শোভন আন্দোলন
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক বিক্ষোভ প্রধানতঃ রাষ্ট্রের নিয়ম-নীতির প্রতি নাগরিকের অসন্তোষ। নাগরিক প্রার্থী বাছাই করে ভোটের মাধ্যমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেন এবং প্রত্যাশা করেন তার অভিযোগ এবং অসন্তোষ জনপ্রতিনিধি রাষ্ট্রের কাছে উপস্থাপন করবেন।
ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদবিরোধী নাগরিক আন্দোলনের নেতারা আন্দোলনের কৌশল হিসেবে নিজেদের দাবী স্পষ্ট করে চিঠিতে লিখে প্রতিটি জনপ্রতিনিধির কাছে পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছিলেন। চিঠির কোনো প্রতিক্রিয়া না দিলে কিংবা চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার পত্র না দিলে জনপ্রতিনিধির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান গ্রহন করো, বিক্ষোভ মিছিল, শান্তিপূর্ণ অবস্থান, শ্লোগান, অনশনের পর্যায় পার হওয়ার পরও যদি প্রশাসন কর্ণপাত না করে, চুড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে সহিংস বিক্ষোভ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের প্রতি সহানুভুতিশীল ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙ্গালী এবং তাদের বন্ধুরা প্রতিদিন নিয়ম করে কংগ্রেসের সদস্যদের কাছে চিঠি লিখেছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির অফিসে গিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন।
ইংল্যান্ডে বেতন বৈষম্য ও কর্মস্থলে নারীনিগ্রহের প্রতিবাদে নারী কর্মচারীরা হাউজ অফ কমন্সের প্রতিনিধিদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন, মিছিল, কর্মবিরতি, ধিক্কার হজম করে হাউজ অফ কমন্সের জনপ্রতিনিধিদের সামনে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনের অধিকার অর্জন করেছেন।
বিশ্বরাজনীতির ডানপন্থী সরণের যুগেও নাগরিক অধিকার এবং ব্যক্তির মর্যাদাবোধের সাথে জাতীয়তাবাদ-ধর্মবাদের সংঘাত হচ্ছে। বিক্ষুব্ধ নাগরিক পথে নামছে। রাষ্ট্র নাগরিক প্রতিক্রিয়া বুঝে নিজেদের আচরণ সংশোধন করছে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতাবাদী রাষ্ট্রে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির উদ্ভাবন এবং ব্যক্তির উদ্যম রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভাগ্যের সাথে অতপ্রোত জড়িয়ে আছে। রাষ্ট্র ব্যক্তির অধিকার খর্ব করলে ব্যক্তি আদালতে নালিশ করে রাষ্ট্রের দুর্ব্যাবহরের প্রতিকার চাইতে পারে। অন্তত ইউরোপ- উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে এই ধরণের নাগরিক অধিকার, ব্যক্তিমর্যাদার দাবীতে সংগঠিত আন্দোলনগুলো খুব বেশী সহিংস হয়ে উঠে নি।
অকুপাই ওয়াল স্ট্রীট, ৯৯% মুভমেন্টর একটা পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের একাংশ অনিয়ন্ত্রিত লুটপাটে জড়িয়ে যায়, তবে লুণ্ঠনের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হওয়া দুস্কৃতিকারীদের জন্যে কেউ পালটা আন্দোলন গড়ে তুলে নি।
রাষ্ট্রের আইনী কাঠামো ব্যক্তির নাগরিক অধিকার রক্ষায় সোচ্চার থাকলে দলের ব্যানার ঝুলিয়ে ষন্ডামি-পান্ডামি নিয়ন্ত্রনে থাকে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কোনো ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী থাকে না। পুলিশ- প্রশাসন কোনোটাই জনপ্রতিনিধির ব্যক্তি অভিপ্রায়ে পরিচালিত না হলে জনপ্রতিনিধি নিজের ক্ষমতার সীমারেখা এবং নিজের কর্মপরিধি উপলব্ধি করে নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখেন।
বাংলাদেশে অন্তত এই ধরণের শোভন- চিঠি-শান্তিপূর্ণ অবস্থান, বিক্ষোভ মিছিল, শ্লোগান আন্দোলনের সংস্কৃতি জনপ্রিয় হচ্ছে না। এখানে জনপ্রতিনিধি নিজ দলের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী আবৃত থাকেন। তিনি এই গোটা ৫০ সন্ত্রাসীর জীবন-জীবিকা এবং স্বেচ্ছাচারের দায়িত্ব গ্রহন করেন। সকল নাগরিককে উপেক্ষা করে এই লেঠেল বাহিনীর কল্যানে তিনি নিরাপদে বসবাস করতে পারেন। একই সাথে আমাদের প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা কর্মচারী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সামনে নিজেকে দাসানুদাস হিসেবে উপস্থাপন করেন। এমন নতজানু অবস্থায় রাজার খেয়ালের বাইরে গিয়ে নাগরিক কল্যানের পক্ষে কিছু বলা কিংবা করা সম্ভব না।
খর্বিত হলেও বিচারবিভাগ কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করছে এখন। আদালত নাগরিক আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠলে অন্ততঃ আমরা জনকল্যানমুখী কিছু বিধান পাবো। সেসব বিধান অনুসরণে আদালত রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে পারলে এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি- প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করে তাদের জরিমানা এবং কারাবাসে বাধ্য করলে আমাদের নাগরিক আন্দোলন কাঠামোতে শোভন আন্দোলনের পরিসর তৈরী হবে।
মন্তব্য করুন