আখাম্বা আচাভূয়া ইম্বিশ
অনেকদিন পর রাহাত খানের "দিলুর গল্প" পড়তে গিয়ে আবার পেলাম এই বিশেষণটিকে। "আখাম্বা আচাভূয়া ইম্বিশ" মানে এক শব্দে "অদ্ভুদ" ধরে নেয়া যায়। নিজেকে আয়নায় দেখলে আমারও প্রায়ই এটা মনে হয়। এর অনেক গুলো কারণের মধ্যে একটি হলো কপালের কাটা দাগটি। দুই পাখার বদলে চার পাখার প্লেনের আদলে কপালে এঁটে বসা এই চিহ্নটি মোটমুটি জন্ম থেকে লালন করছি। শুনেছিলাম, বয়স বাড়ার সাথে সাথে এসব দাগ নাকি মিটে যায়। কিন্তু না। আমার বেলায় তা ঘটবে কেন!! দিব্যি হাত পা ছড়িয়ে বরং ফরিং প্লেন খানা এখন কার্গো রূপ ধারণ করেছে। তাই সই। হাজারো একই নাম (ফারজানা)-এর ভিড়ে কাটার জন্য নিজের "বিশেষ" নাম পেতে বেগ হয় নি।
কাটা নিয়ে বললাম, আর তার ইতিহাস বলবো না, তা তো হতে পারে না।তখন আমার বয়স সাত। মানে সাতমাস! ভাই এবং বোনের সাথে বয়সের যথেষ্ট পার্থক্য থাকায় আমাকে মেনে নিতে তাদের কষ্ট হয় নি বটে। কিন্তু তারা আমাকে "মানুষ" হিসেবেও মেনে নেয়নি। এই ধরা যাক খেলার পুতুল বা জীবন্ত রোবটটাইপের কিছু ভেবেছিল বলে আমার শক্ত ধারনা। তাই যখনই সময় পেতো তখনই আমাকে নিয়ে খেলা শুরু করতো। যারমাঝে অন্যতম হলো, "ক্যাচ ক্যাচ" খেলা!!
এমনি খেলাধুলার দিন ছিল সেদিন। আব্বা অফিসে। আম্মা কোন এক কাজে ব্যস্ত। আর আমার ভাইবোন ব্যস্ত আমাকে নিয়ে। যথারীতি ক্যাচ খেলার ফাঁকে বোন ক্যাচ মিস করে। আমি পিংপং বলের মতো যাই উড়ে। পড়লাম খাটের স্ট্যান্ড ফিট করার লোহায়। কপাল ফেটে চৌচিড়। গলগল করে পড়ছে রক্ত। ভাইবোন বেচারা বড় হলেও আসলে তো ছোটই; ওরা ভয়ে পালিয়ে গেল। এভাবে রক্তরক্তি কাণ্ডে আমি যখন জর্জরিত তারও বেশ ক্ষানিক পড়ে আম্মার মনে হলো, ইদানিং কালে তার সন্তান সংখ্যা বেড়েছে। অতএব খোঁজ পড়লো এই অধমের। আমার তো অবস্থা নিস্তেজ। ফলে গলায় রা-টা নেই। আম্মা এসে আমাকে দেখতে পেল খাটের কিনারায়। তিনি আমার সেই অবস্থা দেখে আমাকে নিয়ে দৌঁড় না দিয়ে নিজে দৌঁড়ে পালিয়ে গেল। কারণ! আমার আম্মা আবার রক্ত ভয় পায়। আম্মা আব্বার দপ্তরে ফোন দিয়ে তাকে আনালেন। আব্বা সাহস করে এতোটুকু বাচ্চাকে পুড়ো তুলায় পেঁচিয়ে দৌড় দিলেন সটান। অবশেষে অল্পের জন্য জানে রক্ষা পেলাম তিনটে মোটা সুতায় প্যাঁচ মারা সেলাইয়ের পর।
রোসো বাপু। এখানেই কাটার গল্প শেষ নয়। সেলাইয়ের দিন তিনেক পর বেশ হাত পা ছোড়া শুরু করেছি। শরীরে বল এসেছে। ভাইবোন কাছ মাড়ায় না। এতে হলো আরেক বিপদ। হঠাৎ করে আম্মা আবিষ্কার করলেন আমার কপালের সেলাইয়ে চাপা দিয়ে রাখা তুলাটি কোথায় নেই। আমাকে উল্টে পাল্টে দেখা শেষে তিনি দেখলেন আমার মুখটা নড়ছে। এবার কষে হা করিয়ে গলার ঠিক শেষ সীমানা থেকে বের করে আনলেন ঔষধ মাখানো গাটটি তুলা। অত:পর ফের পেট ওয়াশ করানোর জন্য বাপের দৌঁড়ানি। এবং আমার পরবর্তী বেঁচে থাকা।
এখানেই শেষ নয়। সে থেকে আজ পর্যন্ত নানা ধরনের রোগ আমাকে হাই-হ্যালো করে গেছে। যেমন বাতজ্বর। সবার হয়- আমারো হয়েছে। এতে বিশেষত্বের কিছু নাই। গোল বাধলো শেষে। যখন ইঞ্জেকশন দিয়ে জীবন থেকে বাতজ্বরকে টাটা বলার সময় হলৌ, তখন সেই ইঞ্জেকশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জীবন ঝালাপালা। যার রেশ এখনও আছে। এরপর জীবনের আরেক ঘাপলা ডেঙ্গু। তখন ২০০৫ সালের শীতকাল। বাতজ্বরের কারণে যেমন জ্বর আসতো, তখনও এসেছে। কিছুতেই কমছে না। উথাল-পাথাল জ্বর। একদিন সকালে দেখি সারা গায়ে লাল দানা-দানা। খালু এলেন। আমাকে নিয়ে গেলেন শমরিতা হাসপাতালে। শমরিতার কতর্ব্যরত ডাক্তার আমাকে দেখে বললেন, কাঁপছেন কেন! আমি ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দিলাম, ১০৫ ডিগ্রী জ্বর নিয়ে স্থিরভাবে বসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ডাক্তার রক্তচক্ষু নিয়ে কিছুক্ষনের মাঝে ঘোষনা দিলেন, এই রোগীকে এখানে ভর্তি করা যাবে না। কারণ যে পরিস্থিতি তখন আমার প্রয়োজন সেটা তখন ঐ হাসপাতালে নেই। তারা আমার রোগটির চিকিৎসার জন্য সাধারণত বর্ষাকালে তৈরি থাকে। এভাবেই আমি জানলাম, কনকনে সেই শীতে আসলে আমার ডেঙ্গু হয়েছিল।
অবশেষে ঠাঁই মিললো সেন্ট্রাল হাসপাতালে। আগেই বলেছিলাম মাত্র ১৫ দিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছিলাম। কিন্তু ডেঙ্গুতে পুরাই কাবু। মাংশপেশির অসম্ভব যন্ত্রনা। মাথা ঘুরানো-বমিতে হুলুস্থুল। এরমাঝে নিজের বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে দশ দিনে পেশির ব্যাথা কমিয়ে আনলাম। অফিস জয়েন করলাম। এরমাঝে এক সন্ধ্যায় মনের অজান্তেই পা কুঁচকে পেটের কাছে চলে আসে। হাত দুইটা টান দিয়ে বুকের কাছে। এক কলিগের সহায়তায় বাসায় পৌঁছাতেই শুরু হলো রক্ত বমি। ততক্ষণে হাতপা কুঁচকে আমি পুরাই গোলাকার ধারণ করলাম। গেলাম ঢাকা মেডিকেল। ডাক্তার কড়াভাবে বললেন এদফা যেন বিশ্রামে কমতি না হয়। এবার বিশ্রাম নিলাম। সুস্থ হলাম। কিন্তু সুনামিতে যেমন আবহাওয়া বদলে যায়, তেমন ভাবেই আমার মাঝেও কিছু গুবলেট হলো।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত নিয়মিত কিছু ভোগান্তি আছে।
তারপর আরেকবার পেটে অসম্ভব ব্যাথা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। আবারো দুইদিন কাতরালাম। মরে গেলাম-টাইপ অবস্থা। ফের হাসপাতাল। আল্ট্রা সনোর রিপোর্ট বলে, নাড়িভুড়িতে নাকী প্যাঁচ লেগেছে! এটা কিছু হলো!
আর এই গেল হপ্তায়, দিব্যি নাশতা খাচ্ছি। এমন সময় এলো এক হাঁচি। সেটা চাপা দিতেই বোধ করি ভোগান্তির শুরু। পিঠের মাসল শক্ত হয়ে বেদম টান দিল। টান দিতে দিতে এক পর্যায়ে বাম হাত আর কান পর্যন্ত ব্যাথা ছড়িয়ে গেল। স্ক্যাপুলার এমন টান যে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলাম। চিৎকার করে কান্নার কারণে শ্বাশুড়ি এসে পিঠে হালকা করে মালিশ করে দিলেন। আর কিছুক্ষণ পর ডাক্তার দেবর এসে বললো, মালিশ করা চলবে না। আমাদের দুইজনের (আমার আর মা'র) মন আরো খারাপ হলো তখন।
সেই অসহ্য ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে দুই দিন পার করার পর এখন সামান্যই ব্যাথা আছে। আলহামদুলিল্লাহ। একটা হাঁচির থেকে এমন টানাহ্যাচড়া হবে জানলে গগনভেদী চিৎকারে হাঁচি দিতে এতো ভাবতাম নাকী!
এখন বলুন, এধরনের "আখাম্বা আচাভূয়া ইম্বিশ" মানে "অদ্ভুদ" ভোগান্তি কি সবার ভাগ্যে জোটে?
আহারে..এত যন্ত্রনা সহ্য করে যখন টিকে আছেন, সামনে ভাল দিন ইনশাআল্লাহ আসবেই। শুভকামনা আপনার জন্য।
আরে এটা কোন ব্যাপারই না। আমি ভাই এসব অসুখ-বিসুখে বিশ্বাসী না। মাশাআল্লাহ অনেক ভালো আছি..
কি হলো?
না জোটেনা.. আমি বড়ই ভাগ্যবতী..
কী ঘটনার কী প্রকাশ! চমৎকার, ঘটনাটা না, প্রকাশটা।
ভোগান্তিগুলা লিখলেন তো মজার করে
কি আর করা বলেন। এধরনের বিষয় থাকবেই সবসময়। অতএব ভালো একে সাজা হিসেবে না নিয়ে মজা হিসেবে উড়িয়ে দেয়া..কি বলেন?
লেখাটা একদম ডি ল্যা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস! ইয়াক, ইয়াক টাইপ হইছে।
আমিও দুইবার ডেঙ্গু রোগ ভোগ বিশেষজ্ঞ একজন।
ঔখাম্বাড্রাঠ্রাখ্রাঘ্রাষ্ঠেৎ...
বজৃপাত ছাড়া মরন নাই

এটা কি কইলেন আফা... ইন্নালিল্লাহ...
অনেক কষ্টে হাসি আটকাইয়া রাখছি। আমি নিজেও কিছুটা একই টাইপের, ভোগান্তিগুলা বুঝতেছি। কিন্তু তারপরেও শেষ পর্যন্ত আপনার লেখার কারণে না হাইসা পারলাম না।
আপনি দেখি অসুখ এক্সিডেন্টের পুরা মন্ত্রনালয় নিয়া বইসা ন
সে আর বলতে..
মন্তব্য করুন