ফেরারি
অপলার মুখে রোদ পড়ছে। বিরক্তিতে বাঁকা ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেছে ওর। কোলের উপর খোলা বইটার পাতায় চোখ রাখলাম আমি। শেষ লাইনটা খুঁজে পাচ্ছি না, আতিপাতি করে খুঁজতে শুরু করলাম। এবার দুলুনির বেগে অপলার মাথাটা আমার কাঁধে হেলে পড়ল। শেষ লাইন খোঁজা বাদ দিয়ে বইটা ব্যাগে ভরে রাখলাম। ট্রেনের দুলুনিতে আমারও ঝিমুনি ধরে যাচ্ছে। কামরা ফাঁকা। অপলার ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে দেখি রোদ সরে গেছে, কিন্তু একগোছা চুল মুখের উপর পড়ে আছে, হাওয়ায় দুলছে। আলতো করে চুলটাকে সরিয়ে দিতেই চোখ খুলে ফেলল ও। শাড়ির আঁচলটাকে গুছিয়ে নিয়ে কেজো গলায় বলল
-কটা বাজল?
-পৌনে দুটো।
-কতদূর এলাম বল তো?
-আরো ঘণ্টা দুয়েক লাগবে বোধ হয়, মধুপুর ছাড়িয়ে এসেছি।
ব্যাগ থেকে খাবার, জলের বোতল বের করছে অপলা। হঠাৎ মনে পড়তেই বলল
-ওষুধগুলো খেয়েছিলে?
-ওহ্ একদম ভুলে গেছি...দাও তো
বিরক্ত চোখে তাকালো ও। আমি তাড়াতাড়ি গিলে ফেললাম ওষুধগুলো।
খাবার খাওয়ার পর অপলা ম্যাগাজিন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। এদিকে আমি উসখুস করছি কথাটা বলব বলে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ও বলল
-বলে ফেলো
আমি খুক খুক করে একটু কাশলাম।
-ইয়ে…তেমন বিশেষ কিছু না অপলা।
-গৌরচন্দ্রিকা বাদ দাও।
অপলা ক্ষেপে যাচ্ছে। এখন ওকে কি করে বলি কথাটা! মিথ্যে কথা বলে ওকে নিয়ে যাচ্ছি শুনে আরো রেগে যাবে। ওর ভাই সুস্থই আছে, নতুন করে কিছু হয় নি। শুধু অনেকগুলো দিন নিজেদের মত করে কাটানো যায় নি বলে এই ফন্দি আঁটা! এমনি ঘুরতে যাব বললে ছেলেমেয়েরা ছাড়বে না। ছেলের বৌ বলবে-‘অফিস থেকে ছুটি পাব না মা, বাবুকে কে দেখবে?’ ছেলে বলবে- ‘বাবা, বাজার করার সময় পাব না, শুক্রবারেও আমার অমুক জায়গায় যেতে হবে’ মেয়ে বলবে- ‘আমার এ সপ্তাহে পরীক্ষা, মা তুমি যেও না, বাবা ঘুরে আসুক গে’ ।
আর অপলা নিজে বলবে- ‘বুড়ো বয়সে এসব ভীমরতি ছাড়ো তো!’
আগে এমন ছিল না। একটা সময় অনেক বেড়িয়েছেন দুজনে মিলে, ঘুরতে খুব পছন্দ করত অপলা। তারপর সংসারের ফাঁদে পড়ে কেমন যেন হয়ে গেল। ছেলেমেয়ে দুটো স্কুলে যেতে না যেতেই ব্যস্ত হয়ে গেল ও। ওদেরকে বড় করেছে, এখন আবার ছেলের ছেলেকে নিয়ে মহাব্যস্ত। রিটায়ার্ডমেন্টের পর আমি পানিতে পড়ে গেলাম। আগে অফিসের কাজ নিয়ে সময় কেটে যেত। এখন আর সময় কাটে না। কতকাল নিজেদের সময় দেই নি। মাঝেমাঝে সন্দেহ হয়, অফিস নিয়ে একটু বেশি ব্যস্ত হলে প্রথম দিকে অপলা রাগ করত, ঝগড়া করত, কিন্তু আমি পাত্তা দিতাম না। এখন সেটার শোধ নিচ্ছে না তো? কিছুই তো সহজে ভুলে না ও। নইলে কতবার আমি বললাম “চল একটু বেড়িয়ে আসি”। মুখ ঝামটে বলেছে- ‘কোলের বাচ্চাটাকে রেখে যেতে বলছ কোন আক্কেলে?’ আমি মিনমিন করে বলেছি-কেন বাচ্চার মা তো আছেই, দিদা না থাকলে কি এমন হবে?
-কেঁদেই সারা হবে বাচ্চাটা, দিনরাত আমার কাছে থাকে।
দিন বদলে গেছে। এখন অপলাই আমাকে সময় দিতে চায় না, শেষরাতে ঘুম ভেঙ্গে তেষ্টা পেয়ে যায়, প্রায়ই মনে হয়-এই বুঝি মরে গেলাম। মেঘে মেঘে তো বেলা কম হল না! একগাদা রোগ বাঁধিয়ে বসেছি। মুঠোয় মুঠোয় ওষুধ খাই প্রতিবেলা। যদ্দিন আছি একটু নিজেদের সময় দিলে ভাল কাটবে। কিন্তু অপলাই বাঁধ সাধে।
-কি এমন চিন্তায় পড়ে গেলে বল তো? ব্যাপারটা কী?
ওর ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম, মুখে চিন্তার ছাপ পড়েছে অপলার। কিন্তু বয়সের ছাপ পড়েছে কি? আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি ওকে। শুধু চুলগুলি একটু ধূসর হয়ে এসেছে, বলিরেখা নেই তেমন। অপলা আগের মতই সুন্দর আছে। আমার কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল-কী হল তোমার?
-তোমাকে নিয়ে বেড়াতে বেরুলাম কতদিন পর, পুরোনো দিনগুলি মনে পড়ে যাচ্ছে। তোমার কেমন লাগছে? শেষ কবে গিয়েছিলাম মনে আছে?
প্রথম পরিচয়ের লাজুক হাসি ওর ঠোঁটে।
-মনে পড়ে না। এর মানে আমরা বেড়াতেই যাচ্ছি, ভাইয়ের কিছু হয়নি!
-বুঝে ফেললে?
-সেতো আগেই বুঝেছি
-কি করে? আমি অবাক হলাম খুব।
অপলা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল-তোমার অপকর্মগুলো সবই আমি টের পেয়ে যাই
-তাহলে তুমি লক্ষীমেয়ের মত চলে এলে যে? বৌমার ছুটি নেই, বাবুকে কে দেখবে? মেয়ের পরীক্ষা?
-আর পারি না...বুঝলে, আমারও একটু বিশ্রাম দরকার।
অপলার গলায় রাজ্যের ক্লান্তি ঝরে পড়ল। ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলাম আমি। ট্রেনের জানলা দিয়ে লালচে আকাশটা দেখা যাচ্ছে। আমার কাঁধে ওর মাথাটা আবার হেলে পড়ল। আমাকে অবাক করে দিয়ে মৃদুস্বরে অপলা বলে উঠল-আমরা যদি আর না ফিরি?
মনে পড়ছে বহু যুগ আগের কথা। এমন করে প্রথমবারও বায়না করেছিল। তখন ছিল কাজের পাহাড়। বায়নাটা পূরণ করতে পারি নি। আজ আর কাজ নেই, পিছুটান নেই, নেই ফেরার তাড়া।
সবাই মনে করে, তারে ছাড়া জগতটা অচল হয়ে পড়বে। আসলে যে জগত ছাড়া ব্যক্তি অচল সেইটা কেউ বুঝতে চায় না।
যাই হোক, লেখাটা দারুণ ঝরঝরে!
ধন্যবাদ আপনাকে!
আনকমন থিম, ভাল লাগল।
নিজের বা নিজেদের একটুখানি নিভৃত সময়ের যে মূল্য তা বুঝতে অনেকটাই দেরি হয়ে যায় আসলে, অথবা জানলেও কিছু করার থাকে না
সময় বয়ে যায়, বেলা শেষে আর কিছুই করার থাকে না।
ধন্যবাদ মর্ম।
চমৎকার!
সবাই মনে করে, তারে ছাড়া জগতটা অচল হয়ে পড়বে। আসলে যে জগত ছাড়া ব্যক্তি অচল সেইটা কেউ বুঝতে চায় না।
যাই হোক, লেখাটা দারুণ ঝরঝরে!
ধন্যবাদ!
চমৎকার লেখা,
আপনার কাছে আরও নিয়মিত লেখার আবদার রইল।
ভালো থাকুন, অনেক ভালো। সবসময়।
মন্তব্য করুন