নিজ শহরে ফেরা: টাইগারপাস-৬
সারারাতের দম আটকানো গুমোট আবহাওয়াটা ভোর থেকে কাটতে শুরু করে। সেই ভোর থেকেই আমি জাহাজের উপরের ডেকে দাঁড়িয়ে। গতকালই কাপ্তেন জানিয়ে দিয়েছিল আজ দুপুরের পরপর জাহাজ বন্দরে পৌঁছাবে। মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকী, তবু তর সইছে না।
কেবিনের ভেতর প্রচন্ড গরম। বছরের এই সময়ে বঙ্গোপসাগরের মতিগতি বোঝা ভার। কখনো দমবন্ধ আবহাওয়া আবার কখনো হঠাৎ করে পাগলা হয়ে উঠে বাতাস আর ঢেউ। আমি দুরবীন দিয়ে দিগন্তে খুঁজছি নতুন চাঁদের মতো চিক্কন একটা সবুজ রেখা। দুপুরের খানিক আগে রেখাটা ধূসর নীল দিগন্তে আবছা ফুটে উঠতে দেখেই মনটা শাঁ করে উড়ে গেল স্মৃতিময় শহরে। কতোদিন পর নিজ শহরে ফেরা! আট বছর আগে যখন এই শহর ছেড়ে কোলকাতায় পড়তে যাই তখন কল্পনাও করিনি এতদিন বিচ্ছিন্ন থাকবো প্রিয় এই শহর থেকে। এটা নামে শহর হলেও এর পরতে পরতে গ্রামের গন্ধ। তাই বুঝি এর নাম চট্টগ্রাম।
জাহাজ যতই কাছে ভিড়ছে দিগন্ত রেখায় টিলাময় শহরটা ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এভাবে এই শহরকে আগে কখনো দেখা হয়নি। ওই তো দেখা যাচ্ছে আবছা মাথা উঁচু একটা একটা অবয়ব, ওটা কি বাটালী পাহাড়? তার ডানদিকে খানিক নীচু পাহাড়টা কি পরীর পাহাড়? কী সবুজ ওই জঙ্গল! তার ভেতরে লাল কটকটে পর্তূগীজ দালানটা, কল্পনা করে রোমাঞ্চিত হয় মনটা। ওখানে ফিরিঙ্গী ডাক্তারখানাটা এখনো আছে? আসলে চোখের দৃষ্টিতে যতটা দৃশ্যমান তার চেয়েও বেশী মনের দৃষ্টিতেই দেখা যাচ্ছে।
কতো বছর আসিনি এই শহরে? কতোটা বদলেছে খুব চেনা এই শহরটা? কোলকাতায় ইউরোপিয়ানদের আড্ডায় যখন কোলকাতার সাথে চট্টগ্রামের তুলনা করা হয় তখন প্রায় অবধারিতভাবে চট্টগ্রামের প্রশংসার তুফান ছোটে। চট্টগ্রামের প্রশংসা শুনে মনে মনে গর্ব হয় এটা আমারই শহর, সমস্ত ভূভারতে যার তুলনা হয় না। আমি কি আজ একটু বেশী আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ছি? জন্মভূমির কাছে এলে সবার ভেতরেই কি এই তোলপাড় চলে?
কর্ণফুলী নদীর মোহনা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো জাহাজ। এতবড় বাষ্পীয় জাহাজ আর একটাও নেই এই বন্দরে। তীর থেকে একটু দূরে নোঙর ফেলে থেমে গেল জাহাজ। এই জাহাজ ভেড়ার মতো জেটি নেই চট্টগ্রাম বন্দরে। ছোট নৌযানে জাহাজ থেকে ঘাটে যাত্রী পারাপার হয়। তারই একটায় চড়ে তীরের দিকে যাবার সময় বুকের ভেতর ধুকপুক করছে, কেমন যেন একটা বোবা অনুভূতি। ঘাটে অপেক্ষমান অই অত মানুষের ভীড়ে যাদের উপস্থিতি সবচেয়ে কাম্য ছিল তারা আজ কোন পৃথিবীর বাসিন্দা? আমাকে এই বেশে দেখলে যাদের বুক গর্বে ফুলে উঠতো, সেই দুজন আমার কাছ থেকে চিরতরে চলে গেছে অচিন দেশে। চোখটা ভিজে উঠলো আমার।
নৌকা ঘাটে ভিড়তেই পরিচিত মুখের খোঁজে চোখটা ভীড়ের মধ্যে ঘুরতে লাগলো। এত মানুষ যাকে দেখি তাকেই মনে হয় চিনি। কতোকাল পর এই চাঁটগাইয়া মুখগুলোকে দেখছি। কিন্তু আমাকে দেখে কেউ চিনলো না বরং আমার সাহেবী পোষাকের কারণে এমন চাহনি দিতে থাকলো আমি রীতিমত বিব্রত। তবু খানিক পর একজন এসে ব্যাগটা নিয়ে টানাটানি শুরু করতেই বুঝলাম, এতক্ষনে চিনেছে কেউ একজন। পরিচয় দিল জগদীশ পাল। আমার দপ্তরের হেড কেরানী। আরো দুজন আত্মীয়ও এসেছে আমার। খুড়তুতো ভাই দুজনকে চিঠিতে জানানো হয়েছিল আমার আগমন বার্তা। তারাও আমাকে নিতে এসেছে।
তবে জগদীশ একাই একশো। দেখা হবার পর থেকে তার মুখটার জিরান নাই, ভুট্টার খইয়ের মতো ফুটছে। আমাকে চাঁটগার ইহকাল পরকাল সমকাল সবকিছুর সংবাদ সূর্যাস্তের আগেই গিলিয়ে হজম করিয়ে দিতে হবে বলে পণ করে এসেছে। আমার কানের উপর রীতিমত সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে। অত্যাচারটা কমাতে আমাকে গলা খাঁকারি দিতে হলো বেশ কয়েকবার। কিন্তু মুখ তার যতটা চালু, কান তার দ্বিগুন ভোঁতা মনে হলো, আমার মুখের কথা তার কর্নপুরীতে আঘাত হেনে ঠিক সুবিধা করতে পারছে না। বাধ্য হয়ে আমি তাই মাটিতে পা ঠুকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
- জগদীশ, ভুল তো হয়ে গেল?
- আজ্ঞে কার ভুল?
- আমার
- আপনার কি ভুল বাবু?
- আমার ঘোড়াগুলোর কি হবে?
- আজ্ঞে কিসের ঘোড়া বাবু?
- আমার ঘোড়াদুটো তো রয়ে গেল জাহাজে
- আজ্ঞে আপনার ঘোড়া...........মানে আপনার নিজের ঘোড়া? দুই দুটো..........?
তার চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে পড়বে বিস্ময়ে। আমার মতো কালা আদমীর যেখানে একটা ঘোড়াই দুর্লভ সৌভাগ্য, সেখানে দুদুটো ঘোটক!! কথাটা বিশ্বাস করাতে আর কি কি করতে হবে বুঝতে পারলাম না। তবে বেশ কিছু বাক্য বিনিময়ের পর সে উপসংহারে আসলো এই ভাবে-
-বাবু আপনার দুটো ঘোড়া আছে, সেই দুটো ঘোড়া এই জাহাজে এসেছে, তাদেরকে দানাপানি ঠিকমতো দেয়া হয়েছে কিনা দেখতে হবে এবং জাহাজ থেকে নামানোর ব্যবস্থা করে তার পিঠে আপনাকে সওয়ার হবার মতো অবস্থা তৈরী করতে হবে, একটি ঘোড়ায় আপনি সওয়ার হবেন, আরেকটি ঘোড়ার পিঠে আপনার সমস্ত লটবহর তুলে দিতে হবে তারপর আমাকে সেই ঘোড়ার রশিটা ধরে হেঁটে যেতে হবে আপনার বাড়ী পর্যন্ত।
- আরে থামো তুমি, কি বাজে বকছো এসব।
- কেন বাবু মন্দ কি বললাম, আমি না দেখলে আপনাকে এই শহরে কে দেখভাল করবে। আপনি কোন চিন্তা করবেন না আমি থাকতে আপনার ঘোড়ার কোন অসুবিধা হতে দেবো না। আমি পলকেই ..........
- জগদীশ তুমি দয়া করে কি থামবে? আমি ঘোড়ায় চড়বো না। তুমি টনজন দেখ একটা, আর মাল টানার জন্য গরু গাড়ী। ঘোড়াগুলো নামিয়ে পরে বাড়ী পৌছে দিলেই চলবে।
- আজ্ঞে বাবু বুঝলাম, আমি বেশী কথা বলিনা, চুপ থাকতেই পছন্দ করি, যা করার দ্রুত করবো, আপনি কোন চিন্তা করবেন না, আমি থাকতে এই শহরে...........।
- জগদীশ...
-আজ্ঞে, থামলাম।
বাঙালী এত বাচাল হতে পারে জগদীশকে না দেখলে জানা হতো না। দশটা পাঁঠার বাচ্চাকে একসাথে দাঁড় করিয়ে দিলেও এত দ্রুত ম্যাঁ ম্যাঁ করতে পারবে না। এই লোক আমার সাথে কাজ করবে, আমি উদ্বিগ্ন হলাম আমার কর্নকূহরের জন্য।
আমার সাথে একই জাহাজে আরেকজন এসেছিলেন। ম্যাজিষ্ট্রেট মি. ক্লে, আমার কর্তা। পরদিন সকালে দফতরে ঢুকতে না ঢুকতেই ডাক পড়লো ক্লে সাহেবের ঘরে। উঠে দাঁড়িয়ে সম্ভাষন করলো লালমুখো মি.ক্লে। জাহাজে দেখা হলেও কথা হয়নি গরবিত কর্তার সঙ্গে। তবে কোলকাতা থেকে রওনা হবার পূর্বেই এর খ্যাতি শুনে এসেছিলাম দুর্মুখদের কাছে। সেটা প্রমান করার জন্যই বোধহয় কুশলাদি শেষ হবার পরপর বললো-
- নবীন
- ইয়েস স্যার
- শোনো তুমি মোটামুটি গোছগাছ করে নাও, আগামী সপ্তাহে তোমাকে মফস্বলে চলে যেতে হবে।
- মফস্বলে? এখানে আসার আগেই তো ছমাস ঘোর মফস্বল ডবুয়াতে কাটিয়ে এসেছি। আবার কেন?
- যেতে হবে। তোমার তো কোন সমস্যা হবার কথা নয়। এটা তোমার নিজেদের দেশ, এমনকি তোমার তাঁবুরও দরকার নেই। যে কারো ঘরে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করে নিতে পারো।
- দুঃখিত স্যার! এই মুহূর্তে আমি মফস্বলে যাবার অবস্থায় নেই।
- তুমি অবশ্যই যাচ্ছো। আমি অর্ডার লিখে সই করে দিচ্ছি।
- স্যার আমি এই অবস্থায় কিছুতেই যেতে পারবো না। আমি প্রস্তুত নই, তাছাড়া তাঁবুও পাবো না, রাত কাটাবো অন্য লোকের বারান্দায়? সেটি হচ্ছে না।
- তোমাকে যে কোন জায়গায় যাবার প্রস্তুতি থাকতে হবে যে কোন সময়, এটা সরকারের হুকুম
- সরকার এত অযৌক্তিক হুকুম দিতে পারে না। সরকারের বিধানমতে ছমাস মফস্বলে কাটিয়ে আসার পর আবার মফস্বলে পাঠানো যায় না। তাও তাঁবু ছাড়া।
- সরকারের বিধানমতে তুমি বড়কর্তার হুকুম মানতে বাধ্য। আমি কমিশনার থেকে লিখিয়ে আনবো।
- জনাব, সরকারের সম্মানে আমি যেতে পারি, কিন্তু তাঁবু ছাড়া যেতে বাধ্য নই।
- তুমি তাঁবু পাবে না, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য তাবু বরাদ্দ নেই
- তাহলে ধরে নাও আমি যাচ্ছি না।
- তুমি জানো তুমি কতবড় দেশদ্রোহী কথা বলছো? তুমি কোন সাহসে আমার কথা অমান্য করছো?
- তুমি আমার কর্তা আমি মানি, তুমি এখানকার কালেকটার আমি মানি, কিন্তু তুমি জেনে রাখো আমি এই অঞ্চলের খান্দানি পরিবারের সন্তান, সরকারী তাঁবু ছাড়া যেখানে সেখানে রাত কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার এই অসম্মতিকে তুমি চাকুরীর ইস্তফা হিসেবে ধরে নিতে পারো যদি তোমার আদেশ পরিবর্তন না করো।
- আমার কথাই এখানে আইন, তুমি মানতে বাধ্য
- নাহ মশাই, তোমার কথা সিভিলিয়ানদের জন্য আইন হতে পারে, কিন্তু আমার জন্য নয়।
- তুমি তাহলে আমার কথা শুনবে না?
- না, এই কথাটা শুনছি না। কারণ আমি সরকারী বিধি মেনে গত ছমাস মফস্বল পোষ্টিং কাটিয়ে এখানে এসেছি। বিধিমালা খুলে দেখো তুমি সদ্য মফস্বলে কাটিয়ে আসা কোন কর্মচারীকে তোমার মুখের হুকুমে আবারো মফস্বলে পাঠাতে পারো কিনা? তাহলে ভিক্টোরিয়ার কসম আমি কালকেই মফস্বলে চলে যাবো।
এই লম্বা লেকচার শোনার পর ক্লে সাহেবের চোয়ালটা দু ইঞ্চি নীচে নেমে গেল যেন। আমি হনহন করে বাইরের ঘরে এসে নিজের চেয়ারে বসে পাইপে আগুন দিলাম। আজকে নিজের শহরে চাকুরীর প্রথম দিন ব্যাটা মেজাজটা এমন খারাপ করে দিল! জগদীশ দূর থেকে পরিস্থিতি লক্ষ্য করছে। বাচালটা কাছে আসছে না সেটা একটা স্বস্তির বিষয়। এটাকে সবসময় এরকম গরমের উপর রাখলে কানের উপর থেকে অত্যাচারটা কমবে।
খানিক পরে লালমুখো ক্লের হুংকার শোনা গেল। আমি আজ রাতেই দিল্লীতে অভিযোগ করবো এমন অবাধ্য কর্মচারী আমার সহকারী করে পাঠিয়েছে কেন....ইত্যাদি গর্জন। কিছুক্ষন ফাইলের দুদ্দাড় শব্দ শোনা গেল, জানালা জোরে জোরে বন্ধ হলো ভেতর ঘরে। তারপর চুপ।
বিকেলের দিকে গরমটা একটু কমে এসেছিল। বাতাসে ধুলো উড়ছিল শহরের রাস্তায়। বসন্ত শেষে গরম চলে এসেছে, তবে বাসন্তী হাওয়াটা এখনো রয়ে গেছে। এই হাওয়ায় সন্ধ্যেটা চমৎকার। অফিস শেষে বাইরে যাবার সময় ক্লে একটু থামলো দরজার কাছে। তারপর ঔদ্ধত্যের সাথে বললো,
- ঠিকাছে, তোমার জেদই বজায় থাকলো। থাকো তুমি তোমার ইচ্ছে মতো। এবারের মতো বেয়াদবী মাফ করে দিলাম, দিল্লীতে লিখলাম না।
ক্লে চলে যাবার পর কর্মচারীরা হো হো করে হেসে উঠলো। এতক্ষনে সব দেশী মানুষের মধ্যেও কেমন অস্বস্তিতে ছিলাম। এবার পরিবেশটা ফিরে এল। সবাই কাছে এসে কিছু না কিছু বলতে চাইল। কিন্তু আজ আর সময় নেই, কাল কথা হবে বলে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। মনে মনে হাসলাম। বিড়াল প্রথম রাতেই মারতে হয়। ঘোড়া তৈরী ছিল, লাফিয়ে উঠে বাড়ীমুখো হলাম।
******** ********
থাকার বন্দোবস্তটা পাকা হয়নি। আপাততঃ এক আত্মীয় বাড়ী উঠেছি। বাবার মৃত্যুর পর ঋন পরিশোধ করতে গিয়ে শহরের বসতবাড়ীর অর্ধেকটা খুড়োদের কাছে বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। যদিও পরে খুড়োরা বিক্রিত অংশটা ফেরত দিতে চেয়েছে, আমি রাজী হইনি স্যাঁতস্যাঁতে বাড়ীটায় আস্তানা গাড়তে যেখানে আমার দুঃসহ কিছু স্মৃতি জমে আছে। ওই বাড়ীতেই ওলাওঠায় আপনজনদের নির্দয়ভাবে পরপারে চলে যেতে দেখেছি মাত্র কয়েক বছর আগে।
ক্লে আর ঝামেলা করেনি। পেটের ভেতরে কি আছে জানি না, তবে উপরে তেমন চটানি করেনি। লোকটা গোঁয়ার হলেও একেবারে বদ না। কাজকর্মে পটু। স্থানীয় বিষয় বোঝাতেও খুব একটা বেগ পেতে হয় না। অফিসে স্থানীয় ভূমি প্রশাসনের ব্যাপারগুলো মিটমাট বাদে তেমন কোন কাজ নেই। মামলামোকদ্দমাগুলো সব ভুমি সংক্রান্ত বিষয়েই। চুরি ডাকাতির মতো অপরাধ নেই বললেই চলে।
তবু একদিন ভিন্ন একটা ঝামেলা হলো। এই শহরে ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করে কেবল ইংরেজ সাহেবেরা। বাঙালীদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন জমিদার নন্দন ঘোড়ায় চড়ে, তবে তাদের ঘোড়াগুলো ইংরেজের ঘোড়ার তুলনায় কিছুই না। কেবল আমার ঘোড়া দুটো তার মধ্যে ব্যতিক্রম। ইংরেজের ঘোড়ার চেয়েও তাগড়া আমার ঘোড়া দুটো, যার সাথে এই শহরের কোন ঘোড়ারই তুলনা হয় না। একটা ঘোড়া তো রীতিমত সার্কাসের খেলা দেখাতে সক্ষম। এই ব্যাপারটা অনেকে ঈর্ষার চোখে দেখতে শুরু করে। মূলতঃ দেশী জমিদারের বংশেরাই। দুয়েকজন বিলাতীর মধ্যেও এই ঈর্ষার প্রভাব চলে গিয়েছিল সেটা টের পেলাম যেদিন সিভিল সার্জনের ঘোড়ার মুখোমুখি হলাম এক বিকালে। এই লোকটা আমার ঘোড়ায় চড়াকে সহ্য করতে পারতো না, এবং বলে বেড়াতো তার ঘোড়াই সেরা এই শহরে।
আমি যখন বৈকালিক ভ্রমণ শেষে বাড়ী ফিরছিলাম ডাক্তার সাহেব ডিস্পেনসারীর সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে। আমার ঘোড়াটা পাশ দিয়ে যাওয়ামাত্র আচমকা ছুটে এসে চাবুক দিয়ে আঘাত করলো ঘোড়ার মাথায়। ঘোড়াটা চমকে লাফিয়ে উঠতে আমি প্রায় পড়ে যাবার উপক্রম হই।
চিৎকার করে বললাম, ব্যাটা বদমাশ শয়তানের বাচ্চা, তুমি আমার ঘোড়াকে মারলে কেন?
আমার গালি শুনে সে রাগে অন্ধ হয়ে পাল্টা অবোধ্য চিৎকার করে ছুটে আসতে থাকলে আমি বুটসমেত ডান পা তার দিকে তুলে ধরলাম এবং নিমেষে একটা কান্ড হয়ে গেল। তার ছোটার গতির দ্রততা, আমার বুটের আগা আর তার বুকের খাঁচা এই তিনের মধ্যে একটা এক অনিবার্য চৌম্বকীয় আকর্ষনে তার বিশাল দেহটা ভুমিতে আছড়ে পড়ে যায়। তারপর আমি ঘোড়া ঘুরিয়ে বাড়ীর পথ ধরতেই সে আবারো উঠে "ইউ নিগার....তুমি আমাকে আঘাত করছো তোমার এত সাহস...." ইত্যাদি বলে চিৎকার করলে ছুটে আসতে চাইলে আমি ঘোড়া ফের ঘুরিয়ে দিতেই সে দমে গেল। এবং গজরাতে লাগলো, দেখে নেবো ইত্যাদি বলে।
আমি শান্ত কন্ঠে বললাম, তোমার ভাগ্য ভালো যে আমার হাতে চাবুক নেই, নইলে তোমার দফারফা হয়ে যেত আজ। বলেই ঘুরে আবার বাড়ীর পথ ধরলাম।
ব্যাপারটা ঘটে বিকেলবেলা, যখন রাস্তায় জনসমাগম বেশি থাকে। সেই জনগনের একাংশের কাছে ব্যাপারটা বেশ আমোদের হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারন এই প্রথম কোন নেটিভের কাছে এমন দাবড়ানি খেল কোন সাহেব। মুখে অনেকে সাহেবকে সহানুভুতি দেখাতে এগিয়ে গেলেও আড়ালে হাততালির সংখ্যাই বেশী ছিল।
তবু বাঙালী বলে কথা। তরুনদের অংশটা এই ঘটনায় যত আনন্দিত হয়েছে বয়স্কদের দল ততটা নাখোশ। বিশেষত খান্দানী বাঙালের একাংশ যারা আমার ঘোড়াটার ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত ছিল তারা বলতে লাগলো, সাহেবকে চটানো উচিত হয়নি, জলে বাস করে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করতে যাওয়া কোন কাজের কথা না।
আমি এসব কথা শুনে যুগপৎ আশ্চর্য এবং ব্যথিত হলাম। জলে বাস করছি আমরা নাকি শ্বেতাঙ্গরা? মোসাহেবী করে আর কতোকাল?
সেই রাতেই সাহেবদের বৈঠক বসলো কমিশনারের ঘরে। কি আলাপ হলো জানি না কিন্তু পরদিন আমার ডাক পড়লো কমিশনারের অফিসে। কমিশনার সাহেব একটু তোতলা। তিনি আমাকে দেখেই চিৎকার করে বললো, "তু তু তুমি কো কো কোন সাহসে একজন সম্মানিত ইংরেজের গায়ে চাবুক চালালে? তোমার কতোবড় শাস্তি হতে পারে ফৌজদারীতে জানো?"
আমি 'চাবুক' শুনে আশ্চর্য হলাম। কারন আমার এই ঘোড়ায় কখনো চাবুক লাগে না। তাই চাবুক রাখিই না সাথে। ঘোড়াটা ইশারায় ছুটে চলে। তবে বুঝলাম 'চাবুক' এসেছে বিলাতী সায়েবের ইজ্জত রক্ষার্থে। ডাক্তার ব্যাটা বেইজ্জতের ডরে বলতেই পারেনি তার বুকে একজন নেটিভ লাথি দিয়েছে, ফলে সে অন্য লাইনে অভিযোগ করেছে।
ঠান্ডা মাথায় বললাম, আমি ওনাকে মারিনি স্যার, উনিই আমার ঘোড়াকে বিনা কারনে চাবুক দিয়ে আঘাত করে আমাকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। আমি জানি ফৌজদারীতে গেলে আমার অভিযোগ গন্য করা হবে না। তাই আমার আত্মীয় বন্ধুরা এই ঘটনার ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়ানী আদালতে দশ হাজার টাকার মানহানি মামলা করার চিন্তাভাবনা করছে।
কমিশনার আমার ঔদ্ধত্য দেখে, "তু তু......তুমি......মা...মা...মা...মামলা........করবে..........." বলে তোতাতে তোতাতে বাক হারা হয়ে গেল রাগের চোটে। তারপর কোন মতে বললো, "তো.. তো.. তো.. তোমাকে শাস্তি পেতে হবে, দেখে নিও। ফৌজদারীতে সমর্পন করবো তোমাকে।"
আমি কুচ পরোয়া নেহী মনোভাব নিয়ে চলে এলাম। কিছুই হলো না। দুইদিন পরপর ইংরেজ সায়েব সুবারা মিটিং করলো কমিশনারের ঘরে। তার পরের সপ্তাহেই ডাক্তার সাহেব ছমাসের ছুটি নিয়ে ইংল্যান্ড চলে গেল। দশ হাজার টাকার মামলার রিস্ক নিতে চায়নি বোধহয়।
ঘটনাটা অনেকদিন আলোচিত হয়ে রইল এলাকায় এবং এই ঘটনার পর শহরে আমার তরুন ভক্তকুলের সংখ্যাবৃদ্ধি হলো আশাতীতভাবে।
.
[চলবে....]
নবীনবাবুর জবানিতে ডায়রির মতো ব্যাপার আসছে... উফফ আপনি পারেনও চমক দিতে! আর কী কী আছে ঝুলিতে বের করেন তাড়াতাড়ি
একটুখানি চাহিদা। নবীনের চাকুরির পদবী (মনে হচ্ছে সার্ভে সেটেলমেন্টের কেউ, সেক্ষেত্রে দপ্তরের অবস্থান), ডাবুয়ার ভূগোল, চট্টগ্রামে ঘটনাপ্রবাহে (যেমন সিভিল সার্জনের সঙ্গে এনকাউন্টারের) পাড়া/এলাকার নামোল্লেখ-- এই মানে কিঞ্চিত তথ্যের উপস্থিতি, অবশ্যই উপন্যাসের প্রাণপাখিকে শ্বাসরুদ্ধ না করেই, আপনার ক্ষমতা প্রশ্নাতীত, সবাই জানি
আমার মিস্টেক, গ্রেট মিস্টেক... নবীনবাবু ডিএম
সেক্ষেত্রে ভূমি প্রশাসনের কালেক্টরগিরির পাশাপাশি ফৌজদারি ক্ষমতাও তাঁর থাকার কথা...
নবীনবাবুর দফতর ছিল সম্ভবত বর্তমানের পুলিশ কমিশনারের পাহাড়ে। নিশ্চিত নই বলে এলাকার নাম লিখিনি। তবে তখনো পরীর পাহাড়ে কোর্ট বিল্ডিং গড়ে ওঠেনি। ওটা ছিল শহরের সরকারী ডিসপেনসারী। নবীনবাবুর সঙ্গে এনকাউন্টার হয়েছিল সম্ভবতঃ কোতোয়ালী এলাকার আশে পাশেই।
ভবুয়া জায়গাটা আমি নিজেও চিনি না, নবীনবাবু বলেছেন বলেই লিখেছি। ওটা পশ্চিমবঙ্গেই হবার সম্ভাবনা বেশী। কারন ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে ওখানেই ছিল তার প্রথম পোষ্টিং।
আমি তো কল্পনায় দেখছিলাম ডিসিহিলের সামনে বৌদ্ধমন্দিরের তেকোণা মোড়ে ঘোড়ায় ঘোড়ায় যুদ্ধ
ডিসি হিলের মাথায় তখনো ম্যাজিষ্ট্রেটের বাসাটা তখনো তৈরী হয়নি, তাই যুদ্ধটা ওখানে ঘটানো যায়নি
এগজ্যাক্টলি! (নন্দন কাননের দিকটায় তখন কী ছিলো?)
কোতয়ালির মোড় হয়ে ফিরিঙ্গিবাজারের দিকে যাওয়াটাই বেস্ট অপশন
নন্দনকানের দিকটা জঙ্গল ছিল। তবে ডিসি হিলের মাথায় এক জমিদারের বাড়ী ছিল নামটা মনে আসছে না।
ফিরিঙ্গীবাজারের দিকে গেলে লাভ আছে নাকি?
সে আর বলতে
বিরাট চমক ! আবারও পরের পর্বের জন্য মনের মধ্যে ব্যাকুলতা ।
আমি কেন যেন আগের পর্বগুলোর সাথে মিলাতে পারছিনা । কোথায় আটকে আছি বা আটকে গেছি বুঝতে পারছিনা কেন ? প্রশ্ন আমার নিজের কাছেই ।
আগের পর্বের সাথে যে মেলাতে পারছেন না সেটার দায় লেখকের। হুট করে নতুন চরিত্রের আগমনে আগের পর্বের ধারাবাহিকতা ক্ষুন্ন হয়েছে বলে মনে হলে দুঃখিত।
একটু ব্যাখ্যা দেই।
আগের ৫ পর্ব ছিল সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ এক ফরিদের গল্প। এই পর্ব থেকে শুরু হয়েছে সমসাময়িক একজন তরুণ ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট নবীনচন্দ্রের গল্প। দুজনের মধ্যে যোগাযোগ ঘটলে বিচ্ছিন্নতার সমস্যা মিটে যাবে বলে আশা রাখি। ঘটনার সময়কাল মোটামুটি কাছাকাছি ১৮৭১ থেকে ১৮৭৬।
সাথে থাকার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
লেখকের দায় বলে কিন্তু আমার মনে হয়নি, আমার অক্ষমতার দায় হিসেবেই নিয়েছিলাম । নীড় সন্ধানী, পথের সন্ধান দিয়ে আমাকে আলোয় আনবার জন্য আপনাকে অনেক
মেলা থেকে সুচরিত চৌধুরীর বইটা কিনলাম। সেখানে পুরো চট্টগ্রাম পাওয়া গেল।
কোনটা কিনেছেন, কিংবদন্তীর গল্প? আমি গত কয়েকমাস হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম বইটা। আমার একটা কপি দরকার। বাংলা একাডেমীর স্টল থেকে কিনেছেন?
বাংলা একাডেমীর স্টলে আছে। আমি আপনার জন্য এক কপি কিনে রাখবো?
এক কপি কিনে রাখতে পারলে কৃতজ্ঞ থাকবো। আমি আপনার কাছ থেকে পরে সংগ্রহ করে নেবো
ওকে। আমি কিনে রাখবো। আমার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েন।
থ্যাংকু
শুধুই হাসি?
নীড়দা, আপনার লেখার তারিফ করার লোক এই ব্লগে যথেষ্ট, তাই আমি আর ভিড় বাড়াতে চাইনা। শুধু এই টুকুই বলি, আপনি যেন দিন দিন নিজেকেই অতিক্রম করে চলেছেন, আপনার তুলনা শুধু আপনি। পরবর্তী পর্বের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছি....।
অতি কাঁচা গদ্যে লিখিত গল্পটা আপনাদের মতো বোদ্ধা লেখকের দৃষ্টিতে পড়েছে, ভীষণ আনন্দের ব্যাপার। তবে প্রতিটা পর্বে কিছু ভুল হয়ে যায়। ফলে আমার কাছে প্রত্যেক পরবর্তী পর্বই পাঠক নিন্দাতংকিত
নীড়দা,
একটা অন্যায় আবদার করি.। ব্যস্ততার কারণে প্রতিটা পর্ব পড়া হয়ে উঠছে না.। পড়ার মাঝে ছেদ গেলে পাঠকমনে যে দূরত্বের সৃষ্টি হয় সেটা কাটিয়ে ওঠা দুষ্কর।.। তাই যতটুকু লেখা হয়েছে সেটুকু কি এই অধমকে পিডিএফ করে ইমেইলে দেয়া সম্ভব? তাহলে পুরোটা পড়ে একটা মারকাটারি সমালোচনা করতাম
আপনার লেখার ধরন আমার বরাবরের প্রিয়, তাই এই অনুরোধটা আর না করে পারলাম না।
অনেকদিন পর দেখলাম আপনাকে। আপনার পরীদ্বয় কেমন আছে?
আপনার মেইল এড্রেসটা দেন। এখানে বা ফেসবুকে। সময় করে পাঠাবো। তবে মারকাটারি শুনে ভয় খাইছি।
নীড়দা' পড়ছি কিন্তুক।
না পড়লে তো আপনার নাম ছুটিয়ে দিতাম, উৎসাহ ছাড়া কি লেখালেখি হয়?
লাইক লাইক লাইক।
দারুন। অপেক্ষা পরের পর্বের
তিন তিন তিনবার লাইক দিলেন?? আপনার জন্য তিন কেজি শুকনা ধন্যা
এই পর্বটা অনেককককককক বেশি ভালো লাগলো নীড়ুদা
বিনয়ের অবতার হয়ে একটা কথা কই বদ্দা? ' ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ ক্লে, আমার কর্তা' মনে হচ্ছে এক নববধূ তার পতিদেবতার পরিচয় দিচ্ছে( অবশ্য এটা আমার নিজস্ব ভাবনা-ভুল হলে মাফ চাই ) বড়কর্তা' দিলে ভালু হয় মনে কচ্চে ' তোমাকে যে কোন জায়গায় যাবার প্রস্তুতি থাকতে..।' এই জায়গাটা এট্টু দেখবেন
কিছু টাইপো: তরুন/তরুণ
আকর্ষন/আকর্ষণ
প্রমান/প্রমাণ
কর্নকুহর/কর্ণকুহর
দুরবীন/দূরবীন
সম্ভাষন/সম্ভাষণ
কারন/কারণ
'তোতাতে' শব্দের মানে কী গো নীড়ুদা? আমি এটা আগে শুনিনি তাই জানতে চাইলাম।
পরবর্তী পর্ব জলদি ছাড়েনদি। সে পর্যন্ত ভালো থাকা হোক
নিদারুণ ব্যস্ততার মধ্যে ছিলাম বলে তোমার দেয়া সংশোধনীগুলা একিন করা হয়নি। খুব শীগগির করে নেবো। বানানোপদেশের জন্য ধন্যাপাতা। কর্তার জায়গায় বড়কর্তা লিখিনি, কারণ ওখানে বড় কর্তা হলো কমিশনার সাহেব। পরের পর্ব খুব বিলম্ব হইবে, আশু ব্যস্ততার কারনে পড়াশোনা করা যাইতেছে না।
হে প্রিয় লেখক, দীর্ঘদিন এই ব্লগে আপনার নতুন কোনো লেখা পড়ার সুযোগ আমাদের হয় নি।
মন্তব্য করুন