রুপালী ছায়াপথ (সমাপ্তি পর্ব)
একঘেয়ে কর্মমূখর দিনগুলোর চাপে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলো অনিরুদ্ধ; তারপর এখানে এই ভাবনাবিহীন সময়গুলো দারুণভাবে উপভোগ করছিলো। সকাল-দুপুর-বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা আসে। একেকটা ক্ষণ যেন উড়ে চলে যায়।
এখানে জীবন কোন এক অদৃশ্য সূতোয় বাঁধা। ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্ন, হাসি-কান্নার বাঁকে হারিয়ে যায় ক্ষুদ্র স্বত্ত্বার চাওয়া পাওয়াগুলো। আজ সারাদিন চা বাগানেই পার করেছে অনিরুদ্ধ। চা শ্রমিকদের সাথে। বাগানের নারী শ্রমিকদের কচি পাতা উত্তোলনের দৃশ্যের কথা এর আগে বিভিন্ন লেখা পড়ে জেনেছে, লোকমুখে শুনেছে। আজ নিজেই দেখছিলো। ক্লান্তিকর সারাদিনের পর কত সামান্যই প্রাপ্তি ওদের! সারাদিন কিভাবে যেন কেটে গেল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে আসে।
শেষ বিকেলে দুজনে বসে পাহাড়ের ঢালে। সম্মুখে পাহাড়ের গা বেয়ে প্রবাহিত সেই অগভীর লেক। স্বচ্ছ টলটলে পানি! পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা লেকটির মাঝখানে একটি জলের ধারা বয়ে চলেছে কেবল। সামনে তাকালে অনেকদূর পর্যন্ত সবুজের হাতছানি। লেকটির ওপারে দল বেঁধে হেঁটে চলেছে অল্প বয়সী খাসিয়া মেয়েদের একটি দল।
-আপনার কথাই ঠিক। জায়গাটা খুব সুন্দর।
-কক্সবাজারের চেয়েও?
-আমি আসলে এভাবে তূলনা করি না। দু’টোর সৌন্দর্য দু’রকম।
-শুনেছি আপনি দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারে আছেন; এতদিন এক জায়গায় বোর লাগে না?
-না! তবে সাগরের বিশালতায় নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হয়।
-সে তো আমরা সবাই।
-পাহাড়, সাগর, সবুজ! এ কারণেই আমাদের দেশটা এত সুন্দর।
-জানেন, এই জায়গাটা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার কথা ভাবতেও পারিনা। এখানকার পাহাড় ঘেরা সবুজ আর আঁকাবাঁকা এই শান্ত লেক; আর ঐ যে দূরে দেখা যায় খাসিয়া পল্লী! ওদের সহজ সরল জীবনধারা। কেমন যেন মায়া ধরে গেছে।
-চলে যাবার দরকারই বা কি? থেকে যান এখানেই।
-চাইলেই কি থাকা যায়? বাবার চাকরি আর মাত্র ছ’মাস, চারপর এখানকার পাট চুকাতে হবে।
-এখানে কোথাও স্থায়ী বসতি গড়ে নেন না!
-বাবার তেমন ইচ্ছে নেই। তিনি তার নিজ গাঁয়েই ফিরে যেতে আগ্রহী। এজন্য তাঁকে দোষ দেইনা, শেকড়ের কাছে ফেরার ইচ্ছাটা সবারই প্রবল থাকে। আপনার নেই?
-আমার তো কোন শেকড় নেই, আমি হলাম ছন্নছাড়া, যাযাবর মানুষ। অনিরুদ্ধ হাসে।
বীথিও হেসে ফেলে। তারপর বলে,
-আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পেরেছি।
হঠাৎ চমক লাগে অনিরুদ্ধর।
-কি করে? আমাদের আগে কখনো দেখা হয়েছে বলে তো মনে পড়ছে না!
-আপনার হয়ত মনে নেই। ব্যস্ত মানুষ, এই নগণ্য বীথিকে মনে থাকার কথাও না। লাজুক হাসি হেসে বলে বীথি।
-আমার মনে হয় আপনার কোন ভুল হচ্ছে। আপনাকে দেখলে ভুলে যাবার কথা না।
-আমি কি বলেছি অতি সম্প্রতি আমাদের দেখা হয়েছে? সে অনেক আগের কথা। আমি তখন বেশ ছোট। নীলাপুদের ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আপনি ওখানে প্রায়ই আসতেন। সেখানেই দেখা। মনে আছে তখন আপনাকে অনিদা নামেই ডেকেছিলাম।
-অনেকেই আমাকে ও নামে ডাকতো।
বীথি আবার হাসে।
অনি কিছুক্ষণ ভাবে। তারপর বলে,
-এবার বোধহয় চিনতে পেরেছি, আপনি তখন অনেক ছোট ছিলেন।
বীথি হেসে বলে -আপনার বয়সটাও তেমন বেশি ছিল না তখন!
-হুম, সময় তো আর থেমে থাকে না!
-ছোটবেলাটাই আসলে ভাল সময়। অনেক মন খারাপ করা মুহূর্তে ছোট্টবেলার স্মৃতি মন ভাল করে দেয়।
-আপনাকে দেখি আমার রোগে পেয়েছে!
-কি রকম?
-নস্টালজিয়া।
-ওটা কি আপনার একার? বীথি হেসে বলে।
-আমি প্রায়শঃই ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতির মধ্যে ডুব দেই।
-একটা কথা মনে পড়লো হঠাৎ।
-কি?
-ক্যারাম খেলার কথা?
অনি হঠাৎ হো হো শব্দ করে হেসে ফেলে। -কি নাছোড়বান্দা মেয়ে ছিলেন আপনি! সেবার আমাদের অনেক ভুগিয়েছিলেন।
বীথি কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অনির দিকে। এখানে আসার পর এই প্রথম অনিকে প্রাণখুলে হাসতে দেখলো।
-আপনি খুব ভাল কবিতা লিখতেন। একজন আপনার খুব পছন্দ করতো।
হঠাৎ অনি চুপ হয়ে যায়। চকিতে একটা নাম ভিড় করে মনের কোণে।
-আপনি কি এখনো কবিতা লিখেন?
বীথির কণ্ঠ শুনে চমক ভাঙে।
-নাহ! এখন আর লেখা হয়না।
-কেন? খুব ভাল লিখতেন। নীলাপুর কাছে আপনার অনেক কবিতা ছিল, আমি পড়েছিলাম সেগুলো। নীলাপু খুব সুন্দর আবৃতি করতো। আমি ওঁকে দেখেই আবৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম।
-আজ অনেকদিন পর আবৃত্তি শুনতে বড় ইচ্ছে করছে। শোনান না একটা।
-এখনই?
-হুম। এই চমৎকার পরিবেশে আপনার কণ্ঠে আবৃত্তি মনে হয় জমবে ভাল। নিন শুরু করুন-
“আমাকে একটি কথা দাও যা আকাশের মতো
সহজ মহৎ বিশাল,
গভীর; - সমস্ত ক্লান্ত হতাহত গৃহবলিভুকদের রক্তে
মলিন ইতিহাসের অন্তর ধুয়ে চেনা হাতের মতন,
আমি যাকে আবহমান কাল ভালোবেসে এসেছি সেই নারীর।
সেই রাত্রির নক্ষত্রালোকিত নিবিড় বাতাসের মতো:
সেই দিনের - আলোর অন্তহীন এঞ্জিন চঞ্চল ডানার মতন
সেই উজ্জ্বল পাখিনীর - পাখির সমস্ত পিপাসাকে যে
অগ্নির মতো প্রদীপ্ত দেখে অন্তিমশরীরিণী মোমের মতন।“
অনি যেন নিমেষেই ডুবে যায় কবিতায়। চোখে ভেসে ওঠে অসীম সাগরের মত গভীর দু’টি চোখ। যে চোখই ছিল একসময় ওর কবিতা লেখার প্রেরণা। অমন চোখের মাঝে হারিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে। পাহাড়ি ঝর্নার মত কলকল হাসির ঝংকার! সেই চমৎকার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। তখনই হঠাৎ মনে হয়- ওর ভাগ্যটা তো চৈত্র মাসের শুকনো খড়খড়ে মাঠ! রোদে পোড়া তপ্ত মাটি পানিতে সিক্ত হয়না কখনো।
কবিতা শেষ করে বীথি তাকিয়ে থাকে আনমনা অনির দিকে। একটু পর বলে,
-বোধহয় আপনার মন খারাপ করে দিলাম।
অনি হঠাৎ ফিরে আসে বাস্তবে।
-না না, আপনি খুব ভাল আবৃত্তি করেন। জীবনান্দের খুব ভক্ত, তাই না?
-হুম। ওঁর বেশীর ভাগ কবিতা আমার মুখস্ত।
দিনগুলো এমনি করেই ফুরিয়ে যায়। ভাললাগার ছুটির সময়গুলোও যেন দৌড়ে পালায়। চা বাগানে আজকেই অনির শেষ রাত। রাত ফুরলেই তাকে চলে যেতে হবে চেনা গণ্ডিতে। বাংলোর খোলা বারান্দায় বসে আছে অনি। সন্ধ্যার পরে ধীরে ধীরে রাত বাড়ে, গাঢ় অন্ধকারেরা সরে গিয়ে বড় গোল থালার মত চাঁদ ওঠে আকাশে। সামনের খোলা চত্বরটুকু ঝলমল করে জোছনার আলোয়। সবুজ চা গাছগুলোর প্রান্ত ছুঁয়ে চাঁদের আলো নেমে এসে ঘাসে ছাওয়া মাঠ ছাড়িয়ে বাংলোর বারান্দায় ছড়িয়ে পড়েছে। অনির খুব আফসোস হয় চমৎকার সময়টা কেন এত দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে।
-একা একা এখানে বসে কি ভাবছেন?
বিথীর কন্ঠ শুনে ফিরে তাকায় অনি। তেমন কিছুনা, চন্দ্রালোতে স্নান করছিলাম।
-চমৎকার বলেছেন। এমন জোছনায় স্নান করা মন্দ নয়, তবে একা একা ভাল লাগার কথা নয়।
-এইতো আপনি এসে পড়লেন।
-আমি না হয় ক্ষনিকের সঙ্গী হলাম, তারপর? এবার একাকীত্ব ঘুচানোর ব্যবস্থা করুন।
অনি মৃদু হাসে। চাইলেই কি সবকিছু করা যায়? আমার তো মনে হয় এই বেশ ভাল আছি, মুক্ত স্বাধীন জীবন। ইচ্ছেমত যেদিকে খুশি চলে যেতে পারি, এই স্বাধীন চলাফেরার সুযোগ হাতছাড়া করার কোন মানে হয়?
বীথিও হাসে।
-যাক, আপনার স্বাধীন জীবন সুন্দর আর আনন্দময় হোক। আপনি তো কাল চলে যাচ্ছেন, আবার কি আমাদের দেখা হবে?
-আমাদের দেশটা খুব ছোট। দেখবেন ঘুরে ফিরে কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যাবে। তাছাড়া আমার ঠিকানা তো আপনার জানাই থাকলো, কক্সবাজারে চলে আসেন।
-ভাল বলেছেন। হয়ত এমনি করেই কোথাও দেখে হয়ে যাবে। আচ্ছা, ফেরার পথে আপনার সাথে কি নীলাপুর দেখা হবে?
-না। কেন বলুন তো?
-কতদিন নীলাপুকে দেখিনা! আপনি আসার আগেরদিন ফোনে কথা হচ্ছিলো, আপনার কথা খুব বলছিলেন।
-কি কথা?
-আপনি কেমন মানুষ, আপনার যেন ঠিকমত যত্ন নেই, এই আর কি।
-যেমন অঞ্জন, তেমনি নীলাপু।
-ক্ষতি কি? এমন শুভাকাঙ্ক্ষী পাওয়া তো ভাগ্যের কথা। তবে কি জানেন- এত ভাল একজন মানুষ নীলাপু, অথচ ওনার জীবনটা অনেক কষ্টের। খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে, নিজের কষ্টের কথা কাউকে বুঝতে দেয়না।
অনি কিছু বলে না, কেবল কক্সবাজারে বিদায়ের মুহূর্তে নীলাপুর অশ্রুসিক্ত মুখচ্ছবিটা ওর ভেসে ওঠে চোখে।
-একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
-করুন না!
-না থাক। যে কথা কষ্ট বাড়ায় তা না শোনাই ভাল।
-না শুনে কি করে বুঝলেন কষ্ট বাড়বে?
-কার যে কখন কিসে কষ্ট বাড়ে বলা কঠিন। আমরা বরং অন্য কথা বলি।
অনেকক্ষণ কেউ কোন কথা বলেনা। চারদিকে সুনসান নিরবতা। অনিরুদ্ধ মনে মনে ভাবে- আমার সকল দুঃখ-কষ্ট অন্যদের যেভাবে ভাবিয়ে যায়, মাঝে মাঝে তা নিতান্ত লজ্জায় ফেলে দেয়।
সকাল দশটা। অনি দাঁড়িয়ে আছে ষ্টেশনে। চট্টগ্রামগামী ট্রেন এসে পৌঁছেছে কিছুক্ষণ হল। অনির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বীথি। আজকে অবশ্য ও না এলেও পারতো। তবুও নিতান্ত ভদ্রতাবশে এই চলে আসা। আর অন্যপাশ থেকে একজনের অনুরোধ অবশ্য ছিল, যা ওকে অনির সাথে ষ্টেশন পর্যন্ত টেনে নিয়ে এসেছে।
-এরপর যখন শ্রীমঙ্গল আসবেন তখন হয়ত আর কেউ আপনাকে এভাবে বিরক্ত করবে না, অযাচিতভাবে বিব্রতও করবে না। বীথি হঠাৎ বলে উঠলো।
অনি হাসে।
-আমি বিব্রত হবো? তেমন তো কিছু ঘটেনি বরং আমি এসে আপনাদের অনেক কষ্ট দিয়ে গেলাম।
-হ্যা, কষ্ট তো দিয়েছেনই। এই যে চমৎকার কিছু সময় পার করে চলে যাচ্ছেন, এগুলো মনে পড়ে হয়ত কষ্টই পাব। নীলাপুর সাথে দেখা হলে বলবেন- আমি ভাল আছি, বেশ ভাল।
অনি হঠাৎ থমকে যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর ট্রেনে উঠে বসে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। একটু একটু করে দূরত্ব বাড়ে দু’জনার। বীথি দাঁড়িয়ে থাকে স্টেশনে। একসময় ট্রেনটি বাঁক দিয়ে হারিয়ে যায় সবুজ পাহাড়ের আড়ালে।
পিছন ফিরে দেখাঃ
১। একলা চলার পথে
২। একাকীত্বের অবসরে
গুড ওয়ান।
ধন্যবাদ বাউন্ডুলে।
শেষ করে দিলেন। ভালো লাগলো!
ধন্যবাদ শান্ত।
সুন্দর একটা গল্প।
ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।
মন্তব্য করুন