গণমাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৭৫এর ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করার আগ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান সরকারনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে ব্রাত্য ছিলেন এই সত্য অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। কিন্তু শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবেই শেখ মুজিবুর রহমানের অস্তিত্ব স্বীকারে বাংলাদেশের গণমাধ্যম অনাগ্রহী ছিলো কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানের কথা বলার জন্যে লোকজনকে সরকারি রোষের মুখোমুখি হতে হয়েছে এটা সচেতন রাজনৈতিক মিথ্যাচার। শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর ২১ বছর গণমাধ্যম থেকে নির্বাসিত ছিলেন এটার অন্যতম কারণ সরকারনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম যে কাঠামো মেনে গড়ে উঠেছে এবং যে কাঠামো ও নীতিমালা অনুসরণ করে সরকারনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম সম্প্রচারিত হয় সেই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রন কাঠামো সব সময়ই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের চেহারা দেখাতেই ব্যস্ত ছিলো এবং এই গঠনকাঠামোতে সম্ভবত এক ধরণের অলিখিত বিধি আছে- যে বিধি অনুসারে সরকারের বিরোধী মতবাদকে সম্পূর্ণ আড়াল করে রাখা হয়।
৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হতো কি না আমি জানি না কিন্তু আমার স্মরণকালের সবটুকু সময়েই আমি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনেছি মাইকে, ১৯৯৬ পরবর্তী সময়ে যেভাবে তেলোয়াতের মতো পবিত্রতা আরোপ করে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রচার করার রীতি প্রবর্তিত হয়েছে তার অন্তত ১ যুগ আগে থেকেই আমি নিয়মিত বিরতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনেছি প্রকাশ্যে এবং এই ভাষণ সম্প্রচারের জন্যে অন্তত আমাদের ক্ষুদ্র মফঃস্বলে কাউকে সরকারী বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হতে হয় নি। কলেজ জীবনে বন্ধুরা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে শ্লোগান দিয়ে শহর ঘুরেছে, তাদের কাউকে অন্তত বিএনপি-জাতীয় পার্টির লোকজনের হাতে আক্রান্ত হতে দেখি নি।
এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশ টেলিভিশন পরিচিত ছিলো সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স হিশেবে, এরশাদপরবর্তী দুর্বল দ্বি-দলীয় গণতান্ত্রিক সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন পরিচিত হয়েছে বিবি-গোলামের বাক্স হিশেবে এবং অলিখিত বিধি অনুযায়ী যে বিবি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তার এবং তার গোলামদের চেহারা এবং স্তুতিবাক্যের বাইরে অপরাপর রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডের কোনো আলোচনা সেখানে হতো না। অবশ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়সকল রাজনৈতিক দলকেই রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে সমান গুরুত্ব এবং সমান এয়ার টাইম প্রদানের একটা অলিখিত বিধান ছিলো। বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিষিদ্ধ হওয়ায় বাংলাদেশ টেলিভিশন মূলত এক দলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা উপস্থাপন করে যেখানে সরকারবিরোধী মতবাদ এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সংবাদ উপস্থাপিত হয় এই রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রতিক্রিয়ায় প্রদত্ত সরকারদলীয় গোলামদের ভাষ্যে।
আমরা ৯ মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি কিন্তু আমাদের প্রশাসনিক কাঠামো, আমাদের গণমাধ্যমে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের রীতি-নীতিতে আমরা পাকিস্তানের ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম মহাপরিচালকদের একজন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক আগ্রাসনের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন( সূত্রঃ প্রথম আলো ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত শওকত ওসমানের যুদ্ধপরবর্তী সময়ের দিনলিপি)। আইয়ুব খান গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রনে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছিলেন এবং পাকিস্তান শব্দগুলোকে বাংলাদেশ শব্দ দিয়ে প্রতিষ্ঠাপিত করে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেস অর্ডিন্যান্স অনুমোদিত হয় ১৯৭৩ সালে। আইয়ুব খান দেশের প্রগতিশীল লেখক এবং প্রতিবাদী সাংবাদিকদের আনুগত্য কিনেছিলেন, কখনও সরকারী পুরস্কারের ফাঁদে ফেলে কখনও বিদেশভ্রমনের সুযোগ করে দিয়ে, শেখ মুজিবুর রহমান আইয়ুব খানের ঐতিহ্য মেনেই বিদ্রোহী সাংবাদিকদের দমন করেছেন। প্রেস অর্ডিন্যান্স ব্যবহার করে পত্রিকার সার্কুলেশন বাতিল করে সান্তনা পুরস্কার হিশেবে সম্পাদককে বিদেশী দুতাবাসে চাকুরি দিয়েছেন। একদা মুঘল সম্রাটেরা উচ্চাভিলাষী রাজপূত্র এবং উত্তরাধিকারীদের শাসনকেন্দ্র থেকে অনেক দূরের প্রদেশগুলোতে প্রাদেশিক শাসনকর্তা হিশেবে নির্বাসন দিতেন- তৈলমদর্নের পুরস্কার হিশেবে বর্তমানে বিদেশী দুতাবাদগুলোতে রাষ্ট্রদুত নিয়োগের সংস্কৃতি চালু হলেও শেখ মুজিবুর রহমানের সময়েআওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্রপরিচালনার কঠোর সমালোচনা করলেই বিদেশী দুতাবাসে উচ্চবেতনে, রাষ্ট্রীয় সুবিধায় চাকুরি পাওয়া যেতো। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম যে অলিখিত তোয়াজনীতি পাকিস্তানের সময় থেকে অনুসরণ করে এসেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই তোয়াজনীতি অনুসরণের সংস্কৃতি অব্যহত থাকায় শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ বেতারে ২১ বছর নির্বাসিত ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে সৎ হলেও দলীয় নেতা কর্মীদের লুণ্ঠন-কালোবাজারী এবং অপরাধের সম্পূর্ন দায় বহন করতে হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উজ্জল ভবিষ্যত এবং দেশের মানুষের কল্যানভাবনায় একজন নেতা হিশেবে শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সংশয় নেই কিন্তু নেতার আন্তরিকতা এবং আত্মনিবেদনের ছিটেফোঁটাও লুটপাটে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ কর্মীদের ভেতরে ছিলো না। সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করে ৬৩টি প্রশাসনিক কেন্দ্র নির্মাণ করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের বিপ্লবী উদ্যোগ আওয়ামী লীগের দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস এবং আদর্শের সাংঘর্ষিক হলেও বাংলাদেশের জনগণের উপরে এই বিধান চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। মেরুদ্বন্দ্ববিহীন তোষামুদে নেতা-কর্মী নির্বিবাদে এই নীতি মেনে নিয়েছেন,রাজনৈতিক সুবিধাভোগী চাটুকারেরা বিন্দুমাত্র বিরোধিতা করেন নি, বরং সদস্য পদের জন্যে আবেদন করেছেন এবং ৬৩টি প্রশাসনিক কেন্দ্রের প্রশাসক হিশেবে নিয়োগ পেতে সুপারিশপত্র নিয়ে নেতা কর্মীরা লাইন ধরে দাঁড়িয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বরের বাসার দরজায়। যারা বিরোধিতা করেছে এক দলীয়শাসনতন্ত্রের বিধি অনুসারে তাদের সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আপাদমস্তক চাটুকারিতায় নত এই স্তাবক গোষ্ঠীর কাউকেই ১৬ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বর্বর হত্যাকান্ডের কোনো প্রতিবাদ করতে দেখা যায় নি। শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রীসভার অধিকাংশ সদস্যই খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভায় স্থান পেয়েছেন এবং যারা খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীসভাকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তাদের সবাইকেই দুর্নীতির অভিযোগে কারাবন্দী করা হয়েছে।
বিশেষ ফরমানে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপরে আরোপিত সকল নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হিশেবে নতুন করে নিবন্ধিত হয় এবং নবগঠিত দলের নেতৃত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যান। ১৯৭৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনে আব্দুল মালেক উকিল এবং মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বে ব্রাকেটবন্দী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুটো অংশ নির্বাচন করলেও সরকারের অনুগ্রহভাজন মালেক উকিলের আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘু বিরোধী দল হিশেবে আত্মপ্রকাশ করে। মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ মাত্র ২টি সংসদীয় আসনে বিজয়ী হয়। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় নবগঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমান কিংবা অপরাপর জাতীয় নেতাদের নির্মম হত্যাকান্ডের বিচারকে তাদের নির্বচনী ইশতেহারে স্থান দেন নি। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেত্রী হয়ে ওঠার আগে সম্ভবত আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউই বর্বর হত্যাকান্ডের বিচারের দাবীতে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনের ঘোষণাও দেন নি। নবগঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতারা কেউই স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন বিষয়ে স্পষ্ট কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করেন নি, তাদের সর্বোচ্চ নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিলো ১৯৭২ সালের সংবিধানের পুনঃস্থাপন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদ যে সংবিধান গ্রহন করেছিলো ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত যেখানে ৪টি সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবিত সংশোধনী প্রস্তাবগুলোকে উপেক্ষা করে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে পুনর্স্থাপিত করার অঙ্গীকার জানিয়ে নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছেন তারা কেউই শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবিত ৪টি সংশোধনীকে গ্রহনযোগ্য মনে করেন না। এই ধরণের রাজনৈতিক কর্মীরা নিজেদের অক্ষমতা- কৃতঘ্নতা আড়াল করতে শতমুখে প্রচার করেছেন মুজিবপরবর্তী সময়ে সামরিক শাসন এবং ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র রাজনৈতিক নিষ্পেষণে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে ত্যাজ্য ঘোষণা করা হয়েছিলো, শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করায় শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক অবদানের স্বীকৃতি পেয়েছেন। স্মৃতিভ্রষ্ট আওয়ামী লীগ সুহৃদ গুরুজনদের মুজিবভক্তি সময়ের সাথে আরও তীব্র হচ্ছে, তারা আমার সামনে এমন এক বাংলাদেশ উপস্থাপন করছেন যে বাংলাদেশের ছবি আমার স্মৃতির বাংলাদেশের সাথে মিলছে না।
এইতো আমাদের রাসেল ভাই ! ওয়েলকাম ভাই ! মন্তব্য কিন্তু এখন করছিনে । পাঁচ সাত বার পড়বো আরো ! তারপর মন্তব্য । ভাল থাকুন !
মন্তব্য করুন