নিবেদিতা'এর ব্লগ
তিন অধ্যায়
১)
ছাদের আকাশে নক্ষত্রের কনফারেন্স। কিন্তু আজ আমার নক্ষত্রে মন বসছে না। মনটা ভারী হয়ে আছে। চয়নকে ফিরিয়ে দিলাম। চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে ফিরে গেল ও। ফেরানো সহজ হত না। তাই ওকে জানালাম অগ্নির কথা। বললাম-‘তুমি ভুল বুঝেছ, আমি নই, বরং অগ্নি তোমাকে পছন্দ করে। তোমাকে বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবি নি আমি কখনো। ’
ঘোরগ্রস্তের মতন চলে গেল ছেলেটা। চয়নকে আমার মত অগ্নিও ভালবাসবে এটাই তো স্বাভাবিক। আমি দুঃখ পেয়েছি কিন্তু রাগ করিনি। সেই কবে থেকে আমি আর অগ্নি একই রকম, অবিকল। সব হাসিকান্না, পছন্দ-অপছন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছি দুজন। কিন্তু কিছু ব্যাপার কখনোই কারো সাথে ভাগ করা যায় না। কিছু অধিকার বুঝে নিতে হয় নয়ত ছেড়ে দিতে হয়। অগ্নি আমার এত কাছের, আমার আরেকটা স্বত্তা, তাই অধিকারটা ছেড়ে দিলাম। অগ্নির চোখের কোলে মেঘ দেখার চেয়ে চয়নকে ভুলে থাকা আমার জন্য অনেকটা সহজ।
২)
ফেরারি
অপলার মুখে রোদ পড়ছে। বিরক্তিতে বাঁকা ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেছে ওর। কোলের উপর খোলা বইটার পাতায় চোখ রাখলাম আমি। শেষ লাইনটা খুঁজে পাচ্ছি না, আতিপাতি করে খুঁজতে শুরু করলাম। এবার দুলুনির বেগে অপলার মাথাটা আমার কাঁধে হেলে পড়ল। শেষ লাইন খোঁজা বাদ দিয়ে বইটা ব্যাগে ভরে রাখলাম। ট্রেনের দুলুনিতে আমারও ঝিমুনি ধরে যাচ্ছে। কামরা ফাঁকা। অপলার ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে দেখি রোদ সরে গেছে, কিন্তু একগোছা চুল মুখের উপর পড়ে আছে, হাওয়ায় দুলছে। আলতো করে চুলটাকে সরিয়ে দিতেই চোখ খুলে ফেলল ও। শাড়ির আঁচলটাকে গুছিয়ে নিয়ে কেজো গলায় বলল
-কটা বাজল?
-পৌনে দুটো।
-কতদূর এলাম বল তো?
-আরো ঘণ্টা দুয়েক লাগবে বোধ হয়, মধুপুর ছাড়িয়ে এসেছি।
ব্যাগ থেকে খাবার, জলের বোতল বের করছে অপলা। হঠাৎ মনে পড়তেই বলল
-ওষুধগুলো খেয়েছিলে?
-ওহ্ একদম ভুলে গেছি...দাও তো
বিরক্ত চোখে তাকালো ও। আমি তাড়াতাড়ি গিলে ফেললাম ওষুধগুলো।
খাবার খাওয়ার পর অপলা ম্যাগাজিন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। এদিকে আমি উসখুস করছি কথাটা বলব বলে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ও বলল
-বলে ফেলো
আমি খুক খুক করে একটু কাশলাম।
-ইয়ে…তেমন বিশেষ কিছু না অপলা।
অপরাজেয়
অপরাজেয়,
আকাশ পাতাল ভেবেও তোমার কোনো নাম ঠিক করতে পারি নি আজও।
সবচেয়ে সুন্দর, একটা মিঠে নাম দেব তোমাকে, কথা দিলাম।
কিন্তু যে নামেই তোমায় ডাকি না কেন,
আবলুশের দেরাজে আগলে রাখা আমার সব চিঠিতে
তোমার জন্য রইবে এই সম্বোধন- অপরাজেয়!
তুমি এসে আমার একরত্তি উঠোন জুড়ে ঘুরে বেড়াবে, শুনবে না কোনো বারণ,
শিশির ধোয়া ঘাসে পা ডুবিয়ে হেঁটে যাবে একাদশীর চাঁদ দেখতে,
তখনও একই নামে তোমায় ডেকে বলব- ‘আমায় সাথে নেবে না?’
আজকাল বড় ভয় হয়,
সোঁদা মাটির ঘ্রাণের সাথে বারুদের আভাসটুকু পাবে বলে,
তুমি আসার আগেই হয়ত টুটে ফুটে যাবে অমল ধবল পালখানি।
তবু আঁকশি দিয়ে স্বপ্নগুলো হাতের মুঠোয় এনে রাখি, খসে পড়ার আগেই।
অপরাজেয়,
তোমার জন্য বিপ্লবের কুঁড়ি সামলে রেখেছি,
তুমি এলেই পাপড়ি মেলে আগুন রঙের সেই ফুল হেসে হবে কুটিকুটি।
যে যুদ্ধে পারি নি যেতে, যে যুদ্ধে গেছি হেরে, রয়ে গেছে যে যুদ্ধ অসমাপ্ত,
চোখ বুজে বলে দিতে পারি তুমি এলেই হবে শেষ তার,
কান পেতে শুনব জয়ঢাক, তোপধ্বনি বিজয়ের!
তাই এই রংচটা, ফিকে দিনগুলোতে প্রহর গুণে যাই, তোমার অঙ্কুর বয়ে চলি,
তুমি আসবে বলে বারুদের গন্ধ থাকি ভুলে।
ছেলেবেলার লাল শালুক
(১)
বাবার সরকারি চাকরির কারণে পুরো পরিবারের পায়ের তলায় সর্ষে দেখছি সেই ছেলেবেলা থেকে। অবশ্য ফি বছর নতুন শহরে নতুন স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে চোখেও সর্ষেফুল দেখতে পেতাম! একগাদা নতুন মুখ চারপাশে, সারাক্ষণ ড্যাবড্যাব করে দেখছে আমাকে! এটা খুব নিয়মিতই হত! তাদের সাথে গলায় গলায় ভাব হতে না হতেই আবারো লোটাকম্বল নিয়ে নতুন শহরে রওনা হওয়া!
তারপর যাযাবর জীবন শেষে পঙ্গপালের মতন একসময় সপরিবারে আজব শহর ঢাকায় ঠাঁই নিলাম আমিও। একে একে সব পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে পেলাম, হরিহর আত্মা দুয়েকজন যারা ছিল তাদেরও পেয়ে গেলাম। তবু আবছা আবছা কিছু মুখ মনের মুকুরে উঁকি দেয় এখনো, নামগুলো পেটে আসে তো মুখে আসে না। কিছু নাম মুখে আসে কিন্তু তাদের মুখের আদলটাও মনে পড়ে না। খুঁজে বেড়াই সেই মানুষগুলোকে, অজান্তেই!
(২)