমাদের শিশুরা তাদের শৈশবের এ দিনটি কোন দিনই কি ভুলতে পারবে? সম্ভবত না।

গতাকালের অভিজ্ঞতা থেকে এটুকু বুঝেছি যে, সম্ভাব্য দূর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সবারই ছোট্রছোট্র প্রস্তুতি থাক দরকার। প্রয়োজনীয় টেলিফোন নম্বর, থানা, ফায়ার সার্ভিস, প্রাসঙ্গিক প্রয়োজনীয় সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে এমন বন্ধু, শুভাকাঙ্খি, প্রতিবেশীদের মোবাইল নম্বর, এগুলো মোবাইলে এবং বাসায় চোখে পড়ে এমন জায়গায় থাকা খুবই জরুরি। এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে যাবার মতো মই বা এ রকম কিছুর ব্যবস্থা থাকাও দরকার। সিঁড়ি এবং সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপন করাও জরুরি। প্রতিটি ফ্লোরের বারান্দার গ্রীল যাতে, বাইর থেকে নয়, অন্তত ভেতর থেকে খোলা যায়, এটাও বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।

সে যাই হোক, আপাতত বেঁচে গেছি, ঈদ ও পুজোর আগে, সবাই মিলে। এটাই এখন আমাদের জন্য সংবাদ। সুসংবাদতো বটে। এ সুসংবাদটা শেয়ার করতে পারার আনন্দই বা কম কীসে!

পোস্টটি ১৮ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

ইফতেখার মাহমুদ's picture


জীবনে চলার পথটা যতই মসৃণ বা বন্ধুর হোক না কেন, জীবন ধীরে ধীরে তার পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। মানুষের জীবনের এই চূড়ান্ত পরিণতির নাম মৃত্যু। প্রতিদিন ঘুমানোর সময় আমরা মৃত্যুর কাছাকাছি এক অভিজ্ঞতা লাভ করি। প্রতিদিনের ঘুম মানে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে যাবার এক মহড়া মাত্র।
'জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?' জীবিত প্রানীদের মৃত্যু হবেই হবে। এটি প্রকৃতির এক অমোঘ নিয়ম।
মৃত্যুর আগের ক'টা দিন নানান মায়ার বাঁধনে জড়াই আমরা, জীবনকে নানা রংগে সাজাই, সম্পদ আর অর্থের পেছনে নিরন্তর ছুটে বেড়াই, ভোগে মাতি, স্বপ্ন দেখি সুন্দর আগামীকালের, তারপর দ্রুত বয়ে যায় সময়, বার্ধক্য এসে গ্রাস করে আমাদের।
আমরা আমাদের জীবনের চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকি,পলে পলে। তাই সবার উচিৎ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, বাঁচার মতো বেঁচে থাকা, জীবনকে অর্থবহ করে তোলা,আর পরের প্রজন্মের জন্য সুন্দর একটা পৃথিবী রেখে যাওয়া। মানুষ অমর হতে পারে না, কিন্তু বেঁচে থাকে তার জীণ তার সন্তান ও তার বংশধরের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে। তাইতো সুস্থ সন্তান জন্ম দেয়া এবং তাদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা মানুষের জীবনের এক চিরন্তণ চাওয়া।
আর মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মের মাঝে। যেই সব মানুষ মানব জাতিকে তার নানা ক্রান্তিকালে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, মানব জাতি তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে আজীবন। ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম সোনার হরফে লেখা থাকে। তাইতো সুকান্ত বলে গেছেনঃ
"এসেছে নতুন শিশু,
তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর
ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ
দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব
আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ়
অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে,
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।।"

মুনীর উদ্দীন শামীম's picture


বিশাল লম্বা মন্তব্য। দার্শনিক বক্তব্য। তাও আবার মৃত্যু নিয়ে। ধন্যবাদ।
আপনাকে ব্লগ পাড়ায় দেখে ভীষণ পুলক অনুভব করছি।
শুভ ব্লগিং।
নিয়মিত লেখা চাই। পোস্ট চাই।

আরাফাত শান্ত's picture


শুকুর আলহামদুলিল্লাহ, খারাপ কিছু হয় নাই! আরো একশো বছর বেচে থাকেন ভাইয়া! কন্যা ও তার মাকে নিয়ে আনন্দময় দিন কাটান ভাইয়া!

মুনীর উদ্দীন শামীম's picture


অনেক ধন্যবাদ আরাফাত। আপনার শুভকামনার জন্য। অনেক অনেক মানুষের অদৃশ্য শুভকামনাগুলো ছিল বলেই এ কঠিন বিপদ থেকে আমরা উদ্ধার পেয়েছি। ছাদে সবাই তখন যেভাবে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছিল, সে দৃশ্য সত্যি দেখার মতো ছিল। বিহবল মানুষগুলো কেবল এক ভরসায় যেন দাঁড়িয়েছিল।
শুভেচ্ছা। ভাল থাকবেন। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।

নাজনীন খলিল's picture


কী ভয়াবহ অবস্থা!

যাক শেষপর্যন্ত বিপদ কেটে গেছে।
ভাল থাকো সবসময়। অনেক শুভকামনা রইল।

মুনীর উদ্দীন শামীম's picture


সত্যি আপা, এ রকম ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি আর কোনদিন হইনি। কেউ যেন কোনদিন না হয়। এটি অবিশ্বাস্য। যে যাই হোক, কারও কোন ক্ষতি হয়নি। হতে পারতো।
দোয়া করবেন আমাদের জন্য।
আপনার জন্যও অনেক শুভ কামনা থাকলো।

মেসবাহ য়াযাদ's picture


আল্লাহ সহায়। এইরকম অবস্থায় আতঙ্কে বেশিরভাগ মানুষ মারা যান।
আপনার এবং আপনাদের দীর্ঘায়ূ কামনা করছি।

মুনীর উদ্দীন শামীম's picture


সে রকম আতংক সেদিন আমাদের মাঝেও তৈরি হচ্ছিল। আমরা চেষ্টা করেছি, যাতে কেউ আতংকিত না হয়।
দোয়া করবেন। আর আপনার জন্যও শুভেচ্ছা।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

সাম্প্রতিক মন্তব্য

munirshamim'র সাম্প্রতিক লেখা