ইউজার লগইন

যাপিত জীবনের গল্প-৪

ছোট বেলাতেই সব কিছুতেই সহজে হার মেনে নেয়ার একটা প্রবণতা ছিলো। যে কোনো কারণেই হোক, যা কিছুই ঘটুক খুব সহজেই হার মেনে নিতাম। হয়তো কোনো ভেজালে যেতে চাইতাম না বলেই অথবা খুব ক্ষীণ শক্তির অধিকারী ছিলাম বলেই।

কিংবা কখনো কোন কারণে মনে হয়নি আমার জিততেই হবে। কোন কিছুতে জেতার চেষ্টাও করিনি কখনো।

খুব ভালো ছাত্র যে কখনোই ছিলাম না সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিংবা ভালো ছাত্র হবার চেষ্টা কখনো করিনি। কখনো ক্লাসে প্রথম হওয়া ও তাই কোনোদিন হয়ে উঠেনি। তবে বই পড়ার প্রতি আমার ছিলো প্রচন্ড ঝোঁক। সেটা নিজের পাঠ্য বইয়ের প্রতি নয়, বড় বোনদের বাংলা কিংবা ইংরেজী বইয়ের গল্পগুলোর প্রতি। ওই বইয়ের গল্প পড়েই বিকেলের সময়টুকু কাটিয়ে দিতাম ।

ভবিষ্যত বলা কঠিন , তবুও সব বাবা মা নিশ্চয় তার সন্তানকে নিয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্বপ্নটাই দেখে ।

তাইতো পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার মা ৩য় শ্রেনিতে পড়া আমাকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতেন। হয়তো কতদিন তিনি ভেবেছিলেন ছেলে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হবে। কে জানে মা আইনস্টাইনের কথা তখন জানতেন কিনা? জানলে হয়তো তার মতো কেউ হবো বলেই ভাবতেন।

মায়ের স্বপ্নটা হয়তো আরো বেশী রঙ পেত, যখন স্কুলের শিক্ষকরা আমাকে নিয়ে অনেক উচ্চাশার কথা শুনাতেন মাকে। আমি চেষ্টা করলে জেলাতে প্রথম হতাম কিংবা আর ও বড় কিছু ও হয়তো বলতেন। নয়তো শিক্ষকরা চলে যাবার পর মায়ের ক্রোধ মিশানো সেই শাসনে কেনো অপরিসীম তৃপ্তি দেখতে পেতাম।

সময়টা সবসময় এক তালে যায়না। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

সময়টা ১৯৯৪।
আমি তখন ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ছি। আমাদের পরিবার আহামরি ধনী না হলেও খুব স্বচ্ছল ছিলো। বাবার ব্যাবসা ছিলো ঢাকার বাংলাবাজারে। অফসেট মুদ্রণ মেশিনের একটা ছাপাখানা। ৩ ভাই ,৩ বোনের বড় সংসার হলেও তাতে ভালোমতোই চলে যেতো আমাদের। কিন্তু ১৯৯৪ সালে বাংলাবাজারের মুদ্রণ যন্ত্রের বিপ্লবে সেই স্বচ্ছলতা হারিয়ে গেলো অচিরেই। হাতে নগদ অর্থ না থাকাতে নতুন নতুন ব্র্যান্ড নিউ ছাপার মেশিনের ভজঘট শব্দের আড়ালে হারিয়ে গেলো বাবার পুরাতন আমলের মুদ্রণ মেশিন কিংবা আমাদের স্বচ্ছলতা। শুরু হলো আমাদের অনাহারে ও অর্ধাহারে দিন যাপন। অবশ্য এর কোনো কিছুই আমার মনে নেই, স্মৃতিতে ঝাপসা যতোটুকুই আছে , তাও মা কিংবা বড় ভাই বোনদের কাছ থেকে শোনা। অনাহার কিংবা অর্ধাহার এর কিছুই আমার মনে নেই। হয়তো আমার কখনোই অনাহারে থাকতে হয়নি , হয়তো মা নিজের জন্য রাখা খাবারটুকু থেকে অনেকটা আমায় দিয়ে দিতেন, যা তিনি এখনো করেন। নয়তো আমার এসব মনে রাখার মতো বয়েস হয়নি। খাবার প্রতি কিংবা কোনো কিছুর প্রতি লোভ আমার কোন কালেই ছিলোনা।

যতোটুকু পেয়েছি ততটুকুই যথেষ্ট মনে হয়েছে সর্বদা।

সব মনে না থাকলেও কিছু কছু বিষয় এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে আমার। যা কোনদিন ও হয়তো ভুলবোনা। আমি বদলে যাওয়ায় বিশ্বাস করিনা, কিংবা কারো বদলে যাওয়া রুপ সহজে মেনে নিতে পারিনা।

বাবা বাড়িতে আসতেন খুবই কম। তবুও বাবা যখন বাড়িতে আসতেন বাবার সাথে বাজারে গেলে দেখতাম স্থানীয় দোকানদারদের ব্যস্ততা। যেনো আমি তাদের কতো আপন জন। আমাকে কতো রকমে যে তারা তাদের আদর দেখাতো!!! কিংবা কখনো ছোটোখাটো প্রয়োজনে যখন ই বাজারে যেতাম তাঁদের কাছ থেকে পেতাম আন্তরিক (!) সহযোগিতা । ২ -৩ মাসের মধ্যেই সবাই কেমন ভোজবাজির মতো পাল্টে গেলো। মনে হলো সবার চোখেই বুঝি ঘুম্পাড়ানি মলম লাগিয়ে দিয়েছিলো কেউ। এতো আন্তরিক মানুষগুলো ও কেমন যেন অপরিচিতের মতো মনে হতে লাগলো। তাঁদের চোখের চাহনিতে মনে হতে লাগলো আমি এ গ্রামের নতুন আসা কেউ। তখন এসবের কারণ বুঝতাম না। এখন বুঝি। তাইতো এখন প্রাণ ভরে হাসি।

আহারে! মানুষ। কি খুঁজিস তুই সারা জনম?

মনে পড়ে স্বর্গত সেই দোকানীর কথা। যিনি ব্যক্তি হিসেবে যথেষ্ট ভালো ছিলেন। বাবার বাড়িতে না থাকার মাস গুলিতে তিনিই এক প্রকার অভিভাবক ছিলেন। প্রতি মাসেই তিনিই নিজ দায়িত্বে আমাদের গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী নিজ দায়িত্বে পাঠিয়ে দিতেন। আরো কোনো কিছু লাগবে কি না সেই খোঁজ নিজ দায়িত্বে নিতেন।
বাবার ব্যবসার পতনের পর সেই দোকানীর কাছেই গিয়ে কী না বাকিতে ১০ কেজি চালের জন্য ২ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেছি! দোকানী সম্ভবত একবার ও আমাদের দিকে ফিরে ও তাকায় নি। দীর্ঘদিনের সম্পর্কের সুবাদে অবশেষে তিনি কি মনে করে যেনো ৫ কেজি চাল দিয়েছিলেন। বাকি ৫ কেজি উনি উনার ব্যবহারে পুষিয়েছিলেন কিনা মনে নেই। তবে যতদূর মনে পড়ে আমি আজ পর্যন্ত ঐ দোকানে বাকীতে আর কিছু কিনিনি। তখনো সুনীলের কবিতা শোনা হয়নি,

শোনা থাকলে তখন হয়তো বলতাম, “দেখিস একদিন আমরা ও”

বাবা আজ স্বর্গত। সেই দোকানী ও। তবে উত্তরসূরী হিসেবে এখন তার উত্তরসূরীর ব্যবহার দেখি আর হাসি সেই দিনের কথা ভেবে ।

আহ! সময় কতো দ্রুতই না বদলায়। কখনো প্রতিকূলে কিংবা কখনো বা অনুকূলে। কারো ক্ষেত্রে হয়তো সর্বদাই অনুকূলে, কারো হয়তো সর্বদাই প্রতিকূলে। ভাগ্যিস! আমার একটা সময় প্রতিকূলে না গেলে হয়তো জীবনের অনেক কিছুই শেখা হতো না।

পোস্টটি ১১ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

তানবীরা's picture


কঠিন সত্য লিখেছেন ভাই

নেয়ামত's picture


হুমম।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.