নিভৃত স্বপ্নচারী'এর ব্লগ
একাত্তরের বিদেশি সুহৃদঃ দুঃসময়ের সারথি
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি সুহৃদদের অবদান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ব্লগ ও ফেসবুকে সিরিজ আকারে আমার পোষ্টকৃত লেখাগুলো এ বছর দুই মলাটের মধ্যে বাঁধাই হয়ে পাঠকদের সামনে আসার সুযোগ ঘটলো। অবশেষে প্রকাশিত হলো “একাত্তরের বিদেশি সুহৃদঃ দুঃসময়ের সারথি” গ্রন্থটি।
অসংখ্য ধন্যবাদ “আমরা বন্ধু”র সহব্লগারদের, যাদের নিরন্তর উৎসাহ লেখাটা সম্পন্ন করতে আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আরও ধন্যবাদ আমার সেইসব বন্ধুদের যাদের আন্তরিক সহায়তা আমার এই উদ্যোগটিকে সফল করার পেছনে বিশেষ ভুমিকা রেখেছে।
আসছে একুশে বইমেলায় চিরদিন প্রকাশনীর ৬৮ নম্বর স্টলে বইটি পাওয়া যাবে। সবাইকে বইমেলায় আমন্ত্রণ রইলো।
নোনাজলের ইতিহাস
এখনও বিষাদমাখা রাত্তিরের ঘোর অন্ধকার কাটেনি এতটুকু,
অগণন নক্ষত্রবীথির মৌনমেলা ভেঙে
পৃথিবীর আলো ফোটেনি কোথাও;
এখনও অনেকটা পথ বাকি।
অনন্ত মহাকাল ছুঁয়ে পরিযায়ী ইচ্ছেগুলোর
অপমৃত্যু ঘটছে অহর্নিশি,
খুব গোপনে বুকের ভেতরে বসতি গেড়েছে পাহাড়ি শঙ্খচূড়-
অথচ কি নিশ্চিন্ত বসবাস তার!
প্রোথিত গ্রন্থিতে নীলাভ ব্যথা লুকিয়ে দায় মেটাতে চায়-
পরিত্যক্ত জীবনের।
বসন্ত দিনগুলোর নির্বাসন হয়েছে সেই কবে! তবু তারেই খোঁজে-
পোড়ামাটির গন্ধমাখা অস্ফুট বৃষ্টির ঘ্রাণে, শরতের শেষ বিকেলে।
অকস্মাৎ চমকটা কাটতেই চোখে পড়ে-
কেউ কাছে নেই;
তখন নিঃসঙ্গ গাঙচিল একাকী ফিরে চলে- নীড়ে।
বহমান নদীর গর্ভে বিবর্ণ পাথরে
প্রাচীন শিলালিপি খুঁজতে গিয়ে শুনতে পায়-
নিবিড় নৈশব্দের বুক চিরে হাওয়ায় ভেসে আসা কান্নার গান,
কে যেন পেছন থেকে বলে- পথের শেষে দাঁড়িয়ে কী খোঁজ তুমি?
দুঃস্বপ্নের ঘণ্টাধ্বনি
জানালা গলে বিচ্ছিরি গন্ধটা ঘরময় ছড়িয়ে পড়লে পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠলো। বৃষ্টি হলেই এই উৎকট গন্ধটা ঝিল থেকে ডানা মেলে আকাশে, তারপর দৈত্যের মত ছুটে এসে আশপাশের পুরো এলাকা গ্রাস করে নেয়। তখন টিকে থাকাই দায়। ঘরের ভেতরে গুমোট অন্ধকার। কেমন যেন আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছে ঘরের কোণে কোণে, চারপাশের টিনের বেড়া আর চালের সাথে। বৃষ্টিটা থেমে গেলেই একটা ভ্যাঁপসা গরম ছাড়ে। কী অসহ্য! ইলেক্ট্রিসিটি নেই এক ঘণ্টা হল। বাঁশের সাঁকোর মোড়ে দু’টো কুকুর একটানা চেঁচাচ্ছিল। কে যেন ধমকে উঠল- অ্যাই চুপ, যাহ!
-উফ! আর তো পারা যায় না- মহিদুলের কণ্ঠে বিরক্তি।
-কী পারা যায় না? মহিদুলের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করল জয়নাব। ছেলেকে তালপাখায় বাতাস করছিল সে।
-গন্ধে তো বমি হওয়ার দশা। এইহানে আর থাকা যাইবো না।
কান্নার রাত
বিষাদ বিষাদ-
অনন্ত বিষাদ এসে ছুঁয়ে যায় স্মৃতির খেলাঘর;
দু’ঠোঁটের ভাঁজে বিদ্রূপের হাসি,
কটাক্ষে অচেনা রহস্যময়তা
আর, অভিশপ্ত নিষ্ঠুর সময়ের দহন।
দেয়ালে সাঁটানো ছবিটা- স্থির, ম্লান;
মায়ায় জড়ানো ইতিহাসের সাক্ষী।
নীরব রাত্রির অশ্রুত অন্ধকারে
ছায়ার মত কেবলই খুঁজে ফেরা
ক্ষয়ে যাওয়া অতীতের একমুঠো জোছনা প্রহর,
রূপালি কঙ্কণ পড়া বিহঙ্গী, কলকল হাসির ঝংকার;
তারপর, সীমাহীন অন্ধকারে মিশে যেতে যেতে
বিলীন হয়ে যাওয়া আবার, রাত্রির মাঝে।
বিষাদের সব ঘোর লাগা কালরাত্রিতে-
নিস্তব্ধতা গ্রাস করে নেয় ভেতর-বাহির,
অস্থিরতার চাদর মুড়ি দিয়ে কেটে যায় সময়,
স্মৃতির চোখের নদীটাও জলশূন্য বেলাভূমি;
নির্বাসন শেষে বুকে বাজে-কান্নার রাত।
ধূসর গোধূলিঃ প্রথম স্বপ্নপূরণ
অনেক প্রতীক্ষার পর অবশেষে এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে আমার প্রথম উপন্যাস ‘ধূসর গোধূলি’। আমার প্রথম স্বপ্নপূরণ। প্রকাশকঃ সৈয়দ রহমতুল্লাহ রাজন, র্যামন পাবলিশার। বই প্রকাশে সার্বিক সহযোগিতা এবং প্রচ্ছদের জন্য দুরন্ত দুরা ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বইটি ১৪ই ফেব্রুয়ারী মেলায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। পাওয়া যাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ১৯৭-১৯৮ স্টলে। এবি’র সকল বন্ধুদের বইমেলায় আমন্ত্রণ।
রাতজাগা পাখি
আজ সকালে হিম কুয়াশার প্রাচীর ভেঙে
এক চিলতে রোদ্দুর হেসেছিলো আমাদের বারান্দায়;
আজ সকালে আকাশটা ভেসেছিলো আবার- আলোর বন্যায়,
আর আমি সেই ভোরের নৈসর্গিক আলোয় স্নান শেষে দেখি-
তোমার মুখে ছায়া ফেলেছে লোভী সূর্য, ওর বুকের নিরেট
আলোর রেখা কপাল-গাল ছুঁয়ে নেমে এসেছিলো তোমার ঠোঁটে,
অকস্মাৎ এক অচেনা পোর্টেট হয়ে উঠেছিলে তুমি।
আজ সকালে একমুঠো সোনালি রোদ্দুর উঁকি দিয়েছিলো
আমাদের জানালায়, কাঁচের শার্শিতে জমে থাকা শিশিরগুলো
সব উবে গিয়েছিলো তখন, আমাদের বুকের মাঝে জমাট বাঁধা
অভিমানগুলো মুছে দিতে সে হেসেছিলো আরেকবার,
সে কি জানতো অভিমানী তোমাকে ছুঁয়ে দিয়েছিলো বিরহী রাত?
তোমাকে নিমেষেই মানবী করে তুলেছিলো আরেকবার।
কাল রাতে একমুঠো স্বপ্ন ভিড়েছিলো আমাদের উঠোনে,
কাল রাতে অপার্থিব এক আলোয় ভরে গিয়েছিলো আমাদের ঘর,
রিনিঝিনি কাঁকনের সুরে স্বপ্নেরা পাখা মেলেছিলো নীল চাঁদোয়ায়,
এমনও দিনে তারে বলা যায়...
শেষ বিকেলে বসেছিলাম বারান্দায়। শিল্পী অজয় চক্রবর্তীর গানের কিছু কথা মনে গুনগুন করে বাজছিলো, সেইসাথে ভাবছিলাম আজ কোথাও বেড়াতে যাব। এই চমৎকার মেঘ-আদুরে বিকেলে আমার একমাত্র কন্যাটিকে নিয়ে ঘুরে আসবো তার কোন অচীনলোক থেকে। কিন্তু তুমি তা হতে দিলে না। একেবারে বিনা নোটিশে তুমি এসে সবকিছু ভণ্ডুল করে দিলে। এটা কি ঠিক হল?
চারিদিক থেকে যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসলো, তখুনি ঝড়ের বেগে তুমি এলে। ঘন কাল কেশরগুচ্ছ ছড়িয়ে, প্রবল ঘুর্ণিতে আমায় ভাসিয়ে নিলে। আমার এই ছোট্ট করিডোরটুকু, যেখানে বসে আমি বর্ণিল মেঘেদের আনাগোনা দেখছিলাম, সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে বলেছিলে,
-চল আমার সাথে।
আমি তোমায় শুধালাম- হে দুরন্ত যৌবনা আমাকে তুমি কোথায় নিয়ে যাবে?
-কোথায় আবার! এমন দিনে কি ঘরে থাকা যায়! চল আমার সাথে- দূরে, অন্য ভূবনে; তোমার অতি চেনা জগতে।
রুপালী ছায়াপথ (সমাপ্তি পর্ব)
একঘেয়ে কর্মমূখর দিনগুলোর চাপে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলো অনিরুদ্ধ; তারপর এখানে এই ভাবনাবিহীন সময়গুলো দারুণভাবে উপভোগ করছিলো। সকাল-দুপুর-বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা আসে। একেকটা ক্ষণ যেন উড়ে চলে যায়।
এখানে জীবন কোন এক অদৃশ্য সূতোয় বাঁধা। ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন, হাসি-কান্নার বাঁকে হারিয়ে যায় ক্ষুদ্র স্বত্ত্বার চাওয়া পাওয়াগুলো। আজ সারাদিন চা বাগানেই পার করেছে অনিরুদ্ধ। চা শ্রমিকদের সাথে। বাগানের নারী শ্রমিকদের কচি পাতা উত্তোলনের দৃশ্যের কথা এর আগে বিভিন্ন লেখা পড়ে জেনেছে, লোকমুখে শুনেছে। আজ নিজেই দেখছিলো। ক্লান্তিকর সারাদিনের পর কত সামান্যই প্রাপ্তি ওদের! সারাদিন কিভাবে যেন কেটে গেল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে আসে।
রুপালী ছায়াপথ (প্রথম পর্ব)
দিনগুলো একেকটা এমনি করেই ফুরিয়ে যায়।
কাজের চাপে পিষ্ট হওয়া একঘেয়ে ক্লান্তিকর বলয় থেকে বেরিয়ে একটু অবসর খোঁজে উদভ্রান্ত মন। তারপর একদিন হঠাৎ অবসর মিলেও যায়। তখন কেবল মনে হয় দূরে কোথাও ঘুরে এলে নেহায়েত মন্দ হয় না!
বসন্তের শেষ বিকেলে অনিরুদ্ধ যখন শ্রীমঙ্গল ষ্টেশনে নামলো ঘড়িতে তখন পাঁচটা বাজে। ততক্ষণে চা বাগানের ফাঁকে ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা শেডট্রিগুলোর ছায়ারা পূবদিকে হেলে পড়েছে। আর, নতুন গজিয়ে ওঠা কচি চা-পাতাগুলো বিকেলের সোনালী আলোয় ঝলমল করছিলো। পাহাড়ের ঢালে চা বাগানগুলোতে অদ্ভুত আলো ছায়ার খেলাটা জমে উঠেছিল বেশ।
গল্পঃ ভাই
অনেকক্ষণ ধরে মোবাইলে রিং বেজে চলেছে। অপু মনে মনে ভাবে, ‘এত রাতে আবার কে ফোন করলো? এই মোবাইলটা হল আরেক যন্ত্রণা, বাথরুমে গিয়েও শান্তি নেই!’ হাতমুখ ধুয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসে। ফোনটা হাতে নিতেই দেখে তপুর ফোন।
-কি রে তপু, তুই এত রাতে!
-দাদা, তুই কবে বাড়ি আসবি?
-কেন রে? মাত্র তিন মাস আগে বাড়ি থেকে ফিরলাম।
-মা খুব অসহায় হয়ে পড়েছে রে। সারাক্ষণ তোর কথা বলে।
-কেন? মা’র কি হয়েছে?
-মা’র শরীরটা ভাল যাচ্ছে না রে।
-তুই আছিস না, মা’র দিকে খেয়াল রাখতে পারিস না?
-তা তো রাখি, কিন্তু মা তোকে খুব মিস করে। বলে, অপুর চাকরি করার দরকার নাই, ওরে বাড়ি আইতে ক।
-তুই মাকে বুঝা তপু।
-আমারও তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে, দাদা।
-কি রে! তোদের হল কি? তুইও কি মা’র মত অবুঝ হলি?
গন্তব্য (শেষ পর্ব)
রতন আবার ভাইকে প্রশ্ন করে;
-ভাই, কতা কওনা ক্যান? মায় আর আমার লগে কতা কইবো না?
কলিমের খুব কান্না পায়। অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলায়। ভাইকে কাছে টেনে নিয়ে বলে,
-মানুষ মইরা গ্যালে আর ফিরে আহে নারে ভাই। আমগো মায় আর কতা কইবো না।
রতন কাঁদতে কাঁদতে বলে- তইলে মেডিকেলে বইয়া কইছিলি ক্যান যে মায় ভাল অইয়া যাইবো?
কলিম উত্তর দিতে পারেনা। ভাইয়ের কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে খাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। রতনকে কি বলবে ও? নিজের বুকে পাথর চেপে ভাইকে সান্ত্বনা দিয়েছিলো। মায়ের শেষ সময়ের করুণ চোখের চাহনি বুকের ভিতর আলোড়ন তোলে। রাত্রির শেষ প্রহরে মায়ের অন্তিম মূহুর্তের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের ছবিটা ভুলতে পারে না। যাকে দু’দিন আগেও মা মুখে ভাত তুলে দিয়েছে সেই অবুঝ ছোটভাইটিকে কাল রাত্রে বলতে পারেনি- ওদের মা আর বেঁচে নেই।
গন্তব্য (প্রথম পর্ব)
একটা অদ্ভুত হাহাকার আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো পুরোটা সময়। অস্তিত্বহীনতার অমোঘ নিয়তির প্রহরগুলো দারুণভাবে রেখাপাত করেছিলো ছোট্ট দু’টি স্বত্বাজুড়ে। প্রবল মনের জোরে কিশোর বয়সের সীমা ছাড়িয়ে হঠাৎ যেন বড় হয়ে উঠেছিলো মাত্র এগারো বছরের কলিম। সময়ের প্রয়োজনে নিজের থেকে কেবল দুই বছরের ছোট ভাই রতনের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলো। আর কোন এক অলৌকিক উপায়ে মায়ের অন্তিম সময়ের ভারী দেহটিকে বহন করার শক্তি অর্জন করেছিলো। প্রকৃতিই যেন সবকিছু নির্ধারণ করে দেয়, মানুষ কেবল প্রকৃতির সীমারেখায় সমান্তরালভাবে নিরন্তর ছুটে চলে চেনা গন্তব্যে।
ধূসর গোধূলিঃ ৩৬ - ফন্দি
মফিজ মিয়া মুখে যতই বলুক মেয়েজামাইকে টাকা দেবে না, মেয়ে শেফালির দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত আর পণ রক্ষা হয়না। একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে টাকার ব্যবস্থা করে দেয়। শেফালি চলে যায় শ্বশুরবাড়ী। যাবার সময় জামাই গদগদ ভাব নিয়ে শ্বশুরের পা ছুঁয়ে সালাম করে।
-আব্বা, আমগো লইগা দোয়া কইরেন।
মফিজ মিয়া সবই বোঝে। মনে মনে ভাবে মেয়েটা তবু সুখে থাক।
সারাদিন পর সাজু বাড়িতে ঢোকে। মফিজ মিয়ার রক্ত ওঠে মাথায়। খেঁকিয়ে ওঠে সে। হারামজাদা! সারাদিন কই থাহস? বাপের হোডেলে খাস আর টো টো কইরা ঘুইরা বেড়াস?
সাজু কোন উত্তর দেয় না। নিরবে ঘরে ঢুকে যায়। মফিজ মিয়ার রাগ আরও চড়ে যায়
-কি রে? কি কই কানে ঢোকে না?
-কাম আছিলো। সোজাসাপ্টা উত্তর দেয় সাজু।
-সারাদিন বাইরে কি কাম তোর? ঘোড়ার ঘাস কাটতে গেছিলি? দুই পয়সা আয়ের তো মুরোদ নাই।
ধূসর গোধূলিঃ ৩৫ - হঠাৎ বৃষ্টি
সন্ধ্যার ঠিক পর পরই খেলার পাট চুকিয়ে ঘরে ফেরে সুবল। পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে কেউ কোথাও নেই। মাঝখানের বড় ঘরের টেবিলের উপর টিমটিম করে জ্বলছে কুপিবাতি। সুবল সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বাহিরের দিকে চোখ পড়তেই দেখে উঠানের দক্ষিণ প্রান্তে খেজুর গাছটার নিচে তাফালে খেজুরের গুড় জ্বাল হচ্ছে। মা, কাকু, কাকীমা উনুনের কাছে বসে আছে আর গোপালদা খরকুটো এগিয়ে দিচ্ছে। সুবল সোয়েটারটা গাঁয়ে জড়িয়ে উঠানে নেমে আসে। তাফালের আগুনের আলোয় উঠানের অনেকটাই আলোকিত। সুবল পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে কাকার গলা জড়িয়ে ধরে। তারাপদ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, প্রিয় ছোট ভাতিজাকে দেখে দু’হাত ধরে সামনে নিয়ে আসে। কাকুর কোলের মধ্যে ডুবে যেতেই সুবল হারিয়ে যায় ওমের রাজ্যে। তাফালের চারপাশ থেকে উঠে আসা টকটকে লাল আগুনের শিখা থেকে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশে।
ধূসর গোধূলিঃ ৩৪ - সংঘাত
শীতের তীব্রতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ঘন কুয়াসায় ঢেকে থাকে সুর্য্য অনেক বেলা অবধি। রাস্তার দু’পাশের ক্ষেতে শিশিরে ভেজা গাঢ় সবুজ খেসারীর ডগা আর কাঁচা হলুদ সরিষার ফুলগুলোকে অনেক সতেজ লাগে। শীত অয়নের সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। সকালে সদ্য ঝরানো খেজুরের রসের মজাটাই অন্যরকম। সেই সাত সকালে উঠে মন্টুমামা খেজুরের রস নামিয়ে নিয়ে আসে, রান্নায় বসানোর আগে মা কিছুটা কাঁচা রস ওর জন্য রেখে দেয়। মা’র ব্যস্ততা সেই সকাল থেকেই। কাকভোরে উঠে কাজে লেগে পড়ে, প্রতিদিনই কোন না কোন পিঠা তৈরি করে মা।