মেঘবন্দী (১৩) ... আকাশ জুড়ে বৃষ্টি আর বৃষ্টি ভেজা মন, মন চাইছে থাকুক ভাল আমার আপনজন... / জেবীন
আকাশ জুড়ে বৃষ্টি আর বৃষ্টি ভেজা মন, মন চাইছে থাকুক ভাল আমার আপনজন...
জেবীন
- আরে! এমন হয় নাকি!
- কেন হবে না? করলেই হয়।
- বুঝো না কেন, হানিমুনে যায় কেবল দু’জনে দু’জনকে একদম নিজেদের মতো করে জানতে, সারাজীবনের জন্যে কিছু মধুর স্মৃতির অভিজ্ঞতায়।
- হ্যাঁ, তাই তো চাইছি। কিছু দারুন আনন্দময় সময় কাটাতে, যাতে আমাদের আপনজনেরা থাকবে আমাদের সাথে, আর আমি তুমি সবার মাঝেও কেমনতরো থাকি তা ভালো করে জানতে এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর কি হতে পারে বলো?
- ধ্যাত! তাই বলে ২৫/৩০জনের মিছিল নিয়ে আমরা হানিমুনে যাবো!! কখনোই না, একেবারেই না!
খুব তো রাগ দেখালে কিন্তু হানিমুনটা হলো ঠিক যেমনটা প্ল্যান করেছিলাম আমি। দু’জনার মা-বাবা, ভাই-বোন তাদের স্ত্রী-বর, ছেলেমেয়েরা সবাইকে নিয়ে কুয়াকাটাতে ৬দিন ঘুরে আসা। লঞ্চে করে পটুয়াখালী, সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে কুয়াকাটা। লঞ্চের ১১টা কেবিন ভাড়া করতে হলো সবার জায়গা পেতে। ঢাকার নানানদিক থেকে সবার সদরঘাট পৌছাঁতে সেকি ঝক্কি। তবে রাতভর ডেকে বসে আড্ডা, সেকি মজার। কারোরই ঝিমানির উপায় নাই, এরপর গান শুরু, একজন ধরে তো অন্যজন তাতে তাল ধরে, কেউ সুরে তো বাকিরা বেসুরো। তোমার মুখে “আজকের এই নিশি ভালোবাসি ভালোবাসি” গানটা শুনে সবার সেকি ঠাট্টা! গানের শুরুতে ফোন দিলে আমাকে, কোন কথা নয় শুধুই গান শুনাতে। সেই অতরাতে ফোনের স্ক্রীনে তোমার নাম ভেসে উঠতেই প্রচন্ড অবাক হয়েছিলাম। কোন কথা হয়নি, শুধুই তোমার গলায় এই গান কিযে বিমোহিত করেছিল। হঠাৎ শুনতে পেলাম, “ওহ! এই সময় বৃষ্টি! আরে, চলো চলো সবাই নীচে চলো!”
আলো-আধারিঁতে ছবি তোলা হয়েছে অনেক। গাড়িতে কুয়াকাটা যাবার বাজে রাস্তাটার ঝাকুঁনিতেও দুষ্টুমি চলছিল প্রায় সবার মাঝেই, যদিও মা-বাবা’রা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন পথ চলার কষ্টে। মোটেলে পৌছেঁ একটু বিশ্রাম নিয়েই সৈকতে ছুট সবার। সবার সামনে কি করে আল্লাদিপনা করবে ভেবেই কূল পাচ্ছিলেন না, লজ্জায় তো শেষ হয়ে যাবে একসাথে ছবি তুলতে গেলে, এমনটাই বলেছিলে না? কিন্তু দেখো বৌকে টিউবে ভাসিয়ে তারপাশে দাঁড়ানো তুমি, কিবা পানির তোড় থেকে উঠে আসার সময়কার একে অন্যকে ধরে ভারসাম্য রাখার চেষ্টারত ছবিগুলো সবার কাছে প্রশংসনীয় হয়েছে।
আমার সবকিছুতেই না বলা চাই তোমার। যখন বললাম, মাসে দু’মাসে অন্তত একবার দিনদু’য়েকের জন্যে শ্বশুড়বাড়ি থাকতে এসো। শুনে সেকি ক্ষোভ! যতই বুঝাতাম, কেন আমার মা-বাবা’র কি শখ নাই জামাইটাকে ক্ষনিকের অতিথি না রেখে বাড়ির ছেলের মতোই পেতে। একটাই তো তুমি এই বাড়ির ছেলে বলো আর জামাই। হুহ! তোমাকে বুঝানো আমার কম্মো না। শ্বশুড়বাড়িতে এতো মিশতে পারা তোমায় দিয়ে হবে না । তোমার বুঝ তুমিই বুঝো। এই যেমন এখন, বাড়ির প্রান যেন। দিন তো দিন রাতগুলো যখন থাকো মাতিয়ে রাখো। শ্বশুড়ের সব্জি বাগানের ব্যাপারেও বিস্তর আগ্রহ তোমার।
একা থাকতে ভয় পাই, লোকজন পরিবেষ্টিত থাকার শখ আমার, কি করে যে উল্টোপুরান তোমার পাল্লায় পড়লাম, যে কিনা ঘরভর্তি ভাইবোন তাদের বাচ্চাকাচ্চায় অতিষ্ট। যেই জানলে ওমন পরিবার আমার খুবই আকাঙ্ক্ষার, তেলেবেগুনে জ্বলে সাফ বলে দিলে, বিয়ের পর প্রথম সুযোগেই আলাদা ফ্লাটে টোনাটুনির ছিমছাম সংসার পাতবে। আর এখন, বৌ নিয়ে সবার সাথে তো আছোই বরং মেজআপুকে ঢাকা বদলি হয়ে আসায় তাকেও পাশের ফ্লাটে নিয়ে এসে তুলেছো। সবার সাথে জমজমাট একটা পরিবার, ঠিক যেমনটা আমার পছন্দ।
- দেখো দেখো কি হাস্যকর লাগছে ওদের, একই রঙের কাপড় পরে ঘুরছে, যেন স্কুল ড্রেস!
- যাহ! দারুন দেখাচ্ছে ওদের, ম্যাচিং কাপল! কোথাও বেরুনোর সময় এমন করে গেলে বেশ লাগে। দেখো না, বুটিকগুলো কি সুন্দর জুটি করে পোশাক তৈরী করে ইদানিং।
- এই তোর সাথে আমার সবটাতেই অমিল কেন রে!! ভুলেও এমন আশা কখনোই করবি না।
একগাল হাসি নিয়ে ওর রাগ দেখতাম, খুব আদরে আর কপট রাগ দেখানোতেই তুই তোকারি চলে ওর। মাঝে মাঝে তো আপনিও বলা শুরু করে। তবে আমার কথাই যে শিরোধার্য ওর। সেই যে রিয়ানের বিয়েতে বৌয়ের মেরুন শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে আর্টিস্টির মেরুন শার্টটা যখন পরলো, সবার প্রশংসায় লজ্জাই পেয়ে গিয়েছিল।
আমাকে আক্ষরিক অর্থেই যেন পড়তে পারতে। একদিন কি বলতে চাই আচঁ করেই যেন, হুশিয়ারী হাকঁ, “খবরদার, বিয়ের চার/পাচঁ বছরের মাঝে এই চিন্তা মাথায় আনবি না, মোটেই না!” কিন্তু আমি জানতাম, বিয়ের বড়জোর বছর দুয়েকের মাঝেই তোমার সন্তান ঘর আলো করে আসবেই।
আচমকা ঝাকুঁনি দিয়ে বাস থেমে যেতেই ভাবনার ঘোরটা কেটে গেলো আর খেয়াল হলো বৃষ্টির ছাটেঁ প্রায় ভিজে একসার। কি অবাক কান্ড, কানে লাগানো মোবাইলের এফএম রেডিওতে গান বাজছে - “আমি বৃষ্টি চাই, আমি বৃষ্টি চাই বারবার, সুখে যন্ত্রনায় এই ঠিকানায় বাচঁবার”! তাই বলে এই শীত মৌসুমে বৃষ্টি!!
পাশ থেকে বলে ঊঠলে,
- সরে এসো এপাশে, ঠান্ডার ধাত আছে তোমার, আর আমার চাদরটা জড়িয়ে নেও।
- লাগবে না।
- নাও, সিগ্রেটের গন্ধ পাবে না, খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি আর আমার ...
- হ্যাঁ, মনে আছে তোমার গায়ে ঘামের গন্ধ হয় না। তাও নিবো না, বৃষ্টিটা ভালো লাগছে।
আমাদের সাথে বৃষ্টিটা কি অদ্ভুত ভাবে জড়িয়ে আছে, সেই তোমার বিয়ের দিনও হুট করে বৃষ্টি এসে বরযাত্রাটাই কেমন করে দিলো অন্যদিকে গায়ে জ্বর নিয়েও আমি বারান্দা দিয়ে হাত-পা ভিজিয়ে চলছিলাম। আবার সেই অনেকদিন আগে, সেই যে আমরা রাতে রিক্সা পালটে পালটে সেই মহাখালী থেকে বকশিবাজার এলাম, সারাটা পথ ভিজে ভিজে। বকছিলে আমায় কিন্তু তাও সাথে রইলে। কত বৃষ্টিই তো আসবে কিন্তু সেদিনের মতো অসাধারন বৃষ্টি আর কখনো আমাদের ভিজিয়ে দিবে না। সেই রাতেই তো তোমার আম্মার নার্ভাস ব্রেক ডাউন হলো দ্বিতীয়বারের মতো। এই মেন্টাল ব্রেকডাউনের কারনে উনি কথায় কথায় অস্থির হয়ে ঊঠেন, অকারনেই ভয়ে কাপঁতে থাকেন, হাই ডোজের এ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ঔষধ ফ্রেনক্সিট আর লোসিটা খেতে হতো উনাকে, সেসবের সাইড এফেক্টও নেহায়েত কম ছিলো না। ডাক্তারের পরামর্শে সারাক্ষন কেউ না কেউ পাশে থেকেছো তোমরা, বেড়াতে নিয়ে গেছো সব আত্নীয়-স্বজনের কাছে। পাক্কা মাস ছয়েক লেগেছিল উনার সেরে উঠতে। এসময়ে তোমাকেও অনেক অস্থিরতায় পেয়ে বসেছিল, মা’কে কি সুস্থ করে তুলতে পারবে আদৌ, এই চিন্তায় অসহায় হয়ে পড়তে মাঝে মাঝে। আজকের এই বৃষ্টির ছাটঁ কত কি মনে করিয়ে দিচ্ছে। এমনতর বৃষ্টিতে কত রাত চিরকুট লিখতাম আমরা, মেইল করে দিতাম সাথে কোন গান বা ছবিসহ। কথা হয়েছিল যত যাই হোক প্রতিমাসে একটা করে হলেও চিঠি দিবো নিজেদের। সময়ের ব্যস্ততায় কতো কি পালটে গেছে, কিন্তু তুমি তোমার কথায় কমিটেড থেকেছো। নিজেদের কোন নিবিড় ভাবনা নয়, চিঠিগুলোতে এখন শুধু ছবি আর সেসব নিয়ে টুকটাক তথ্য দেয়া থাকে।
বৃষ্টির ছাটঁ বেড়ে গেছে, নিস্তব্ধতার মাঝে এফএম রেডিওতে বেজে চলছে বাপ্পা’র গান, “কখনো যদি দেখা হয় কোন দেশে, কখনো যদি দেখা হয় কোন বাসে, হঠাৎ মিলে যাওয়া দু’টো টিকেট, অনাকংখিত দু’টো সিট, পাশাপাশি দু’জন বলো কি হবে তখন, কি হবে তখন...”
- নাও চা, চিনি কম দেয়াই আছে।
- থ্যাঙ্কস।
- শোন, কিছু বলার নাই তোমার? কিছুতো অন্ততঃ বলো।
- কিছু যে বলার নাই, বলার মানুষটাকেই যে হারিয়ে ফেলেছি।
হাওয়া-বাতাসে পাওয়া নয় জ্বাজল্যমান এক মানুষের হাত ধরে হাটতে নেমে ছিলাম, সাজিয়েছিলাম স্বপ্নতরী। একটা চিরকুট দিয়ে যে জানান দেয়, যা কিছু ছিলো সেটা ফানুশ হয়ে উড়ে গেছে, মিলিয়ে গেছে আকাশে, তাকে বলার মতো কি আর থাকতে পারে। মা হুট করে বৌ বেছে নিয়েছেন, সাতদিনের মাঝেই বিয়ে করেছো, সেই সিদ্ধান্তে না বলার পরিস্থিতি তৈরী করা তোমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, এটা আমাকে নিজে থেকে বুঝে উঠতে হয়েছে কষ্টে হাবুডুবু খেতে খেতে, একবারও সামনে আসোনি। হ্যাঁ, সবই মনে আছে, সময় সব কষ্টকে চাপা দিতে পারে কিন্তু মুছতে নয়। তাই চাপা পড়া সব চাপাই থাক।
মগবাজারে নামার আগে কিছুই না বলে দিয়ে গেলে এক চিরকুট। আমায় যেতে হবে আরো কিছুদূর, তাই বসে রইলাম হাতে নিয়ে ওটা। মলিন একটা কাগজ, খুলে দেখি আমারই গোলাপী খাতার পাতা। পড়তে গিয়ে মনে পড়লো, বলেছিলাম এর সাথে মিল দিয়ে বাকিটা লিখে দিও, ফেরত দেওনি আর।
অঝোরধারার বৃষ্টিকালে দিব্যচোখে
দেখি আমাদের বৃষ্টিস্নান
ঝিরিঝিরি হাওয়া দেয়া মাতাল জোৎস্নায় ভেসে যাওয়া
রাতে পাশে থাকে তোমার নিঃশব্দ অবস্থান
কোকিল ডাকা ওই বসন্তের উদাস দুপুরে
আধোভাঙ্গা ঘুমে এলোচুলে
ডুবানো ওই হাতের স্পর্শ সোহাগী করে তোলে
প্রতিটা নতুন ভোরই হয় তোমার অনুভবে
কাজের ক্লান্তিতে বুজেঁ আসা
চোখে ভেসে ওঠো প্রশান্তির তুমি
চোখ বুজিঁ দিনের শেষে তোমার
স্বপ্ন আকাঁর প্রত্যয় নিয়ে
এমনই করে প্রতিটা মূহুর্ত, প্রতিটা বেদনার ছোয়াঁয়
অহেতুক ক্ষনই তোমায় সামনে আনি।।
...............................................................
এমনই আছি
নিজেকে নিঃশেষ করার এই অদ্ভুত
যজ্ঞে মেতে অহর্নিশি
যখনই বুঝাই নিজেকে
নই কেউ তোমার পাশাপাশি আর
বলাটাই সার
দুঃখবিলাসী আমিটাকে আরো
আরো সুতীব্রভাবে কষ্টের অতলজলে ফেলি
পলেপলে অস্বীকার করে নিয়তির পরাজয়
বিষাক্ত আনন্দে মনকে আরো
আসক্ত করতে করতে ভাবি
নাই বা হলাম আমি তোমার
তুমি তো আমার।।
কিছুই না কইয়া সবাই খালি টিপসই দিতাছে! .।.।
আমার পছনদের লেখা

থ্যাঙ্কস তাতা'পু
এই গল্পের চরিত্রগুলা আমারো পছন্দের, অনেকদিন মাথায় ছিলো, তেল-ঝোল লাগায়ে বৃষ্টির সাথে মিল দেয়াইলাম আর কি।
পছন্দ হইছে
মন্তব্য করুন