কক্সবাজারে রোজার মাস - কি খাবি, কি খেতে চাস?
অনেকদিন ধরেই ইচ্ছা ছিল আম্মাকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে যাবো। ভদ্রমহিলা জীবনে কোনও দিন সমুদ্র দেখেন নাই। ভাবলাম এই রোজাতে কাজের চাপ একটু কম! আবার বিভিন্ন হোটেলে / রিসোর্টে রমজানে বেশ ছাড়-টাড় দেয়! এটাও সুযোগ একটা বটে! আবার আবার আম্মার সাথে ভাই ফ্রি! তাই সব বিবেচনা করে দুইবার তারিখ পরিবর্তন করে ৭ এর রাতে রওনা দিলাম কক্স-এর উদ্দেশ্যে। সেন্টমার্টিন ট্রাভেলস এর বাস- এবং সে আরেক ভিন্ন ইতিহাস! তবুও উপরওয়ালার অশেষ কৃপায় সকাল সকাল পৌছে গেলাম যেটা আশাতীত! উঠলাম বেস্ট ওয়েস্টার্ন হেরিটেজ হোটেলে যেটা আমার মতে সাগরের তীর না হয়েও বেস্ট লোকেশন! বারান্দায় দাঁড়ালে সমুদ্র! আর সমুদ্রের গর্জন।
এবার হলো নাস্তা খাওয়ার পালা। কক্সবাজারে সকাল সকাল নাশতা! আমার মনে লাড্ডু! কক্স মানেই মজার মজার খাবার! কিন্তু কিসের কী! ডলফিন গলি থেকে যতদূর চোখ যায় সব দোকান বন্ধ! সব! কলাপসিবলে তালামারা। দুইটা দোকানে জিজ্ঞাসা করলাম- ভাই নাশতা আছে? তারা আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমি ভীম আর তিনি গান্ধারী! এক্ষুনী ছাই হয়ে যাবো! আমি মনে মনে প্রমোদ গুনলাম! কারণ এ আমার বরিশাইল্লা মা- মাইর একটাও মাটিতে পরবে না খানা না পেলে। কোনও রকমে একটা টমটম পেলাম! দেখি কতদূর গেলে নাশতা পাওয়া যায়। লাবনী পয়েন্টের চিপায় পেলাম একখানা টং দোকানের ভেতর আব্রুর অন্তরালে ডিম সিদ্ধ রান্না (জি ভাই ডিম সিদ্ধ) এবং দুই না রুচি- না পরোটা! এই খানা খেয়ে খেয়ে আবারও ভাবলাম যদি এটাই হয় খাবারের অবস্থা! তাহলে আমি শেষ! কারণ কক্সবাজার আসা মানেই পৌষি বা ঝাউবনের খাবার! শুনলাম আরও ভয়ঙ্কর কথা! কিছু দোকান একমাসের জন্য বন্ধ! কিছু খোলে ইফতারের পর কিন্তু “স্পেশাল প্লেটার” যেমন ভর্তা ভাজি বা সামুদ্রিক মাছ তেমন থাকেনা। মানে ”খাইলে খা- না খাইলে যা”টাইপ!
এইবার আমার মাথায় হাত! এটা একটা পর্যটনকেন্দ্র! যেখানে একমাস পর্যটকদের জন্য স্বাগত জানানোর কোনও খাবারের জায়গা খোলা নেই! অথচ এখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে কক্সবাজার গিজগিজ করছে বিদেশি পর্যটক- যাচ্ছে বাংলাদেশি উন্নয়ন কর্মীরাও। তারা কি খাচ্ছে! এখন বলতে পারেন – ক্যাফে -ট্যাফে আছে বটে! কিন্তু কক্সবাজারে গিয়ে মানুষ বার্গার খাবে! নাকী কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী খাবার খাবে? বড় বড় পাঁচতারা হোটেলে ৭০০-৮০০ টাকায় একটা পাস্তা খাবে? নাকী ভর্তা-ভাজি, শুটকি খেয়ে আরেকবার কক্সে যাবার প্ল্যান করবে! আর বার্গার খেতে কক্স-এ কেন যাবে লোকজন! কেন তবে কলকাতার এক্সপেন্সিভ হোটেলে থেকে না খেয়ে দিন কাটিয়ে পরে ব্যাংকক যাওয়ার প্ল্যান করবে না! নাকী জোর করে বড় হোটেলের দামী খাবার খাওয়ানোর পন্থা এটা!
যদি তাই হয়- সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে এখন! কোনও ভাবেই এধরনের উষ্কানিমূলক অবস্থা থাকতে পারে না দেশের সবচেয়ে বড় পর্যটন কেন্দ্রে! এবং এটা অবশ্যই হুমকি দেমের পর্যটন শিল্পের জন্য।
যারা কক্সবাজারে টুরিজম নিয়ে কাজ করছেন, তারা কী এটা ভেবেছেন! যখন আপনারা ছাড় দিচ্ছেন বিভিন্ন হোটেলে তখন কি এলাকার টুরিজম নিয়েও আপনাদের ভাবা উচিৎ না?
অসম্ভব রকমের আশাহত হয়ে এবার ফিরে এসেছি কক্স থেকে! বাঁচোয়া এটাই ইনানি -হিমছড়ির রাস্তায় দুইটি খাবারে দোকান খোলা ছিল এবং রূপচান্দা মাছও ছিল! আম্মাকে খাওয়াতে পেরেছি!
আর হ্যা! ”বড় বড়” হোটেল ও ক্যাফেও খোলা ছিল!
এখন অনেক বুদ্ধিমান বলবেন- রোজা রাখেন না কেন? ভাই মানুষ নানা কারণে রোজা রাখে না। কেউ বয়সের কারণে, কেউ শারীরিক অবস্থার কারণে! বা কেউ নারীত্বের নিয়মিত উদযাপনে! সেই হিসাব তো আপনাকে দেব না। কোন একটা দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাকে ধর্মের লেবাসে জড়ালে কি লাভ হবে নাকী লোকশান! আমি তো ভাই একটা পর্যটন কেন্দ্রে গেছি সেখানে আমি পর্যটক হিসেবে অভ্যর্থনা চাই! এটাই মূল কথা! না হলে এভাবে চলতে থাকলে কক্সবাজার পরিচিত হবে কেবল শরনার্থী বাজার হিসেবেই! আর আপনার দেশের টাকা যাবে ভিনদেশে। তখন করবেন ব্যবসা- দিয়েন ছাড়!
শুধু কি কক্সবাজার? চট্টগ্রামেও তো রোজার মাসে দোকানদারেরা মৌলবাদী ধর্মপুলিশ হয়ে যায়। যেন সারা বছর এরা কেউ কোনো অপকর্ম করে না। তাই রোজার মাস এদের কাছে জনগণকে নির্বিচারে নসিহতের উপলক্ষ। সমস্যা হলো গোয়াড় ধর্মকানারা সংখ্যায় বেশি, প্লাস জাতিগতভাবে আমরা হুজুগে ও ভীরু। সব মিলিয়ে দেখলে সাধারণ ব্যবসায়ীদের দোষ খুব বেশি না। সমস্যার গোঁড়ায় গেঁড়ে বসে আছে আমাদের দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা ও মনোবল; দুর্নীতিপরায়নতা ও অনধিকারচর্চা যার সমন্বিত ফলাফল।
মন্তব্য করুন