বাঙালির গরব : বাঙালিই থামিয়ে দিয়েছিল বিশ্বজয়ী আলেক্সান্ডারকে
[বাঙালি গরব সিরিজের এই পোস্টটা আমার অন্যতম প্রিয়। এবির ব্লগারদের অনেকেই হয়ত পড়ে থাকবেন। এটা নিয়ে অনেক সুখ স্মৃতি আছে। বছর দুই আগে সামইন ব্লগে দেয়ার পর অনেকেই পছ্ন্দ করেছিলেন। ভালো লাগার কথা ব্লগে জানিয়েছেন, কেউ আবার ফোন করে জানিয়েছিলেন। মনে আছে ব্লগার বন্ধনহীনের কথা। সম্পূর্ণ অপরিচিত সেই ব্লগার আমার জন্য একটা বই ও রিমঝিমের জন্য এক প্যাকেট চকলেট সুদূর জার্মানি থেকে উপহার হিসাবে পাঠিয়ে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। পোস্ট টা তার এত ভালো লেগেছিল।
বাঙালি গরব সিরিজটা লিখেছিলাম প্রচন্ড মন খারাপ এর সময়। তখন ঘূর্ণিঝড় সিডরে বিধ্বস্ত দেশ। মনটা খারাপ লাগত সব সময়। সেটা কাটাতে অতীত থেকে গৌরবের কিছু, আনন্দের কিছু আহরণ করে নিজেকে স্বান্তনা দেয়া উৎসাহ দেয়া সাথে অন্যদেরকেও। এই ছিল সিরিজ টা লেখার উদ্দেশ্য। মূল অনুপ্রেরণা ও প্রাথমিক তথ্য পেয়েছিলাম মুক্তমনায় লেখা ফতে মোল্লার 'বিদ্রোহি বঙ্গ' থেকে।
পুরানো লেখা দেয়ায় উৎসাহী না হলেও এই লেখাটা না দিয়ে পারলামনা।]
একটা কল্প কাহিনী লেখা যাক।
আজ থেকে দুই হাজার তিনশত তিপ্পান্ন বছর আগের এক রোদ্রজ্জল ঝলমলে সকালে জনা বিশেক যুবক ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে যাচ্ছে উত্তর পূর্ব দিকে। এই ঘোড় সওয়ার দলের নেতা পদ্মানন্দ। মাত্র পঁচিশ বৎসর বয়স, কিন্তু এরই মধ্যে দেশের মানুষের কাছে তার সাহসিকতা, ও বীরত্বের কাহিনী কিংবদন্তীর রূপ পেয়েছে। অশ্ব চালনা, মল্লযুদ্ধ থেকে শুরু করে মহামত্যের রাজশক্তির সাথে লড়াই, সব কিছুতেই সে অপরাজেয়। পদ্মানন্দ ক্ষৌরকার পিতার সন্তান। তার সতীর্থরাও কামার, জেলে বা কৃষকের ঘরের। তাদের সবার বাড়ি শিবপুর (বর্তমান চুয়াডাঙ্গা জেলায়) ও তার আশে পাশের গ্রামে। তাদের পথে নামা, পরাধীন দেশ মাতার দাসত্বের শৃংখল ভাংগার লক্ষ্যে।
বহিরাগত আর্যশক্তি প্রায় সমগ্র ভারত পদানত করে ফেললেও, এই নদ নদী গাছ লতা পাতায় ভরা সুজলা সুফলা শস্যে শ্যামলা মাটির সন্তানেরা বহুকাল ব্যর্থ করে দিয়েছিল তাদের আক্রমন। কিন্তু একসময় পরাস্ত হতে হয় তাদের। এরপর শুরু কয়েক শতাব্দীর লাঞ্চনার অমানিশা। বিজয়ী আর্য শক্তি দেশের সব মানুষকে দাসে পরিণত করে, বেধে দেয় তাদের জন্য নীচু বর্ণ ও পেশা।
এ অভিযাত্রায় পদ্মানন্দ ও তার দল গোপনে সারা দেশ থেকে স্বাধীণতার যোদ্ধা সংগ্রহ করছে। এ পর্যন্ত যে জায়গায় গিয়েছে সবখানেই অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেছে। হাজার হাজার অকুতোভয় যুবক এক কথায়ই দলে যোগ দিয়েছে।
এভাবে কিছুদিনের মধ্যে সারাদেশ থেকে নিবেদিত প্রাণ, অমিত তেজী, সাহসী লোক নিয়ে এক বিদ্রোহি বাহিনী গঠিত হয়ে যায়।
তারপরের ঘটনা এক অভূতপূর্ব বিজয়ের কাহিনী। পদ্মানন্দের নেতৃত্বে বিদ্রোহি বাহিনী দখলদার সৈন্যের উপর ঝাপিয়ে পরে। বছর খানেকের মধ্যে প্রায় সমগ্র দেশ থেকে বিদেশি শক্তি পরাজিত হয়ে বিতাড়িত হয়। দেশের মানুষের সমর্থন ও অকুতোভয় অমিততেজী যোদ্ধা বাহিনী নিয়ে পদ্মানন্দ এগিয়ে যায় রাজ শক্তির শেষ ক্ষমতা কেন্দ্র পুন্ড্র নগরে আঘাত হানতে।
রাজ শক্তির সব প্রতিরোধ তাসের ঘরের মত উড়িয়ে দিয়ে বিজয়ী বীর পদ্মানন্দ তরুণ রাজা হিসাবে সিংহাসনে বসেন। স্বাধীন দেশের নাম হল গঙ্গাঋদ্ধি এবং পদ্মানন্দের বাড়ির কাছের নগর গাঙ্গে হল রাজধানী। বর্ণ প্রথা বিলোপ করা হল।
সেই সাথে দেশের মানুষ ফিরে পেল স্বীয় যোগ্যতা অনুসারে সকল কর্মের অধিকার। দূর হয় কয়েক শতাব্দির দাসত্বের অমানিশার অন্ধকার।
পরাজিত শক্তি পাটলিপূত্র (বর্তমান বিহার অঞ্চলে অবস্থিত) থেকে বার কয়েক আক্রমন করে ব্যর্থ হয়ে কলিঙ্গ সহ কয়েকটি আর্য রাজ্যের সাথে জোট করে গঙ্গাঋদ্ধি কে একযোগে আক্রমন করে। দেশের সেনাবাহিনী প্রস্তুত ছিল। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে পদ্মানন্দের কাছে আর্য রাজ্য সমূহের সম্মিলিত জোট শোচনীয় ভাবে পরাস্ত হয়।
এরপর পদ্মানন্দ জোটবদ্ধ আক্রমনকারী রাজ্যসমূহ দখল করে স্বীয় রাজ্যে অন্তর্ভূক্ত করে নেন। পদ্মানন্দ ও তার পূত্র ধনানন্দ অপ্রতিরোধ্য অপরাজেয় এক বিশাল সেন্যবাহিনী গড়ে তোলেন। বাইরের কোন শক্তির কাছে যে সেন্যবাহিনী কোনদিন পরাজিত হয় নাই। বাঙালি মায়ের সন্তান নাপিত পূত্র পদ্মানন্দ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গঙ্গাঋদ্ধি হয়ে উঠে প্রভূত ধন সম্পদে পরিপূর্ণ, পৃথিবীর সর্ববৃহত ও সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর অধিকারি এক বিশাল পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য।
ধনানন্দের রাজত্বকালে দিগ্বিজয়ি গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার সুদূর গ্রিস থেকে একের পর এক রাজ্য জয় করে ইরান আফগানিস্তান হয়ে ভারতের পাঞ্জাবে পৌছে যায়। সুদর্শন তরুণ সম্রাটের চোখে সারা পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিশালি সেনাবাহিনীর অধিকারি তিনি। বিখ্যাত ইরান সম্রাট দারায়ুস থেকে শুরু করে উত্তর পশ্চিম ভারতের পারক্রমশালি রাজা পুরু পর্যন্ত কেউ তার সামনে দাড়াতে পারে নাই। এখন তার সামনে মাত্র একটা বাধা, বিপাশা নদীর ওপারের রাজ্য। ভারতের মূল ভুখন্ড। এটুকু করতলগত হলেই সমগ্র ভারত তার দখল হয়ে গেল। যে স্বপ্ন নিয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন গ্রিক রাষ্ট্র মেসিডোনিয়া থেকে, তা পরিপূর্ণতা পাবে।
এদিকে ধনানন্দের সেনাবাহিনী আলেক্সান্ডারের বাহিনী কে প্রতিহত করতে বিপাশার এ পাড়ে সৈন্য সমাবেশ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দুই সৈন্য বাহিনী বিপাশা নদীর দুই পাড়ে যুদ্ধের জন্য অপেক্ষামান। নদী পার হওয়ার পূর্বে অপর পক্ষের খবর নিতে চাইলেন আলেক্সান্ডার।
বিজিত স্থানীয় ছোট ছোট ভূস্বামীরা আলেকজান্ডারকে জানাল অপর পাড়ের দেশটির ঐশ্বর্যের কথা, অপরাজেয় সৈন্যবাহিনীর কথা।
- দুই লক্ষ সৈন্যের বিশাল এক অপরাজেয় পাদাতিক বাহিনী।
সম্রাটকে একটু চিন্তিত মনে হলো।
- বিশ হাজার সুসজ্জিত অশ্বারোহী বাহিনী। দুই হাজার রথ।
একটু যেন দমে গেলেন গ্রিক বীর, 'বলো কি?'
'আরো আছে প্রভু'।
- কমপক্ষে তিন হাজার হাতির গজ বাহিনী।
'তিন হাজার হাতি!', যেন হাহাকার করে উঠলেন প্রায় সারা পৃথিবী তছনছ করা মেসিডোনিয়ার বীর।
- জ্বি হুজুর কমপক্ষে।
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সম্রাট। তার কল্পনাতেও ছিলনা ভারতে এত বড় শক্তিশালী সম্রাজ্য আছে। সামনে এগিয়ে যাওয়া মানে নিশ্চিতভাবে সমূলে ধ্বংস হওয়া, আবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়াও তার মত দ্বিগ্গিজয়ী বীরের জন্য অপমানজনক। এরপর পৃথিবী বিখ্যাত এ অসীম সাহসী বীর করণীয় আলোচনার জন্য নিজের সেনাবাহিনীর সাথে পরামর্শে বসলেন। বিচক্ষণ সেনাপতি সৈন্যদের পক্ষ হয়ে জানাল সৈন্যরা কেউ বিপাশা পার হয়ে নিজের জীবন দিয়ে আসতে রাজী নয়। অসহায় সম্রাটের সামনে
এসে শত শত যুদ্ধ বিজয়ের পরিকল্পনাকারী, পৃথিবী শ্রেষ্ঠ দক্ষ সেনাপতির স্পষ্ট উচ্চারণ,
- হুজুর, এটা হবে নিছক আত্মহত্যা আর কিছু নয়।
ফলে পাঞ্জাবের বিপাশা নদীর অপর পাড়েই আলেক্জান্ডারের বিজয় রথ থেমে যায়। সম্পূর্ণ ভারত জয়ের স্বপ্ন তার স্বপ্নই রয়ে গেল। এরপর গ্রিক বাহিনী মেসিডোনিয়ার দিকে ফিরতি যাত্রা করে।
আমার কল্প কাহিনী এখানেই শেষ হলো।
অনেকের কাছে এই পোস্টের কাহিনীও অনেকের কাছেই বাস্তব বর্জিত অলীক রূপকথা মনে হতেই পারে। মনে হতে পারে ইমোশনাল বাঙাল গদগদে জাতীয়তার আবেগে তথ্য ও সত্য বিবর্জিত রূপকথা বানিয়েছে।
দেখা যাক তাহলে ঐতিহাসিকগন কি বলে, আর বাঙালি জাতির পূর্ব পুরুষের দ্বার গঠিত সাম্রাজ্য সম্পর্কে কি কি তথ্য পাওয়া যায়। এই ঐতিহাসিকগন বেশিরভাগই বিদেশি।
'গঙ্গারিডাই রাজ্যের বিশাল হস্তী-বাহিনী ছিল। এই বাহিনীর জন্যই এ রাজ্য কখনই বিদেশি রাজ্যের কাছে পরাজিত হয় নাই। অন্য রাজ্যগুলি হস্তী-বাহিনীর সংখ্যা এবং শক্তি নিয়া আতংকগ্রস্ত থাকিত' - মেগাস্থিনিস (৩৫০ খ্রীস্টপূর্ব-২৯০ খ্রীস্টপূর্ব)
মেগাস্থিনিস আলেকজান্ডারের সেনাপতি ও বন্ধু সেলুকাসের রাজত্বকালে গ্রিক দূত হিসাবে ভারতে এসেছিল।
'ভারতের সমূদয় জাতির মধ্যে গঙ্গারিডাই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই গঙ্গারিডাই রাজার সুসজ্জিত ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত চার হাজার হস্তী-বাহিনীর কথা জানিতে পারিয়া আলেকজান্ডার তাহার বিরূদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন না' - ডিওডোরাস (৯০ খ্রীস্টপূর্ব-৩০ খ্রীস্টপূর্ব)
নন্দ রাজাদের প্রকান্ড সেনাবাহিনী বর্ণনার ক্ষেত্রে ভারতীয় ও ধ্রুপদী ইউরোপীয় রচনাগুলির উল্লেখে প্রচুর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ডিওডোরাস ও ক্যুইন্টাস কার্টিয়াস রুফাস উভয়েই উল্লেখ করেছেন নন্দরাজের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগ সম্বন্ধে। যথা,
পদাতিক সৈন্য ২ লক্ষ, অশ্বারোহী সৈন্য ২০ হাজার, রথ ২ হাজার এবং তিন থেকে চার হাজার হাতি। কিছু কিছু প্রাচীন ভারতীয় ও সিংহলী পুথিতে প্রথম নন্দ রাজার নাম উল্লেখ করা হয়েছে উগ্রসেন বলে, অর্থ এমন এক ব্যক্তি যাঁর 'প্রকান্ড ও পরাক্রান্ত সেনাবাহিনী' আছে।
এই পর্যন্ত আলোচনায় গঙ্গারিডাই নামের পরাক্রান্ত রাজ্যের প্রমান পাওয়া গেল। যেটা ছিল পাঞ্জাব পর্যন্ত সমূদয় গঙ্গা অববাহিকায় নিয়ে গঠিত ভারতের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালি রাজ্য। এখন প্রশ্ন, এ নিয়ে এত আলোচনার কি আছে আর এর সাথে বাঙালির সম্পর্কই বা কি? আবার তাহলে তাকাই বিশ্ব বরেন্য ধ্রুপদী ঐতিহাসিকদের রচনায়।
'গঙ্গা নদী উত্তর হতে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত এবং গঙ্গারিডাই রাজ্যের পূর্ব সীমানায় সমূদ্রে মিলিত হইয়াছে।' - মেগাস্থিনিস
'গঙ্গা নদীর মোহনায় সমূদয় এলাকা জুড়িয়া গঙ্গারিডাই রাজ্য' -টলেমি
'গঙ্গারিডাই রাজ্যের ভিতর দিয়া গঙ্গা নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হইয়াছে'- প্লিনি
টলেমি (২য় খ্রীস্টাব্দ) গব্দারিডাই-এর অবস্থান সম্পর্কে কিছুটা বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যৈ, গঙ্গার পাঁচটি মুখ সংলগ্ন প্রায় সমূদয় এলাক গঙ্গারিডাইগণ দখল করে রেখেছিল, ‘গাঙ্গে’ নগর ছিল এর রাজধানী। তার বর্নণাকৃত চারটি দ্রাঘিমা ডিগ্রি সমূদ্র উপকূলের সর্ব পশ্চিম থেকে সর্ব পূর্ব নদীমুখ পর্যন্ত অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করছে। কার্যতঃ এর অর্থ হলো ‘গব্দারিডাই’ বঙ্গপোসাগরের উপকৃলবর্তী গঙ্গার সর্বপশ্চিম এবং সর্বপূর্ব নদীমুখ পযর্ন্ত বিস্তৃত ছিল। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো যে, ভাগীরথির (তমলুক-রৈ নিকটে) এবং পদ্মার (চট্টগ্রামের নিকটে) নদীমুখের দ্রাঘিমা রৈখার পার্থক্য ৩৫ ডিগ্রির সামান্য কিছু বেশি। তাই টলেমির তথ্যানুযায়ী গব্দারিডাই-কে শনাক্ত করা যায় বর্তমান ভারতের পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশে গঙ্গার প্রধান দুটি শাখার মধ্যবর্তী অঞ্চলটিতে।
'গঙ্গারিডাই রাজ্য ৩০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে ভারতীয় উপমাহাদেশের বাঙলা অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস তার ইন্ডিকা গ্রন্থে এটা বর্ণনা করেছেন।
ধ্রুপদী গ্রিক এবং ল্যাটিন ঐতিহাসিকদের বর্ণনানুযায়ী আলেকজান্ডার দি গ্রেট বাংলায় অবস্থিত এ সম্রাজ্যের কাউন্টার এটাকের আশংকায় ভারতে তার বাহিনী উইথড্র করতে বাধ্য হন।
গ্রিক ঐতিহাসিক দলিল এবং ভৌগলিক বিবরণ থেকে অনুমান করা হয় যে চুয়াডাঙ্গা জেলাটি ছিল গঙ্গারিডাই রাজ্যের একটি অংশ এবং গাঙ্গে শহরটির অবস্থান ছিল এ অঞ্চলে। ' - উইকিপিডিয়া
একজন গ্রিক নাবিক তাঁর Periplous tes Erythras Thalasses (Periplus Maris Erythraei) গ্রন্থে বঙ্গপসাগর সংলগ্ন উড়িষ্যা উপকূলের পূর্বে অবস্থিত গাঙ্গে দেশের কথা উল্লেখ করেছেন। নদী তীরে নদীর নামে গাঙ্গে ছিল একটি বানিজ্য শহর। এটা স্পষ্ট যে টলেমির 'গঙ্গারিডাই' এবং পেরিপ্লাস গ্রন্থের লেখকের 'গাঙ্গে দেশে' বঙ্গপসাগরের উপকূলে অবস্থিত একই এলাকাকে ইঙ্গিত করছে। কালিদাশের রঘুবংশে বঙ্গের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাও অভিন্ন অর্থ বহন করে।
গঙ্গারিডাই শব্দের উৎপত্তি গঙ্গারিড থেকে। ধারণা করা হয় গঙ্গারিড ভারতের গঙ্গাঋদ শব্দের গ্রিক রূপ। এর অর্থ যে ভূমির বক্ষে গঙ্গা প্রবাহিত।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নীহারঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব) গ্রন্থে লিখেছেন-
'গঙ্গারিডাই-রা যে গাঙ্গেয় প্রদেশের লোক এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই, কারণ গ্রিক লাতিন লেখকরা এ সম্বন্ধে একমত। দিয়োদারাস-কার্টিয়াস-প্লুতার্ক-সলিনাস-প্লিনি-টলেমি-স্ট্ট্যাবো প্রভৃতি লেখকদের প্রাসঙ্গিক মতামতের তুলানামূলক বিস্তৃত আলোচনা করিয়া হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয় দেখাইয়াছেন যে গঙ্গারিডাই বা গঙ্গারাষ্ট্র গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্বতীরে অবস্থিত ও বিস্তৃত ছিল।'
এইবার রূপকথার নাপিত পূত্র রাজা সম্পর্কে ইতিহাস কি বলে দেখা যাক।
ধ্রুপদী গ্রিক ও ল্যাটিন বর্ণনায় রাজার নাম আগ্রাম্মেস। তিনি ছিলেন নীচকূলোদ্ভব নাপিতের পূত্র। হিন্দু পুরাণে তিনি মহাপদ্মনন্দন এবং বৌদ্ধ শাস্ত্র মাহাবোধিবংশে উগ্রসেন। হেমচন্দ্রের পরিশিষ্টপর্ব নামক জৈন গ্রন্থেও মহাপদ্মনন্দকে বলা হয়েছে নাপিত কুমার। পুরাণে বলা হয়েছে শূদ্রোগর্ভোদ্ভব। আরও বলা হয়েছে, 'সর্বক্ষত্রান্তক নৃপঃ' অর্থাৎ সকল ক্ষত্রিয়কে নিধন করে সিংহাসনে বসেছিল।
সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায় একমাত্র বাঙালি জাতির পূর্ব পুরুষই থামিয়ে দিয়াছিল প্রায় সারা পৃথিবী জয় করা, পৃথিবীর সর্বশেষ্ঠ সেনাবাহিনীর অধিকারি, বিশ্বজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডার ও তার অসীম পরাক্রমশালি গ্রিক সেনাবাহিনীর বিজয় রথ।
আমি এ লেখাটা শেষ করতে চাই গর্বিত এক বাঙালি ঐতিহাসিক নীহারঞ্জন রায় এর কথা দিয়ে। তিনি বলেছেন-
'আজ এ-তথ্য সুবিদিত যে, ঔগ্রসৈন্যের সমবেত প্রাচ্য-গঙ্গারাষ্ট্রের সুবৃহৎ সৈন্য এবং তাহার প্রভূত ধনরত্ন পরিপূর্ন রাজকোষের সংবাদ আলেকজান্দারের শিবিরে পৌছিয়াছিল এবং তিনি যে বিপাশা পার হইয়া পূর্বদিকে আর অগ্রসর না হইয়া ব্যাবিলনে ফিরিয়া যাইবার সিদ্ধান্ত করিলেন, তাহার মূলে অন্যান্য কারণের সঙ্গে এই সংবাদগত কারণটিও অগ্রাহ্য করিবার মত নয়।'
--------------------------------------------------------------------------------------------------
ছবি : নন্দ সাম্রাজ্যের মানচিত্র (উইকিপিডিয়া থেকে)
তথ্য সূত্র:
বাঙ্গালীর ইতিহাস (আদি পর্ব) - নীহারঞ্জন রায় | দে'জ পাবলিশিং - কলিকাতা
ভারতবর্ষের ইতিহাস (প্রাচীন ভারত) - গ্রিগোরি বোন্গার্দ লেভিন | প্রগতি প্রকাশন - মস্কো
ইন্ডিকা - মেগাস্থিনিস
বাংলাপিডিয়া
উইকিপিডিয়া
অনুপ্রেরণা : ফতে মোল্লার বিদ্রোহি বঙ্গ।
এই সিরিজটা পুনঃপ্রকাশের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। এটা বার বার পড়ার মতো। দারুণ কাজ।
অনেক ধন্যবাদ নুশেরা।
দারুন , আমরা যারা পড়ি নাই , আমরা পড়ার সুযোগ পাইলাম।
পড়ার জন্য তোমাকেও ধন্যবাদ
এই সিরিজটা পুনঃপ্রকাশের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। এটা বার বার পড়ার মতো। দারুণ কাজ।
আর আপনার সব লেখাগুলো নিয়ে আসেন
টুটুলদা, ইয়ে মানে নারিকেল জিঞ্জিরা যাবার প্রস্তুতিপর্বে ইশারা দেয়া _ইজ্জতির কাহিনীটা কিন্তু এখনও আসেনাই, অচিন্দার পুরনো লেখা আবারও আসুক কিন্তু ঐটা ভুললে চলবে না... পাবলিক ডিমান্ড বলে একটা কথা আছে...
আমার মনে হয় অচিন্দা পিছলাইতাছে বেইজ্জতির ভয়ে ;)
ওকে, সিরিজটা আনব
এক কথায় অসাধারন!! আমাদের জন্য সিরিজটা নতুন করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ
অসাধারণ !
আমি আগে পড়ি নাই। এটা যদি কোন সিরিজের অংশ হয়ে থাকে তাহলে বাকিগুলাও পড়তে চাই।
ধন্যবাদ। ওকে বাকিগুলোও দিব।
পুরোনো হলেও অনেকদিন পর হাসান ভাইয়ের সেইরাম একটা লেখার পুনঃপঠন আনন্দময়। এই বাঙালীর ইতিহাস পড়লে গর্বে বুকের ছাতি দুহাত ফুলে যায়। কিন্তু বাঙালীর বর্তমান অধঃপতনের কথা ভাবলে ঘাড় থেকে মাথা নেমে ঝুলে পড়ে।
বাঙালীর অধঃপতনের হেতু, প্রেক্ষাপট, দোষী ব্যক্তিবর্গ ইত্যাদি নিয়ে আরেকটা পোষ্ট দেন। বৃটিশ চা খাইয়া আমাদের মাথা নষ্ট হইয়াছিল, নাকি মোগলাই পরোটা চিবিয়ে মগজের বারোটা বেজেছিল, নাকি নিজেরা নিজেদের ঘরে আগুন দিয়ে ছাই কুড়িয়েছি, তার একটা ঐতিহাসিক আলোচনা করা উচিত। এটা একটা অপূরনীয় ক্ষতি। যা কাটিয়ে উঠতে আমাদের আরো হাজারখানেক বছর খেসারত দিতে হবে।
বাঙালী সেদিন একটা ভুল করেছিল। আলেকজান্ডার রনে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে যাচ্ছে খবর পাওয়ার কয়েকদিন পর যখন নিশ্চিত হলো যে ওরা বর্ডার ক্রস করেছে, তখন ছোট একটা বাহিনী তাদের পিছনে পাঠিয়ে 'ওই ধর ধর', 'গেলি না পুলিশ ডাকুম' রব তুলে কিছুদুর এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। তখন আলেকজান্ডারের দল অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ছুট লাগাতো মেসিডোনিয়ার দিকে। সেই অস্ত্র কুড়িয়ে বাকী সৈন্যদের ডাক দিয়ে ইউরোপের অভিযানে গেলে , আলেকজান্ডার বাহিনী আফ্রিকার দিকে পালিয়ে যেত, আর বাঙালীর ইউরোপ বিজয় নিশ্চত হতো। ইউরোপের ঘরে ঘরে আজ বাংলা ভাষা সমীহের সাথে পড়ানো হতো।
নাহ কিছুই হলো না।
বাঙালী সেদিন একটা ভুল করেছিল। আলেকজান্ডার রনে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে যাচ্ছে খবর পাওয়ার কয়েকদিন পর যখন নিশ্চিত হলো যে ওরা বর্ডার ক্রস করেছে, তখন ছোট একটা বাহিনী তাদের পিছনে পাঠিয়ে 'ওই ধর ধর', 'গেলি না পুলিশ ডাকুম' রব তুলে কিছুদুর এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। তখন আলেকজান্ডারের দল অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ছুট লাগাতো মেসিডোনিয়ার দিকে। সেই অস্ত্র কুড়িয়ে বাকী সৈন্যদের ডাক দিয়ে ইউরোপের অভিযানে গেলে , আলেকজান্ডার বাহিনী আফ্রিকার দিকে পালিয়ে যেত, আর বাঙালীর ইউরোপ বিজয় নিশ্চত হতো। ইউরোপের ঘরে ঘরে আজ বাংলা ভাষা সমীহের সাথে পড়ানো হতো।
ঠিক কইছেন দাদা।
সারভাইভাল অবদি ফিটেস্ট। উন্নত প্রযুক্তি আত্মস্থ করতে না পেরে, আমরা মার খেয়ে গোলাম হয়েছি। আমাদের সমস্যা মনে হয় আবহাওয়া। আবহাওয়া, মাটি এই এলাকার লোকদের অলস বানায় রাখে।
নন্দ সম্রাজ্য তখন অন্যতম শক্তিশালি হলেও আরো না ছড়ানোর কারণ, তাদের সেনাবাহিনীর সিস্টেম। যেখানে হাতি বাহিনী ছিল তাদের মূল পাওয়ার। সেই জন্য দেখবেন নন্দ সাম্রাজ্য পূর্ব ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল( তখন অবশ্য এবং তার পরে অশোকের সময় পূর্ব ভারতই ছিল ভারতের কেন্দ্র)। বিশাল হাতি বাহিনী দূর সম্রাজ্য জয়ের প্রতিকূল ছিল।
পুরনো একটা ঘটনা মনে পড়লো। অনার্সে আমাদের ইকনমিক হিস্ট্রি অফ বাংলাদেশ বলে একটা পেপার ছিলো, বোধহয় থার্ড ইয়ারে। সেটার শুরু প্রাচীন বাংলা থেকে, অনেকটা আপনার লেখার মতো কন্টেন্ট। ছেলেমেয়েরা ফাঁকি দিয়ে বইপত্র পড়তো না, ক্লাসলেকচারে শোনা গল্প দিয়ে টিউটোরিয়াল পার করতো। গঙ্গারিডির উৎপত্তি নিয়ে একজন মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখে দিলো গঙ্গাহৃদি অর্থাৎ "গঙ্গা যার হৃদয়ে"- এইরকম কাব্যিক কিছু। অধ্যাপকের বিদ্রূপের ভঙ্গি নকল করে আমরা তাকে পরের এক বছর অনেক জ্বালিয়েছিলাম।
বস বাকী পর্বগুলোও দিয়ে দেন প্লিজ।
গঙ্গা যার হৃদয়ে- হা হা হা।
আচ্ছা দিব।
পুনরায় লাইকাইলাম
ধন্যবাদ এগেইন।
বস সিরিজটা পুরা দেন, সাথে একটা প্রস্তাব দেই। ধারাবাহিক ভাবে যদি পর্বগুলোর ক্রম ঠিক রেখে পোষ্ট বা লিঙ্ক দেন তবে এটার একটা ই-বুক বানিয়ে সংরক্ষনে রাখা যায়। ব্যাক্তিগত ভাবে মনে করি এমন লেখার আর্কাইভ করা উচিত নয়তো অন্তর্জালে এক সময় কালের ধুলায় চাপা পড়ে যাবে।
সফটকপি মানে ই-বুকের ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে রাজি আছি
থ্যনকু।
আবারো পছন্দের পোষ্টে যোগ করতে না পারার কষ্টনুভব করছি , এ ধরনের লেখা রেফারেন্সের কাজে খুব লাগে।
খুব ভালো উদ্যোগ।
অঃটঃ আমাকে ফটো তুলে দেয়ার আশ্বাস দিয়ছিলেন বলেই জিজ্ঞেস করছি, মোটা মানুষকে শুকনা দেখায় এমন লেন্স কি আছে ?
ভাল লেগেছে জেনে খুব ভালো লেগেছে।
অঃটঃ আমার ছবি তোলার যেই হাত! মোটারে চিকন চিকনরে মোটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হয়ে যায়।
খুব ভাল লাগলো...চালিয়ে যান...
রায়হান ভাই, খুব জলদি এই সিরিজ শুরু না কর্লে আমি কিন্তু একটা হাউ-কাউ লাগামু কৈয়া দিতাসি।
মীর, সাতরাজার এ গুপ্তধন উদ্ধারের প্রয়াস নেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ । হাউ-কাউ লাগবেই ।
হাসান রায়হান, আপনি ভাই একটা রত্ন । এভাবে লুকিয়ে আছেন । অনেক বাচাল আচরণ করে ফেলেছি ইতিমধ্যে। তবুও একান্ত অনুরোধ, আর নিজেকে লুকিয়ে না রেখে সিরিজটা পুরো বের করুন ।
রায়হান ভাই একসময় আলেক্সান্ডারএর মতোই দিগ্বীজয়ী ছিলেন।
সেই দিন আবার কবে আসবে?
অসাধারণ কাজ। অনেকদিন ধ'রে গঙ্গারিডি নিয়ে আগ্রহ জিইয়ে রেখেছিলাম। প্রথম এর বিবরণ পাই কপিল ভট্টাচার্যের 'বাংলাদেশের নদ-নদী পরিকল্পনা' বইয়ে (কলকাতা, ১৯৫৭ ও ঢাকা, ২০০৮, ঐতিহ্য)। খুঁজতে খুঁজতে আপনার কাছে পৌঁছানো। আপনার কল্পনা ও জ্ঞান, গল্প ও ইতিহাস সব মিলে, খুবই প্রয়োজনীয় লেখা, সন্দেহ নেই; লেখাটার ব্যাপক প্রচার অপরিহার্য।
তবে তারপরেও (প্রতিকূল আবহাওয়া, দীর্ঘ বর্ষা, অভূতপূর্ব হস্তীবাহিনী, গঙ্গারিডির বিশাল সৈন্যবাহিনী তথা শৌর্যের কথা জেনেও) আলেকজান্ডার গঙ্গারিডি আক্রমণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার সৈন্যবাহিনীর একেবারেই মনোবল ছিল না। এই লিঙ্কটা তাই বলছে
https://groups.google.com/forum/?hl=en#!topic/soc.culture.bangladesh/5VY5TLGJk4U
আর, 'গঙ্গা হৃদয়ে যার' অর্থের স্বীকৃতি উইকি-ই দিচ্ছে,- বাংলা উইকি-তে-ও অবশেষে দেখি বিস্তৃত কনটেন্ট দিয়েছে,- কেবল হালকা হাসির উপকরণ নয় এত সুন্দর নামকরণটাঃ
'গঙ্গারিডাই শব্দের উৎপত্তি গঙ্গারিড থেকে। ধারণা করা হয় গঙ্গারিড ভারতের গঙ্গাহৃদ বা গঙ্গাহৃদি শব্দের গ্রিক রূপ। অর্থাৎ গঙ্গা হৃদয়ে যার - যে ভূমির বক্ষে গঙ্গা প্রবাহিত। '
ধন্যবাদ। একজন গর্বিত বাঙালি হিশেবেই।
মন্তব্য করুন