যে মুখোশটা বানানো হয়নি, তাই পরে থাকি সবসময়!
লালমাটিয়ায় একটা চরম অগোছালো ঘরে গিয়া হাজির হইলাম, দাড়িমুখো এক লোক এসে জড়ায়ে ধরলো।
আমি ছেলেদের সঙ্গে কোলাকুলি করতে পছন্দ করি না, তায় আবার এরম দাড়িওয়ালা! বিরক্ত হইলাম।
কিন্তু সেদিন যে বন্ধুত্বটা তৈরি হইলো, এক যুগেরও বেশি তার বয়েস। আজীবন এরকমই অকৃত্রিম থাকতো, কিন্তু থাকলো না সে।
গতবছর, ঠিক এই দিনে, ঠিক প্রায় এই সময়ে একটা ফোনকল আসে, শাহরুখ শহীদ আর নাই পৃথিবীতে!
বইমেলা থেকে পলান সরকার পুরষ্কার প্রাপ্তির ঘোষণা জেনে আনন্দিত মনে বাড়ি ফিরছি, সঙ্গে কতেক স্বজন, পান ভোজন। সেই রসিক রাতটা বেরাত হয়ে গেলো আমার জন্য। শাহরুখ ভাই ছিলো এমন একজন বন্ধু, যার সঙ্গে যে কোনো সময় যে কোনো কিছুই শেয়ার করা যায়। ফেসবুকের দুনিয়ায় বন্ধু বলতে পৃথিবীতে আর কিছু নাই, বন্ধুদের সঙ্গে এখন শুধু স্ট্যাটাসটাই শেয়ার করা যায়, কান্নাটুকু না।
আমাদের খুব মজা ছিলো, কখনো শাহরুখ ভাই হুট করে চলে আসতো অফিসে, অথবা আমি চলে যেতাম তার লালমাটিয়ার ফ্যাক্টরিতে বা চায়না বিল্ডিং গলির বাড়িতে। তারপর দিনমান আড্ডা আর আড্ডা। দুজনের একটাই মিল, চরম আমুদে। বাকী সবকিছুতে অমিল আর অমিল
আমার খুব মুখোশ সংগ্রহের শখ ছিলো একসময়। যেখানেই যেতাম মুখোশ খুঁজতাম। [নিজস্ব চামড়ার মুখোশে কুলায় না, বাইরের মুখোশও লাগে, কী করবো বলুন? ] এই নিয়ে কথা বলতে বলতে সিদ্ধান্ত হলো মুখোশ বানাবো, দুজনে মিলে। সেই ৯৭ সালের কথা। কিন্তু চরম আউলা আমি কখনোই কোনো কাজে সিরিয়াস না, সময় দেই না। বা দেখা হলে শুধু আড্ডাই হয়, কাজটা হয় না। শেষতক হলোই না। কিন্তু শাহরুখ ভাই সবসময় সবাইকে বলতো আমি আর নজরুল একদিন মুখোশ বানাবো, কোনো এক পহেলা বৈশাখে সেটার প্রদর্শনী হবে ঢাকার কোনো এক গ্যালারিতে। কিন্তু হলো না।
মাঝে একবার আমি নিজেকে ত্যাগ করে নিলাম। বললাম আমারে দিয়ে হবে না, আপনি বানান। কিন্তু তার এক কথা... বলছি আমরা দুজনে বানামু, নাইলে কেউ বানামু না।
শেষ পর্যন্ত হলোই না বানানো।
আদিবাসীদের নিয়ে শাহরুখ ভাই বেশ কিছু কাজ করেছিলেন। পাহাড়ে অনেক ঠিকানাতেই ছিলো তাঁর ঠাঁই। একবার তাঁর সঙ্গে পাহাড়ে যাবো, বেশ অনেকগুলো দিন থেকে আসবো। এও শুধু কথার কথা হয়েই রইলো!
যোগাযোগের দূরত্ব আরো বাড়লো। আমি উত্তরাবাসী হলাম। খুব দরকার ছাড়া এদিকে আসা হতো না, শাহরুখ ভাই দল বল নিয়ে গিয়ে আড্ডা মেরে আসতেন বলেই তবু যোগাযোগটা ছিলো।
একসময় শাহরুখ ভাইয়ের শখ উঠলো নাটক লিখবে। আমাকে ধরে নিয়ে সারাদিন এটা সেটা খাওয়ালো, নিজে লিখলো একটা নাটক। সেটা প্রচারও হলো। এরপরও অনেকগুলো নাটক শাহরুখ ভাই লিখলো। কিন্তু আমার হলো বিপদ, সবখানে কয় আমি নাকি তার গুরু!
শাহরুখ ভাই মারা যাওয়ার পর তাঁর শেষ গল্পটার নাট্যরূপও আমাকেই দিতে হলো
আমার একটা বই বের হবে, শাহরুখ ভাইয়ের সে কী খুশি! মোড়ক উন্মোচনের দিন দুপুর থেকে সেজেগুজে মেলায় হাজির, আমি পৌঁছবার আগেই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। পরিচিত সবাইকে ধরে ধরে বই কেনালেন!
উত্তরা ছেড়ে ঢাকায় এলাম, শাহরুখ ভাই খুব খুশি। এবার নিশ্চয়ই আবার আগের মতো যা খুশি তাই আড্ডা হবে! কিন্তু হলো না। আগের মতো হয়না বুঝি কোনোকিছুই।
গতবছর ফেব্রুয়ারিতে আমার ভাগ্নি তার শ্বশুড় শ্বাশুড়িকে একটা এক্সক্লুসিভ গিফট দিতে চায়, শাড়ি আর পাঞ্জাবী... ওয়ান পিস মেড কারিগর ডেড টাইপ। যথারীতি শাহরুখ ভাইকেই ফোন। খুব খুশি, অন্তত এইটার ডেলিভারি নিতে তো তুই আমার ফ্যাক্টরিতে আসবি একবার তাই না?
কিন্তু তবু হলো না। আমি ফোনেই কাজ সারলাম, ভাগ্নি গিয়ে ডেলিভারি নিয়ে নিলো। খুব খুশি সে। এতো সুন্দর জামদানী শাড়ি নাকি জীবনে দেখেনি! তবু আমার যাওয়া হলো না। বললাম বইমেলাটা শেষ হইলেই আইতাছি... উমদা আড্ডা দিমু।
হয়তো বইমেলা শেষ হওয়ার পরও উমদা আড্ডাটা হতো না নানাবিধ ব্যস্ততায়... কিন্তু সেই সুযোগটিও না দিয়ে বুড়োটা চলে গেলো...
শাহরুখ ভাই, মুখোশটা কখনো বানানো হয়নি, কিন্তু মুখোশটা আমি সবসময় পরেই থাকি!!
মানুষটার সাথে আমার আত্নীয়তার একটা সূত্র আছে, সে কারণে নজরুলভাইকে কৃতজ্ঞতা শাহরুখ ভাইকে স্মরণ করবার জন্য। তাঁর ঘুম শান্তির হোক। পোষ্ট না দেখেই আগের মন্তব্যটা দিয়েছিলাম, মীরভাইরে ডিফিট দেবার জন্য। পড়ে আমি নিজেই তব্দা খাইলাম...আপ্লুত হলাম। স্বকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ আবারও.......
আমরা সবাই কিছু পরিমানে মুখোশধারী সুশীল
এই পর্যন্ত পড়ে এটাকে খুব মজার একটা রম্য রচনা মনে করেছিলাম, আর তাই মজার একটা কমেন্ট করবো বলে স্থির করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত পড়ে সজল নেত্রে মনিটরের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলাম। আমরা মুখোশ পরেই জীবনটা কাটিয়ে দিই, আমরা শুধু স্ট্যাটাসই শেয়ার করি, বন্ধুত্ব আর হয়না আমাদের ! আমরা দিনের পর দিন যন্ত্র হয়ে যাচ্ছি, আমাদের মন মরে যাচ্ছে।
আসলেই, আমরা যাচ্ছি যাচ্ছি বলে কত মানুষকে আশায় বসিয়ে রাখি। আর সেটা কেবল তখনি উপলব্ধি করি যখন তারা চলে যায়।
দারুন সত্য কথা! আমরা সবাই এক একটা মুখোশধারী।
"শাহরুখ শহীদ" যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।
এক বছর হয়ে গেল!!
"শাহরুখ শহীদ" যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।
ভাল বন্ধুর খুব অভাব
বড্ড বেশী রকমের অভাব।
"শাহরুখ শহীদ" যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক.........
"শাহরুখ শহীদ" যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন ....
"শাহরুখ শহীদ" যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক।
"শাহরুখ শহীদ"
আপনার বন্ধু এখনো জেগে আছে।
এমনি করে সবাই যাবে... যেতে হবে..
কিছুই করার নেই আসলে
এক বছর হয়ে গেল?
প্রতিভাবান মানুষটি কত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন!
লেখাটা মন ছুঁয়ে যাবার মতো।
তার প্রয়ান টা আমার কাছে স্বাভাবিক লাগেনি !
মন্তব্য করুন