মেঘবন্দী (১৬) ... বৃষ্টির অশ্রুজল / লীনা ফেরদৌস
বৃষ্টির অশ্রুজল
লীনা ফেরদৌস
একদম কাক ভেজা হয়ে ওয়ানস্টপ মলে ঢুকল শায়লা, কয়েকদিন থেকেই ঝুম বৃষ্টি, একদম থামাথামির নাম নেই, যাকে বলে পারফেক্ট শ্রাবণ মাস। রাস্তা ঘাটে পানি উঠে একাকার, খুব অসুবিধায় না পড়লে কারোই আজ বের হবার কথা না। অফিস থেকে বেরিয়ে কোন রিক্সা পাওয়া যাচ্ছিল না, একটা বুড়ো রিক্সাওয়ালাকে চাচা টাচা ডেকে অনেক কষ্টে তিনগুণ বেশী ভাড়া দিয়ে এসেছে সে।
বাড়ীতে একদম বাজার নেই। অফিস বেরুনোর সময় খালা বার বার বলে দিয়েছেন
“বাজার না আনলে কিন্ত খাওয়া নাই, ফ্রিজ একদম খালি, কতদিন ধরে বাজার কর না । আমি মুদি দোকান থেকে এটা সেটা এনে কোন রকম চালাচ্ছি। পুশ্পী মুরগীর মাংস ছাড়া ভাত খেতে চাচ্ছেনা, প্রত্যেক বেলায় তার এক বায়না। আজ কিন্ত
বাজার না আনলে হবে না । “
শাড়ীর আঁচল দিয়ে গা মাথা ভাল করে মুছে নিল শায়লা, অনেকটা ভিজে গেছে সে। একটা ট্রলী নিয়ে আস্তে আস্তে এগুতে লাগল। এসির বাতাসে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে তার। টুকিটাকি জিনিসগুলি তুলে নিতে নিতে ভাবল এখানে জিনিস পত্রের যে দাম, তেমন কিছুই হয়ত নেওয়া হবে না। আসলে ওয়ান স্টপ মলে শপিং করা তার মত লোকের সাজেনা, তবুও এই বৃষ্টিতে এছাড়া কোন উপায়ও নাই। গুলশানে একটা বিদেশী প্রতিষ্ঠানে সামান্য রিসেপনিষ্টের চাকরী তার, দুর সম্পর্কের এক বিধবা খালা আর এক মাত্র মেয়ে পুশ্পী নিয়ে খুব কঠিন জীবন তার।
পুশ্পীর বাবা বছর তিনেক আগে মারা গেল আর শায়লা পড়ল অথৈ সাগরে। পুশ্পীর বাবা ছিলেন খুব আয়েসী মানুষ। বনেদী পয়সায়ালা পরিবারে ছেলেরা যেমন হয়। খুব ভাল ভাল খাওয়া দাওয়া পছন্দ করতেন তিনি, সিগারেট আর চা ছিল তার প্রতি দশ মিনিটের সঙ্গী, আর রাত হলে চলে যেতেন ক্লাবে। তাদের পৈত্রিক ব্যাবসা বেশ ভালই ছিল তাই আরাম আয়েসের রসদ যোগাড় হতে কোন কষ্ট করতে হত না তাকে। শায়লার মেজ দেবর ছিল বেশ বুদ্ধিমান এবং বেশ করিতকর্মা, বাবার সাথে সাথে তিনিও এই পারিবারিক ব্যাবসাটা দেখতেন। পুশ্পীর বাবা খুব অলস ছিলেন তিনি এসবের ধারে কাছেও থাকতেন না। শাশুড়ীর বিয়ের পরে অনেক বছর কোন বাচ্চা ছিল না, তাই প্রথম সন্তানের আহ্ললাদটা একটু মাত্রাতিরিক্ত ছিল, ফলশ্রুতিতে পুশ্পীর বাবা খাও দাও ফূর্তি কর টাইপের একজন উশৃংখল মানুষ। শায়লার মনটাকেও তিনি কখন বুঝতে পারেন নি, নিজের আয়েসী জীবন নিয়ে বড্ড ব্যাস্ত সময় কাটত তার। যত দিন বাবা বেঁচে ছিলেন, ততদিন তার কোন সমস্যা হয় নি, কিন্তু তিনি প্রথম ধাক্কাটা খেলেন হঠাৎ করে যখন তার বাবা মারা গেলেন। শায়লার শাশুড়ি তার বিয়ের আগেই মারা গিয়েছিলেন। শায়লার শশুর আর তার বাবা ছিলেন ছোট বেলার বন্ধু। শায়লাদের অবস্হা তেমন ভাল না কিন্ত শায়লাকে ছোটবেলা থেকেই তার শশুরের খুব পছন্দ ছিল। তাই শাশুড়ি মারা যাবার পর সংসারের হাল ধরার জন্য শায়লা এই বাড়ির বঊ হয়ে আসে। উশৃংখল এই আয়েসী মানুষটাকে শাসন করার কেউ ছিল না, শায়লা অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেনি। তারপরের ধাক্কাটা খেল যখন তার ছোট ভাই ব্যাবসার প্রায় পুরটাই নিয়ে নিল, তিনি পেলেন বাড়ির অর্ধেক অংশ আর ছোট খাট কয়েকটা দোকান। এই ধাক্কাটা সামলাতে না পেরে হার্ট আট্যাক হল তার, চিকিৎসা করতে বাড়ির অংশটাও দেবরেরে কাছে বিক্রি করতে হল শায়লার, আজ সে নিঃশ্ব! এই ছোটখাট চাকরী তার ভরসা। পাশ দিয়ে একটা ট্রলি যাবার সময় চিন্তায় ছেদ পড়ল শায়লার, ট্রলীটা কানায় কানায় পুর্ণ, ভদ্র মহিলার হাত ভরা সোনার চুড়ি, মহিলাটি ভিষণ বিরক্তির চোখে তাকাল শায়লার দিকে কারণ আনমনে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে ছিল সে। হাবিজাবি চিন্তা বাদ দিয়ে কেনা কাটায় মন দিল শায়লা, বাইরে তখনো অনেক বৃষ্টি, কি ভাবে যে সে বাড়ী যাবে কে জানে!
কেনা কাটা শেষে পে কাউন্টারে কিউতে দাঁড়াল শায়লা, হঠাৎ কে যেন পাশে এসে জিজ্ঞেস করল “ আপনি ইয়ে মানে তুমি শায়লা না ?”
শায়লা একটু অবাক হয়ে বলল জী মানে আপনি...
আমি মানে আমি রুম্পার চাচাত ভাই, তোমার বন্ধু রুম্পা ! তোমরা আজ।।পুর দায়রা শরীফের গলিতে থাকতে না! আমাদের বাসা ঠিক তোমাদের বাসার সামনেরটা ছিল।
ওহ! হ্যাঁ চিনেছি, আপনি মুরাদ ভাই
কেমন আছেন, কতদিন পর দেখা ! সে প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ বছর, রুম্পা কোথায় আছে, কেমন আছে ?
হ্যাঁ আমরা সবাই ভালই আছি, রুম্পা ভালই আছে ওর দুই ছেলে মেয়ে।
ততক্ষণে পেয়মেন্ট দেওয়া শেষ শায়লার, মুরাদ ভাই তার সামনেই ছিল, এক সাথে বের হল তারা শপিং মল থেকে।
মুরাদকে বিদায় জানিয়ে শায়লা রাস্তায় নেমে দেখে প্রচন্ড বৃষ্টি। মুরাদ কার পার্কিং থেকে বেরিয়ে দেখে শায়লা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, মুরাদ ঠিক শায়লার সামনে এসে গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে বলল “ভিতরে এস আমি পৌঁছে দেব।“
শায়লা বলল না না দরকার নাই, আমি সি এন জি পেয়ে যাব।
মুরাদ বলল পাগল হয়েছ ! এই বৃষ্টিতে কিচ্ছু পাবেনা
শায়লা ইতস্তত করে গাড়িতে মুরাদের পাশের সীটে গিয়ে বসল।
মুরাদ বলল “কোথায় যাবে?”
শায়লা বিষন্ন গলায় বলল “বাড্ডা।“
মুরাদ শায়লার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, বলল “তুমি এত uneasy ফিল করছ কেন? আমি ভদ্রলোক, be comfortable, কোন সমস্যা নাই” বলেই উচ্চস্বরে হাসতে লাগল।
এই প্রথম শায়লা মুরাদ ভাইর এত কাছে বসেছে এত কথা বলছে, আগে সে মুরাদ ভাইকে খুব ভয় পেত। রূম্পা সব সময় বলত তার এই ভাইটা খুব বেরসিক, খুব রাগী ইত্যাদী ইত্যাদী, তাই শায়লারা মানে রুম্পার বন্ধুরাও মুরাদকে অনেক ভয় করত।
মুরাদ বলল “কি হল তুমি কি এখনো ভয় পাচ্ছো”
শায়লা বলল,” নাহ ! তবে ছোট বেলায় আপনাকে খুব ভয় পেতাম।
কেন এত ভয় পেতে?
জানিনা রুম্পা বলত আপনি খুব রাগী, হয়ত তাই
আমাকে কি খুব রাগী মনে হতো!
নাহ! ঠিক সেটা না তবে রূম্পা যে ভাবে বলতো সেটা শুনে......।।
কথাটা শেষ করার আগেই মুরাদ বলল “তাই বুঝি আমার ভালবাসায় সাড়া দাও নি”
কথাটা শুনে আঁতকে উঠে শায়লা, মানে বুঝলাম না কি বলছেন !
তুমি কি কিছুই জান না?
কি জানব শায়লার ভীত কন্ঠস্বর !
কেন রূম্পা তোমাকে কিছুই বলেনি?
নাত ! রূম্পা কি বলবে ? কি ব্যাপারে?
মুরাদ এবার বেশ লাজুক একটা হাসি দিয়ে বলল , আসলে তুমি ছিলে আমার প্রথম ভালবাসা। যে বয়সে একটা মেয়েকে একটা ছেলের প্রথম ভাল লাগে, আমি সেই বয়স থেকে তোমাকে নিয়ে কত কল্পনা করতাম, স্বপ্ন দেখতাম। আমার জানালা দিয়ে তোমাদের বাড়ি দেখা যেত আমি পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখতাম; তুমি তখন ফ্রক পড়তে, বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করতে। আমি জানতাম বৃষ্টি এলেই তুমি বৃষ্টিতে ভিজতে, নিজের চুল নিয়ে আপন মনে খেলতে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সেটা দেখতাম। কি যে ভাললাগত আমার ! আমি এখনো বলে দিতে পারব তোমার ছোটবেলায় কি কি রঙ্গের জামা ছিল, কেমন করে খেলতে, তোমার ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করতে!
তোমার সেই ছেলেবেলার বৃষ্টি ভেজা চেহারা আমার চোখে এখনো ভাসে, শায়লা বলতে আজও সেই ছেলেবেলার বৃষ্টি ভেজা শায়লাই বুঝি। আমার সেই ভালবাসা আমার মনে এতটাই দাগ কেটেছে যে আমি এখনো সেই রকম ভাবে আর কাউকে ভালবাসতে পারিনি। আমার বঊ আছে বাচ্চা আছে, ওদেরো আমি ভালবাসি। কিন্তু তোমার জন্য যে ভালবাসা- সেটা ছিল অন্যরকম। আমি রুম্পাকে বলেছিলাম তোমাকে ব্যপারটা বলতে, নিজে বলার সাহস ছিল না, রূম্পা বলল যে সে তোমাকে বলেছে তুমি নাকি কিছু বলনি, তাই আমি আমার ভালবাসা আমার মনের ভিতর যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। আর আরেকটা কথা তোমাকে বলা হয়নি, মানে রুম্পার সাথেই আমার বিয়ে হয়েছে, আমার চাচা অকালে মারা গেলেন, তাই চাচার সংসারের হাল ধরতে আমাকেই বিয়ে করতে হল রুম্পাকে। আজ এত বছর পর তোমাকে কাছে থেকে দেখলাম, তোমার সাথে কথা বললাম, আমার যে কেমন লাগছে বোঝাতে পারব না! এরকম একটা বৃষ্টির দিনে তোমাকে পাশে নিয়ে ঘো্রা, বৃষ্টিতে ভেজা, এটা আমার অনেক দিনের স্বপ্ন। সব বৃষ্টির দিনে এখনো তুমি আমার ভাবনায় আস, আমি দেখি একটা ১২/১৩ বছরের মেয়ে ফ্রক পড়ে বারান্দায় বৃষ্টিতে ভিজছে। কি জানি অনেক চেয়েছিলাম বলেই হয়ত বিধাতা আমাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এমন দিনে তোমাকে আমার পাশে দিয়েছেন। আচ্ছা তুমি কি এখন বৃষ্টি হলে আগের মত বৃষ্টিতে ভেজ?
শায়লা কি করবে কি বলবে ভেবে পেল না, চুপচাপ বসে রইল, মুরাদ আড় চোখে তাকে দেখছে, বাইরে বৃষ্টির রিমঝিম গান অবিরত বেজে চলেছে।
শায়লার চোখে পানি এসে যাচ্ছে, সেটা ঢাকতেই সে একটা গলির মুখে এসে বেশ কঠিন গলায় বলল “আমি এখানেই নামব”
মুরাদ বলল “কেন ! এখানে কেন নামবে, আমি তোমার বাসায় নামাই? তুমি কি রাগ করলে, প্লিজ কিছু মনে কর না, মানে এভাবে তোমাকে এত কাছে পেয়ে আমি একটু ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম, উচিত হয় নি আমার হরবর করে এসব কথা তোমাকে বলার, প্লিজ শায়লা”
শায়লা বলল “না রাগ করিনি, বৃষ্টিতে গলির মধ্যে গাড়ি ঢুকাতে পারবেন না, অনেক পানি জমে আছে।“ মুরাদকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ীর দরজা খুলে খুব দ্রুত রাস্তায় নেমে গেল সে।
বৃষ্টিতে পুরো ভিজে যাচ্ছে শায়লা, ঠিক করল, কোন রকম বাজার বাসার নামিয়ে ছাদে যেয়ে আজকে সে ঘন্টার পর ঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজবে। মনে মনে ডুকরে কেঁদে উঠে শায়লা, ঊহ ! রূম্পা তুই আমার এত বড় সর্বনাশ করলি কেন! চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
সেই প্রথম ভাললাগার বয়সে মুরাদকে তার খুব ভাললাগত, খুব ভালবাসত। এরকম বৃষ্টির দিনে, চাঁদনী রাতে মুরাদকে নিয়ে কত কি কল্পনা করেছে সে, কিন্ত কোন দিন কিছুই বলতে পারেনি। মুরাদকে যেমন কিছু বলতে পারেনি আবার এতটা জীবনে মুরাদকে সে ভুলতেও পারেনি, হাজার হোক -প্রথম ভাললাগা। শপিংমলে মুরাদকে দেখেই ওর বুক ঢিপঢিপ করছিল তার, এই জন্য গাড়ীতেও বসতে অস্বস্তি লাগছিল, এমন বৃষ্টির দিনে সেই ছোট্টবেলার ভালবাসার মানুষ জীবনে প্রথম বারের মত তার পাশে বসেছে, কাছে এসেছে, এত কথা বলেছে, উহ! একদম স্বপ্নের মত ! কিন্তু মুরাদকে কিভাবে বলবে সে তার সেই ভালবাসার কথা! তার মরুভুমির মত জীবনে মুরাদ প্রথম বৃষ্টির মত।
আজ শুধু বৃষ্টিতে ভিজবে শায়লা, বৃষ্টির পানিতে ভিজে ভিজে মুছে ফেলতে হবে কিচ্ছুক্ষণ আগে শোনা কথাগুলি।
মুরাদ অবাক চোখে চেয়ে দেখে গলির পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে শায়লা। তার সামনে বৃষ্টিতে ভিজছে তার ভালবাসা, সেই ছোটবেলার মত ...... এটা কি স্বপ্ন ! উইন্ডশীল্ডে বৃষ্টির পানির দিকে তাকিয়ে আছে মুরাদ, ঝাপ্সা হয়ে আসছে শায়লার অব্য়ব, ঝাপ্সা হয়ে আসছে মুরাদের চোখও।
সত্যি কি শায়লা ছিল এতক্ষণ ! নাকি পুরটাই এই বৃষ্টির দিনে দূর্বল মনের ভাবালুতা! বৃষ্টির তেজ বাড়ছে, চোখ খুব জ্বালা করছে মুরাদের, আজ কেন যেন জীবনে প্রথম বারের মত বৃষ্টিতে খুব ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
ভাল লিখছিস। তোর গল্প বলার একটা নিজস্বতা আছে। চালিয়ে যাবি আশাকরি।
ভাল হয়েছে । আরো ভাল হতে পারতো !
এমন একটা গল্প আমি মিস করলাম কিভাবে!!
আগে কেন পড়া হয় নি?
কাকলী আপুর লেখার হাত দূর্দান্ত!
শায়লার মরুময় জীবনে মুরাদ এক ফোঁটা বৃষ্টির জল হয়ে এসে আবার বিপ্রতীপতায় নির্বাসিত হলো ! ! সুন্দর ! !
দারুন দারুন দারুন
এই লাইনটা আগেও কই জানি পড়ছি পড়ছি মনে হচ্ছে
দারুন লেখা...
মন্তব্য করুন